মাদকদ্রব্য সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল

মাদকদ্রব্য সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল

মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
*****************************

সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলায় দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের কুপ্রচারণা, অসৎ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ-সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার মূল কারণ। পারিবারিক বন্ধন ও ইসলামি মূল্যবোধ কম, এমন পরিবারের সদস্যরা অতি সামান্য কারণে মাদকদ্রব্যে অধিকতর আসক্ত হচ্ছে। নেশা মানুষের জীবনীশক্তি বিনষ্ট করে—এটা জেনেশুনেও মাদকাসক্তরা নেশার অন্ধকার জগতের মধ্যে থাকতে চায়। কিন্তু প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মুসলমান লোকেরা তো সর্বনাশা মাদকদ্রব্যের নেশায় মেতে উঠতে পারে না। কেননা হাদিস শরিফে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হয়েছে যে ‘মাদক ও ইমান একত্র হতে পারে না।’ (নাসাঈ)
অথচ সমাজের বহু মেধাবী এবং সম্ভাবনাময় প্রতিভা মাদকের নেশার কবলে পড়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের পথ প্রদক্ষিণ করছে। সব ধরনের অপকর্ম, অশ্লীলতা থেকে একপর্যায়ে নীল ছবি তৈরি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে শুরু করে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়দের লাঞ্ছিতসহ নেশার টাকা সংগ্রহের প্রয়োজনে তাঁদের খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করছে না। যেহেতু মাদকাসক্তি ও নেশাজাতীয় দ্রব্য মানবসমাজের জন্য মারাত্মক সর্বনাশ ও চিরতরে ধ্বংস ডেকে আনে, তাই ইসলামি শরিয়ত মাদকদ্রব্যকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে। পবিত্র কোরআনে মাদক সেবনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা প্রকাশ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওহে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ণায়ক তির হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি। সুতরাং তোমরা এসব বর্জন করো—যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা-আল মায়িদা, আয়াত-৯০)
মাদক হলো এমন এক প্রকার অবৈধ ও বর্জনীয় বস্তু, যা গ্রহণ বা সেবন করলে আসক্ত ব্যক্তির এক বা একাধিক কার্যকলাপের অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটতে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তাই যেকোনো ধরনের পাপাচার ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বিবেক বাধা দেয় না। মিথ্যা কথা বলা তাদের স্বাভাবিক বিষয়। কোনো ধরনের অপরাধবোধ তাদের স্পর্শ করে না। ধর্মের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। ভালোবাসা কিংবা স্নেহ-মমতাও তাদের স্পর্শ করতে পারে না। মাদক সেবনকারীর দেহমন, চেতনা, মনন, প্রেষণা, আবেগ, বিচারবুদ্ধি সবই মাদকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জীবনের ঠিকানা হয় ধ্বংসের সীমানায়। তাই নেশা ও মাদকাসক্তির ভয়াবহতা থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্যই মাদক, আর যাবতীয় মাদকই হারাম।’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘যেসব পানীয়তে নেশা সৃষ্টি হয় তা সবই হারাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মাদকাসক্তরা শুধু নিজেদের মেধা এবং জীবনীশক্তিই ধ্বংস করছে না, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত করছে নানাভাবে। যেসব পরিবারের সদস্য নেশাগ্রস্ত হয়েছে, সেসব পরিবারের দুর্দশা অন্তহীন। জীবনবিধ্বংসী মরণনেশার কবলে পড়ে অসংখ্য তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন নিঃশেষিত হচ্ছে। মাদকাসক্তি আসলে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির বিবেক-বুদ্ধি, বিচারক্ষমতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ সবকিছুকে খেয়ে ফেলে। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব অনিষ্টকারিতা ও অপকর্ম গুরুতর মহাপাপ। মাদকাসক্তি মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে রাখে এবং সামাজিক অনাচারে লিপ্ত করে। এতে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়, তবুও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৯১)
জনগণের সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে মাদকাসক্তির মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার করা সম্ভব। যার যার ঘরে পিতা-মাতা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাড়া-মহল্লা বা এলাকায় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘৃণা প্রকাশের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদকদ্রব্যের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় বিধিবিধান-সম্পর্কিত শিক্ষামূলক ক্লাস নিতে হবে। মাদকদ্রব্য উৎপাদন, চোরাচালান, ব্যবহার, বিক্রয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও কঠোর বিধান কার্যকর নিশ্চিত করতে হবে।
মাদক নিরাময়ে চাই পরিবারের আন্তরিকতা ও পারস্পরিক ভালোবাসা। ধর্মভীরু পরিবারের পিতা-মাতাই সন্তানকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারেন। পিতা-মাতারা যদি তাঁদের কর্মব্যস্ত সময়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ নিজেদের সন্তানের জন্য বরাদ্দ রাখেন, তাদেরকে ইসলামি বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেন, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করেন, তাদের জীবনের জটিল সমস্যাবলি সমাধানে সচেতন ও মনোযোগী হন, তাহলেই যুবসমাজে মাদকাসক্তির প্রতিরোধ বহুলাংশে সম্ভব। অভিভাবক ও মুরব্বিদের নিয়ে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মাদক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করলে দেশ মাদকমুক্ত হবে নিঃসন্দেহে। মাদকাসক্তি ত্যাগে আসক্তদের উৎসাহিত ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে দেশের তিন লাখ মসজিদের ইমাম বা ধর্মীয় নেতাদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত।
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবন থেকে মাদকদ্রব্যকে উৎখাত এবং মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির মধ্যে গণসচেতনতা জাগাতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ ও আন্দোলন, তার সূতিকাগার হবে পরিবার। প্রতিটি পরিবারপ্রধানকে সন্তানদের অসৎ বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় রোধে পারিবারিক অনুশাসন, নৈতিক মূল্যবোধ ও সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান:source-prothom-alo

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট