কোরআন থেকে ইতিহাস ও বাস্তবতার নিয়ম বোঝা

 


কোরআন মানুষের জন্য শুধু ধর্মীয় নির্দেশনার গ্রন্থ নয়, এটি একটি জীবনবিধান, যা আমাদের ইতিহাস ও বাস্তব জীবনের নিয়ম-কানুন বুঝতে সাহায্য করে। কোরআন আমাদের ইতিহাসের ধারা পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠন করার উপায় শিক্ষা দেয়।

কোরআন বলে যে জীবনের সবকিছু—ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও সভ্যতার উত্থান-পতন—একটা নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে চলে। কোরআনের শেখানো এই ধরনের নিয়মগুলোকে বলা হয় কোরআন ‘সুনান’। সুনান মানে ‘রীতি’ বা ‘নিয়ম’। মানে আল্লাহর নির্ধারিত সেই সার্বজনীন নিয়ম, যা প্রকৃতি, সমাজ এবং ইতিহাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে।

এই নিবন্ধে আমরা দেখব কীভাবে কোরআন আমাদের এই নিয়মগুলো বোঝার এবং জীবনে কাজে লাগানোর শিক্ষা দেয়।

জীবনের পথপ্রদর্শক কোরআন

ইসলাম বিশ্বের সার্বজনীন নিয়মের অংশ। এটি শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, বরং মানুষের জন্য এমন একটি পথনির্দেশ, যা নবীগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন। (মালিক বিন নবি, আল-জাহিরাতুল কুরআনিয়া, দামেস্ক, দারুল ফিকর, ১৪২৪ হি./২০০০ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৩০০)

ইসলামের আগমন মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার জন্ম দিয়েছে।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইকবাল

কোরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ধারণ করে। আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় এই কোরআন সবচেয়ে সঠিক পথের দিকে পথ দেখায় এবং সৎকাজকারী মুমিনদের জন্য সুসংবাদ দেয় যে তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সুরা ইসরা, আয়াত: ৯)

আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরআন শুধু আধ্যাত্মিক পথ দেখায় না, বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে—ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক—পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

এই নির্দেশনা কোনো আবেগের ফল নয়। বরং কোরআনের গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে বোঝা যায় যে তাতে ইতিহাস ও সমাজের নিয়ম বোঝার জন্য একটি পরিষ্কার কাঠামো আছে। বোঝা যায়, ইতিহাস কোনো এলোমেলো ঘটনার সমষ্টি নয়, বরং আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীনে পরিচালিত হয়।

কোরআন ও যুক্তিবাদী চিন্তা

দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইকবাল বলেছেন, ইসলামের আগমন মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার জন্ম দিয়েছে। (মুহাম্মাদ ইকবাল, তাজদিদুল ফিকরিদ দীনি ফিল ইসলাম, মাকতাবাতুল ইসকান্দারিয়া, ২০১০ খ্রি., পৃষ্ঠা: ২০৭-২০৮)

কোরআন মানুষকে বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিবাদী চিন্তার দিকে ডাকে। এটি কুসংস্কার, পৌরাণিক বিশ্বাস বা পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুকরণকে প্রত্যাখ্যান করে। কোরআন বলছে, মানুষকে নিজের স্বাধীন চিন্তা ও পছন্দের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোরআন ইতিহাসের ব্যাখ্যায় কাকতালীয়তা বা নিয়তিবাদকে (যেমন, সবকিছু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে) প্রত্যাখ্যান করে এবং মানুষকে উদ্যোগী হতে বলে।

কোরআন আমাদের শেখায়, ইতিহাস ও সমাজের গতিশীলতা কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে চলে। এই নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়, নিরপেক্ষ এবং সুনির্দিষ্ট।

উমর উবাইদ হাসানা বলেন, “এই নিয়মগুলো হলো বিশ্বকে শাসনকারী আইন। এটি আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য, যা কারণ ও ফলাফলের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিশ্রমের প্রতি ন্যায্য প্রতিদান দেয়।” (মাজিদ আরসান আল-কিলানি, মাকুইমাতুশ শাখসিয়াতিল মুসলিমা আও আল-ইনসানুস সালিহ, দোহা, রিয়াসাতুল মাহাকিমিশ শারইয়া ওয়াশ শুউনুদ দিনিয়া, পৃষ্ঠা: ১৪, উমর উবাইদ হাসানার ভূমিকা)

ইতিহাসের নিয়ম: কোরআনের দৃষ্টিকোণ

কোরআন আমাদের শেখায় যে ইতিহাস কোনো এলোমেলো ঘটনার সমষ্টি নয়। বরং এটি আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীনে চলে। কোরআন বলে, “তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, যারা পূর্বে ছিল তাদের পরিণতি কী হয়েছে।” (সুরা রুম, আয়াত: ৪২)

এটি আল্লাহর নিয়ম, যা পূর্ববর্তীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, এবং তুমি আল্লাহর নিয়মের কোনো পরিবর্তন পাবে না।
সুরা আহজাব, আয়াত: ৬২

এই আয়াত আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলে। এটি আমাদেরকে পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উত্থান-পতনের কারণ বোঝার জন্য উৎসাহিত করে। কোরআন আরও বলে, “এটি আল্লাহর নিয়ম, যা পূর্ববর্তীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, এবং তুমি আল্লাহর নিয়মের কোনো পরিবর্তন পাবে না।” (সুরা আহজাব, আয়াত: ৬২)

বোঝা যায়, ইতিহাসের নিয়ম অপরিবর্তনীয় এবং নিরপেক্ষ।

আবার, কোরআন বলে, “তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন। তারপর আল্লাহ পুনরায় সৃষ্টি সৃজন করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ২০)

অর্থাৎ বিশ্বের সবকিছু—প্রকৃতি, সমাজ, ইতিহাস—আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীনে চলে।

বাস্তব জীবনে নিয়মের প্রয়োগ

কোরআনের নিয়মগুলো শুধু তাত্ত্বিক নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কাজে লাগে। আজকের বিশ্বে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—পশ্চাদপসরণ, ঔপনিবেশিকতা, আধুনিকতা, পশ্চিমা প্রভাব, বিশ্বায়ন ইত্যাদি।

অনেকে এই ঘটনাগুলোকে ভাগ্যের লিখন বা অপ্রতিরোধ্য শক্তি মনে করে হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু কোরআন আমাদের শেখায় যে এই সব ঘটনা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। এগুলো নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে চলে। এই নিয়মগুলো বোঝার মাধ্যমে আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারব।যেমন, প্রকৃতির নিয়ম বোঝার মাধ্যমে মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। একইভাবে, সমাজ ও ইতিহাসের নিয়ম বোঝার মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজের উন্নতি করতে পারি।

কোরআন আমাদেরকে এই নিয়মগুলো বোঝার এবং কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করে। বলে, আমাদের হতাশার দিকে না গিয়ে বরং সক্রিয়ভাবে ইতিহাস গঠনের দায়িত্ব নিতে হবে।

কোরআনের নিয়ম ও আমাদের দায়িত্ব

কোরআন আমাদের শেখায় যে আমরা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। এই দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদেরকে পৃথিবীকে আবাদ করতে হবে এবং কোরআনের মূল্যবোধের আলোকে সমাজ গঠন করতে হবে। কিন্তু এই কাজ করতে হলে আমাদেরকে ইতিহাস ও সমাজের নিয়ম বুঝতে হবে।

যেমন, কোনো জাতির উত্থান-পতন নির্ভর করে তাদের কাজ, বিশ্বাস এবং নিয়মের প্রতি তাদের সচেতনতার উপর। যারা এই নিয়মগুলো বোঝে এবং তা কাজে লাগায়, তারা ইতিহাসে সফলতা অর্জন করে। আর যারা এই নিয়মগুলো উপেক্ষা করে, তারা পিছিয়ে পড়ে।

কোরআন আমাদেরকে পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলে। বলে, আদ, সামুদ, ফিরাউনের জাতি—এদের পতনের কারণ ছিল তাদের অহংকার, অবাধ্যতা এবং নিয়মের প্রতি অবহেলা। কোরআন আমাদেরকে এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে এবং সঠিক পথে চলতে বলে।

ঔপনিবেশিকতা বা পশ্চাদপসরণের মতো ঘটনাগুলো আমরা কেবল ‘ভাগ্য’ বলে ছেড়ে দিতে পারি না। বরং আমাদের বুঝতে হবে কেন একটি জাতি পিছিয়ে পড়ে এবং কেন আরেকটি জাতি শক্তিশালী হয়।

আধুনিক সময়ে কোরআনের নিয়ম

আজকের বিশ্বে আমরা নানা সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বায়ন, পশ্চিমা প্রভাব, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি—এই সবই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কোরআন আমাদের শেখায় যে এই সব ঘটনা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। এগুলো নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে চলে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই নিয়মগুলো বোঝা এবং তা কাজে লাগিয়ে আমাদের সমাজ ও জাতির উন্নতি করা।

যেমন, ঔপনিবেশিকতা বা পশ্চাদপসরণের মতো ঘটনাগুলো আমরা কেবল ‘ভাগ্য’ বলে ছেড়ে দিতে পারি না। বরং আমাদের বুঝতে হবে কেন একটি জাতি পিছিয়ে পড়ে এবং কেন আরেকটি জাতি শক্তিশালী হয়। কোরআন বলে, “নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনে।” (সুরা রা’দ, আয়াত: ১১)

এই আয়াত আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে এবং নিয়মের প্রতি সচেতন থাকতে বলে।

কোরআন আমাদেরকে শুধু ধর্মীয় বিধানই দেয় না, বরং ইতিহাস ও বাস্তবতার নিয়ম বোঝার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেয়। এটি আমাদের শেখায় যে ইতিহাস কোনো কাকতালীয় ঘটনার ফল নয়, বরং আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অধীনে চলে।

এই নিয়মগুলো বোঝার মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি। কোরআন আমাদেরকে হতাশা থেকে ফিরে আসতে বলে, সক্রিয়ভাবে ইতিহাস গঠনের দায়িত্ব নিতে বলে। আমাদের দায়িত্ব হলো কোরআনের এই নিয়মগুলো বোঝা এবং তা কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বই Pdf Download