সীমা লঙ্ঘন নয়

সীমা লঙ্ঘন নয়

**************************মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান


‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বাক্শক্তিসম্পন্ন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, আত্মমর্যাদাবোধ ও সজাগ-সচেতনতা রয়েছে। তাদের মস্তিষ্কে নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের চিন্তাভাবনা, মেধা-মননশীলতা ও উন্নত গবেষণা রয়েছে। জগতের সবকিছু মানুষের উপকারার্থে বিদ্যমান। মহাকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহর অনুগ্রহ পরিবেষ্টিত সবই মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে ভাব প্রকাশ করতে (ভাষা) শিখিয়েছেন। সূর্য ও চন্দ্র নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তিত হয়। তৃণলতা ও বৃক্ষাদি তাঁরই বিধান মেনে চলে। তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ভারসাম্য বা সীমা লঙ্ঘন না করো।’ (সূরা আর রাহমান, আয়াত: ১-৮)
আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ অভিপ্রায়ে সৃষ্টি করেছেন, যেন তারা পরস্পরের কল্যাণকামী বন্ধু এবং পরোপকারী হয়, মানবসেবা ও সৃষ্টিকুলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। জগতে মানুষ মানুষের জন্য। মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতা, ঐক্য ও সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ থাকে, তখন দুনিয়াটা শান্তির পরশে আলোকিত ও উজ্জ্বলতর হতে থাকে। অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও সীমা লঙ্ঘনকে কেউ পছন্দ করে না। এ মানুষই যখন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনারহিত হয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত, হানাহানি ও আত্মঘাতী অপকর্মে নিয়োজিত হয়ে বাড়াবাড়ি বা সীমা লঙ্ঘন করে এবং মানুষের ক্ষতিকারক দেশের মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করে, লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়, তখন পৃথিবীটা শান্তিতে বসবাস করার অযোগ্য ও বিষময় হয়ে পড়ে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সাবধান করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে মানুষের উপকার করে।’
মানুষের মধ্যে যারা কাজেকর্মে সৎ হবে, তাদের জন্য রয়েছে অঢেল পুরস্কার এবং যারা কাজেকর্মে অসৎ হবে, তাদের জন্য থাকছে তিরস্কার। সৎকর্মের পরিচয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সংসারজীবনের সব কাজেকর্মে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া। যেমন: লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্যে মিথ্যা কথা না বলা, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল না দেওয়া, প্রতারণা না করা, চাকরিজীবনে ঘুষ-দুর্নীতি তথা উৎকোচ গ্রহণ না করা, নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করা এবং দেশ-জাতির কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন না করা। অথচ আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক বিধানকে লঙ্ঘন করে প্রায়ই মানুষ নির্বিচারে জাতীয় মহামূল্যবান ভূসম্পদ গাছপালা, বৃক্ষলতা, বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে চলেছে।
যাদের সীমা লঙ্ঘনের কারণে দুনিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, অশান্তি-বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও অসহায় লোকের মৃত্যুর কারণ হয় এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, এরা সবাই জালিম, নিরীহ মানুষের প্রতি অত্যাচারী। দেশের জনগণ হলো মজলুম বা অত্যাচারিত। জালিম শাসকের জুলুম আল্লাহ তাআলা সহ্য করেন না। মানুষের বড় ধরনের গুনাহের কারণেই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে।
তাই যে ব্যক্তি কোনো বড় ধরনের অন্যায় বা কবিরা গুনাহ করে, সে সারা বিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশু-পাখিদের প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গুনাহের কারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য যে বিপদ-আপদ দুনিয়ায় নেমে আসে, এতে সব প্রাণীই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কিয়ামতের দিন এরা সবাই গুনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে ঘোষিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ আচরণ বা সীমা লঙ্ঘন করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আল-শুরা, আয়াত: ৪২)
সারা বিশ্বই অন্যায়-অপরাধ ও দুর্নীতিতে কমবেশি নিমজ্জিত। ফলে জগতের সর্বত্রই কোনো না কোনো ধরনের বিপর্যয় ও দুর্যোগ সমাগত। কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত, সংঘর্ষ-হানাহানি, কোথাও বন্যা-জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় বা ভূমিধস ও মঙ্গা-খরাপীড়িত। কোথাও রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের কারণে দেশের মানুষ অকল্পনীয়ভাবে বিপর্যয়ের মাধ্যমে দুর্দশাগ্রস্ত।
আল্লাহ তাআলার বর্ণিত বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার জন্য যেসব কারণ আছে, এসবই সমাজে বিদ্যমান। অসৎ লোকেরা দেশকে সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে কেউ পাহাড় কেটেছে, কেউ বনজ সম্পদ বা গাছপালা নষ্ট করেছে, কেউ ক্ষমতার জোরে দেশের অর্থকড়ি লুটপাট করেছে, কেউ প্রতারক ব্যবসায়ী হয়ে জনগণকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পৌঁছিয়েছে; কেউ পেশাজীবী হয়েও দুর্নীতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। তাদের কারণে দেশের মানুষ হতাশাগ্রস্ত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি নিরাশাগ্রস্ত।
তাই মানুষ যেন আর সীমা লঙ্ঘন না করে, তাহলে দুষ্কর্মের গজব থেকে আল্লাহর মেহেরবানিতে মুক্তি পেতে পারে। যার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরম করুণাময়ের দরবারে দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি, নিরাপত্তা, সমঝোতা ও শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহযোগী অধ্যাপক
source-prothom-alo

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট