যেমন কর্ম তেমন প্রতিফল

যেমন কর্ম তেমন প্রতিফল

********************************************
মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
*****************************

মানুষের পার্থিব জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের চুলচেরা হিসাব-নিকাশ হবে পরকালীন জীবনে। যদিও মানুষ তার সৃষ্টিশীল সৎকর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। তাই সে তার সৃষ্টিশীল কাজকর্মকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানা মত ও উপায় অবলম্বন করে, যাতে মানুষ তার সৃষ্টিকর্ম থেকে ভালো দিকগুলো গ্রহণ করতে পারে, সমাজ উপকৃত হয় এবং সৃষ্টির কল্যাণময় ধারা অব্যাহত থাকে। যে ব্যক্তি নেকআমল বা সৎকর্ম করে ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছে, আল্লাহ তার প্রতিফলের নিশ্চয়তা বিধানে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং যারা যাবতীয় অন্যায়, অপকর্ম, পাপাচার করে বদআমলের সঙ্গে পরলোকগমন করেছে, তাদের কপালে জুটবে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক অগ্নিকুণ্ডের শাস্তির স্থান জাহান্নাম। তাই ভূপৃষ্ঠে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধরনের অন্যায় ও অপকর্ম করা চলবে না; একমাত্র আল্লাহকেই পূর্ণাঙ্গভাবে ভয় করে সাবধানে সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে হবে। পবিত্র কোরআনে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘যে সৎকর্ম করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দকর্ম করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক তাঁর বান্দাদের প্রতি কোনো জুলুম করেন না।’ (সূরা হা-মিম সিজদা, আয়াত: ৪৬)
রোজ হাশরে আল্লাহ তাআলা মানুষের পাপ-পুণ্যের ফয়সালা করবেন এবং যার যার দুনিয়ার আমল-আখলাক কর্মফল অনুযায়ী নিখুঁত নিক্তিতে বিচার করবেন। যারা অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি ও অসৎকর্মে নিজকে নিয়োজিত রাখবে এবং পাপাচারে লিপ্ত থাকবে, প্রতিফলস্বরূপ তিনি তাদের কঠিনতম শাস্তির ভয়াবহ কষ্টে নিপতিত রাখবেন। আর যারা সৎকর্মের মধ্যে নিজকে সমর্পণ করবে এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুযায়ী ইহকালীন জীবন অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাদের সুখ-শান্তিময় বেহেশত প্রদান করবেন। শুধু তাই নয়, সেসব নেকআমলকারীকে সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করবেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আছে নিয়ামতে ভরা জান্নাত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ৮-৯)
দুনিয়ায় যত মানুষ এসেছে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের পর তাদের একত্র করে আমলনামার লিখিত প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করবেন। অবশ্য এ সময় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হাত-পা কথা বলবে এবং ন্যায়-অন্যায়ের সাক্ষ্য দেবে। শেষ বিচারের দিন প্রতিটি মানুষ তার দুনিয়ার জীবনের কর্মফল অনুযায়ী ন্যায্য প্রতিদান পাবে। ভালো কাজ করলে পুরস্কার তথা জান্নাত আর মন্দকাজ করলে শাস্তি তথা জাহান্নাম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, আজ কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।’ (সূরা আল-মুমিন, আয়াত: ১৭) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এ জন্য যে আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।’ (সুরা আল আহ্কাফ, আয়াত: ১৯)
ইসলামের আদল-ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে যেমন কর্ম তদানুযায়ী প্রতিফল পাওয়া। সৎকর্ম করলে কাজের হার অনুসারে পুরস্কার প্রাপ্তি আর অসৎকর্ম করলে তার পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তি। সৎকর্ম সম্পাদনের প্রতিফল সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কেউ কোনো সৎকর্ম করলে সে তার দশ গুণ পাবে এবং কেউ কোনো অসৎকাজ করলে তাকে শুধু তারই প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৬) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সূরা আজ-জিলজাল, আয়াত: ৭-৮) এ জন্য মানবজাতিকে অপকর্ম প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে; যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে; যদি সে এতেও অপারগ হয়, তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
শেষ বিচারের দিন মানুষের সঙ্গে আল্লাহর ক্ষমাসুন্দর আচরণ পরম করুণা ও দয়ার পরিচয় বহন করে। নানা অসিলায় ইমানদার পাপী বান্দাদের আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। তাদের ভালো কাজের পুরস্কার ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু পাপের শাস্তি কোনো মতেই পাপের পরিমাণের চেয়ে অধিক হবে না। নিশ্চয়ই এগুলো আল্লাহর দয়ার আধিক্যের প্রমাণ। মানুষ ভুল করে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিধি-বিধান ও সীমা লঙ্ঘন করে ফেলার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করলে সীমাহীন দয়া ও করুণার কারণে তিনি তা ক্ষমা করে দেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের কর্মের মন্দ ফল তাদের ওপর আপতিত হয়েছে, এদের মধ্যে যারা জুলুম করে, তাদের ওপরও তাদের কর্মের মন্দ ফল আপতিত হবে এবং এরা (আল্লাহর শাস্তিকে) ব্যর্থও করতে পারবে না। ...বলো, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অন্যায়-অবিচার করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন, তিনিই তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আজ-জুমার, আয়াত: ৫১ ও ৫৩)
যদি কোনো বান্দা ভুলবশত ঘোরতর পাপকাজ করে ফেলে তাহলে সেই ব্যক্তি যদি কায়মনোবাক্যে সিজদারত হয়ে তওবা-ইস্তেগফার করে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ভিক্ষা চায় তাহলে আল্লাহ পাক দয়াপরবশ হয়ে সেসব লোককে ক্ষমা করে দেন। তাই আসুন, পরকালীন জীবনের ভয়-ভীতির শঙ্কা মাথায় রেখে পার্থিব জীবনে সব ধরনের অনৈতিক, পাপকাজ, অন্যায়-অপকর্ম ও কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেদের সর্বদা বিরত রাখি এবং জাগতিক ও পারলৌকিক জীবন সর্বতোভাবে সুখ-শান্তিময় করার আপ্রাণ চেষ্টা করি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট