শান্তিই সৌভাগ্যের অবলম্বন

শান্তিই সৌভাগ্যের অবলম্বন

***********************************************মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

বিশ্বশান্তির জন্য মানুষের আকুলতা চিরন্তন। মানুষের প্রধান অন্বেষা শান্তি। ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা যা কিছুই থাক, আল্লাহর কাছে শান্তি কামনাই মানুষের চিরকালীন প্রার্থনা। শান্তি ছাড়া ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবন—সবই মূল্যহীন। শান্তি লাভের জন্যই মানুষ যা কিছু করে, যা কিছু চায়। মানবজীবনে শান্তি কত যে মহামূল্যবান, তা উপলব্ধি করা যায় জীবনে শান্তি যখন দুর্লভ হয়ে পড়ে। কিন্তু পার্থিব ক্ষমতা ও
ধন-সম্পদের ওপর কর্তৃত্বের দুরন্ত সাহসে সারা বিশ্বে অবিরাম দ্বিধাহীন চিত্তে কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় স্থায়িত্ব লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অন্যের সম্পদ লুট করে বা বল প্রয়োগ করে নিজের করে নেওয়ার তীব্র বাসনায় দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে। এ জন্য শান্তি সুরক্ষায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির স্বার্থে সব ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সদ্ভাব পোষণ করা অবশ্যকর্তব্য। শান্তির ধর্ম ইসলাম মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর সেখানে তোমরা বিপর্যয় বা অশান্তি ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬)
ইসলাম শব্দের মধ্যেই শান্তির অমিয় ফল্গুধারা সদা প্রবহমান। শান্তির পথে চলা থেকেই ইসলামের উদ্ভব। ইসলামের মর্মবাণী হলো শান্তি, সাম্য ও মানবতাবোধ। ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির প্রচেষ্টার মধ্যে ইসলামের মূল সুর ধ্বনিত ও অনুরণিত। ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি অর্জনের পাশাপাশি মানুষের জীবনের সব পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের অভীষ্ট লক্ষ্য। ইসলাম মানবসেবা ও সমাজকল্যাণের মাধ্যমে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অহিংসা, পরমতসহিষ্ণুতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কী হতে পারে? মূলত ইসলাম হচ্ছে সুশৃঙ্খল জীবনবোধের পরিচ্ছন্ন সভ্যতার বিকাশ। কেউ যখন সুশৃঙ্খল কোনো পথের বা নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন সে শান্তির পথ খুঁজে পায়। পৃথিবীর দিশেহারা মানুষ এখন শান্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। অথচ পবিত্র কোরআনে নবী করিম (সা.)-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)। তাই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) যে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছেন, সেই শান্তি প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তধর্মীয় সংলাপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্তরে অন্য মানুষের জন্য সহানুভূতির উন্মেষ ঘটানো। প্রতিটি জাতিকে নিজের ধর্মের কথা বলতে দেওয়া এবং নিজস্ব উক্তির মাধ্যমে নিজ নিজ অন্তর্দৃষ্টি বা জীবনবিধানের মর্মকথা প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি। আন্তধর্মীয় সংলাপ বা মতবিনিময় পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি বড় ধরনের নিয়ামক শক্তি। এজাতীয় নৈতিক আলোচনা বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দলমত ও পথের অনুসারীদের মধ্যে বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক এবং পারস্পরিক শান্তি ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে উৎসাহ দেয়। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রকৃত কোনো অবদান রাখতে চাইলে প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বের সব মানুষ, প্রাণীকুল ও সৃষ্টিজগতের বিরোধহীন, পারস্পরিক ভাববিনিময় এবং নিরাপদ সহাবস্থানকে বিশ্বশান্তি বলা হয়। অথচ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বহুবিধ অন্তরায় বিদ্যমান। পৃথিবীব্যাপী অশান্তি, উত্তেজনা, সহিংসতা ও সংঘর্ষের চিত্র প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। মানুষ যে শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রত্যাশা করে, তা সুদূরপরাহতই রয়ে গেছে। সর্বত্র যুদ্ধবিগ্রহ আর সংগ্রাম-সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানিই পৃথিবীর বাস্তবতা। শান্তিই যেহেতু ইসলামের একমাত্র লক্ষ্য, সে কারণে ব্যক্তি বা সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা ও শান্তি ভঙ্গ করে এমন কোনো অনাচার থেকে নিজেকে
বিরত রাখাই ইসলামের সাধনা। তবে শান্তিতে বিশ্বাস করাই শেষ কথা নয়, শান্তির জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। শান্তিকে প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি রূপে পরিগণিত করতে হবে। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টির প্রয়োজনে সব ধরনের ঘৃণা, হিংসা ও বৈষম্য এবং দুর্বৃত্তায়নকে নির্মূল করে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
বিশ্বের কোথাও শান্তি ও নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র চলছে শান্তির দুর্ভিক্ষ, এরই মধ্যে কিছুটা হলেও শান্তি খুঁজে পেতে সচেষ্ট হতে হবে। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী অসংখ্য মানুষ যখন শান্তির জন্য অস্থির ও দিশেহারা, তখন অরাজকতা, নৈরাজ্য, অপরাধ গ্রাস করছে সমাজজীবন। এমনি প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক শান্তির জন্য সামাজিক সম্প্রীতি। শান্তির সপক্ষে আন্দোলন হতে হবে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, রাজনৈতিক মঞ্চে, অর্থনৈতিক ফোরামে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, সব ধর্মের মানুষের চিন্তা-চেতনায় শান্তির বার্তাকে আন্দোলিত করতে হবে। ‘শান্তিই মানুষের সৌভাগ্যের একমাত্র অবলম্বন’ এই বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে হবে। বিশ্বে শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে জর্জ বার্নার্ড শ যথার্থই বলেছেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসত বহু বাঞ্ছিত শান্তি ও সুখ।’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহযোগী অধ্যাপক
source-prothom alo

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট