কোরআন যেভাবে মানুষের চেতনা পাল্টে দিয়েছে
আজকের বিশ্বে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক চলছে অবিরাম। কেউ বলছেন, ধর্ম বিজ্ঞানের পথে বাধা; কেউ বলছেন, এরা দুটি আলাদা পথ। কিন্তু এই বিতর্কের মূলে রয়েছে আমাদের চেতনার সংকীর্ণতা।
এই সংকীর্ণতা ভেঙে কোরআন আমাদেরকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে—যেখানে ধর্ম এবং বিজ্ঞান একই নিয়মের অধীনে চলে। কোরআন কেবল একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি মানুষের চেতনায় এক বিপ্লব ঘটিয়েছে।
পূর্বের নবীদের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ করে কোরআন মানুষকে পড়া, শেখা এবং পার্থিব নিয়ম কাজে লাগানোর পথ দেখিয়েছে।
পূর্বের নবীদের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ করে কোরআন মানুষকে পড়া, শেখা এবং পার্থিব নিয়ম কাজে লাগানোর পথ দেখিয়েছে। (তাহা জাবির আল-আলওয়ানী, আত-তাওহীদ ওয়াত তাজকিয়া ওয়াল আমরান, দারুল হাদী, বৈরুত, ২০০৩ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৪৫)
কোরআনের প্রত্যেক শব্দে একটি নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে এবং প্রত্যেক অর্থ তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত। ‘দীন’ এবং ‘ইলম’ এই দুটি শব্দ কোরআনের মূল চাবিকাঠি, যা ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। (আবদুল্লাহ আলী সামাক, মাদখালুন লি দিরাসাতিল আদিয়ান, দারু দিরাসাতিল ইলমিয়া লিন নাশর ওয়াত তাওজি', মক্কা, ২০১৩ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৬)কোরআনের মানুষকে কুসংস্কার, উপজাতীয়তাবাদ এবং অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করে কথা, জ্ঞান এবং পড়ার দিকে নিয়ে গেছে। কোরআন এমন একটি পাঠ্য, যা যাদু নয়, বরং পড়া ও শেখার মাধ্যমে উপলব্ধি যায়।
কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতই এই পরিবর্তনের ঘোষণা: ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে জমাট রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিম । তিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না’ (সুরা আলাক, আয়াত: ১-৫)
প্রত্যেক নবীর জন্য মুজিযা (অলৌকিকতা) ছিল, যা মানুষ বিশ্বাস করত। কিন্তু আমাকে যা দেওয়া হয়েছে তা ওহী।সহিহ বুখারি, কিতাবুল ই’তিসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ
এই আয়াত পড়াকে ইবাদত, খিলাফত, পৃথিবী আবাদ এবং সভ্যতা গঠনের চাবি করে তুলেছে। পড়া মানে শুধু বই পড়া নয়, এটি জ্ঞান সংগ্রহ, বিনিময়, বিকাশ এবং প্রয়োগের সমন্বয়।
কোরআন মানুষকে সেই পথ দেখিয়েছে যা চিন্তা, সংস্কৃতি, সমাজ এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে। এটি মানুষকে অসংখ্য কিংবা থেকে মুক্ত করে কসমের নিয়ম অন্বেষণের দিকে নিয়ে গেছে।
কোরআনের অলৌকিকতা এখানে স্পষ্ট—এটি বাহ্যিক বা হাতের তালুতে দেখানো অলৌকিকতা থেকে চিন্তা ও কথার অলৌকিকতায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর জন্য মুজিযা (অলৌকিকতা) ছিল, যা মানুষ বিশ্বাস করত। কিন্তু আমাকে যা দেওয়া হয়েছে তা ওহী।’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ই’তিসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ; সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমান)
অর্থাৎ, কোরআন অস্থায়ী অলৌকিকতা থেকে স্থায়ী অলৌকিকতায়—পড়া, তিলাওয়াত এবং চিন্তার মাধ্যমে—পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এটি ভবিষ্যতকে পড়ার উপর ভিত্তি করে গড়ার ইঙ্গিত দেয়: আল্লাহর কিতাব পড়া এবং সৃষ্টির কিতাব পড়া।কোরআনের কাহিনীগুলো বারবার ইতিহাস বলে বলে নবীদের অভিজ্ঞতা, মানবজাতির উত্থান-পতন, চিন্তা, মূল্যবোধ এবং সমাজের পরিবর্তনের রীতি জানায়। কোরআন সৃষ্টির গতি, পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্যের কথা বলেছে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তাদেরকে আমার নিদর্শন দেখাব আকাশমণ্ডলী ও তাদের নিজেদের মধ্যে, যতক্ষণ না স্পষ্ট হয় যে, এটি সত্য। তোমার প্রতিপালকের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তিনি সবকিছুর সাক্ষী?’ (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৫৩)
আবার বলেছেন, ‘যারা জ্ঞানী তারা বলে, ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য এবং এটি প্রভুত্বশালী প্রশংসিতের পথের দিকে পথ দেখায়’।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ৬)
কোরআনের অবতীর্ণের সঙ্গে আরবের চেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমে আরবরা কোরআনের ভাষা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। তারপর তার অর্থ চিন্তা করতে শুরু করে।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে যাদের পাঠ-অভিজ্ঞতা বেশি তারা সভ্যতায় নেতৃত্ব দিয়েছে। যেমন—ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিমরা, আজকের জাপান, আমেরিকা এবং ইউরোপ। (জাউদত সা’ইদ, ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম, দারুল ফিকরিল মু'আসির, বৈরুত, ১৯৯৩ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১১)
কোরআনের অবতীর্ণের সঙ্গে আরবের চেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমে আরবরা কোরআনের ভাষা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। তারপর তার অর্থ চিন্তা করতে শুরু করে। জ্ঞানের ওপর জোর দিয়ে কোরআন তাদেরকে আকৃষ্ট করে। ফলে তাঁরা জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করে—সকল উপায়ে।
এটি চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে সভ্যতাময় পরিবর্তন এনেছে। কোরআনের এই সম্ভাবনা আজও রয়েছে। এটি আমাদের ফিতরতের পতন থেকে উদ্ধার করে এবং ধর্ম-বিজ্ঞানের মিথ্যা বিবাদ থেকে মুক্ত করে।
কোরআনের অবতীর্ণের সঙ্গে আরবের চেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমে ভাষা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধতা, তারপর অর্থ চিন্তা। জ্ঞানের উপর জোর দিয়ে কোরআন তাদেরকে আকৃষ্ট করে, ফলে জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোনিবেশ। এটি চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে সভ্যতাময় পরিবর্তন এনেছে।
এখনও কোরআনের পাঠ একইভাবে আমাদেরকে সত্য, নৈতিকতা এবং সৌন্দর্যের জ্ঞান দেয়। এবং যদি আমরা উপলব্ধি করি, তাহলে এর মাধ্যমে আমরা নতুন সভ্যতা গড়তে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে কোরআনের আলোয় চলার তাওফিক দিন। আমিন।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন