লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

***************************************
মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
*****************************

লোভ-লালসা মানুষের অন্তরের মারাত্মক ব্যাধি। সীমাহীন লোভ-লালসা মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে ঠেলে দেয়। তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে তাকে দুর্নীতি ও পাপের পথে পরিচালিত করে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ঘুষ-দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অপহরণ, গুম, খুনখারাবিসহ অধিকাংশ সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) লোভ-লালসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছেন, ‘তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এ জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’ (মুসলিম)
যদি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পরও মানুষের মনে তৃপ্তি না আসে, তাহলে বুঝতে হবে যে তার মনে লোভ বাসা বেঁধেছে। লোভী ব্যক্তি নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না। হাতে যা আছে তাতে সুখী না থেকে অন্যায়ভাবে আরও বেশি কিছু পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও অন্যের বস্তু আত্মসাৎ করার প্রবণতা ইসলামসম্মত নয়। লোভাতুর দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির জীবনে কখনো শান্তি আসতে পারে না। লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ ধর্ম-কর্ম ভুলে নিজের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। লোভ-লালসা মানুষকে অন্ধ করে তার বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য বিচারের ক্ষমতা নির্মূল করে ফেলে। তাই লোভ মানুষের চরম শত্রু, জীবনের বিনাশ সাধনই এর কাজ।
লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতেই হবে, নইলে মানুষের নৈতিকতার বিকাশ, সৎ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না। দুর্নীতিবাজ লোভাতুর ব্যক্তি কখনো পরোপকার বা জনকল্যাণকর কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় না। লোভ-লালসা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন অর্থ-সম্পদ, মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, প্রসিদ্ধি ও সুখ্যাতি লাভের প্রবল লোভ মানব চরিত্র গঠন ও সংশোধনের পথে বিরাট অন্তরায়। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩২)
ধর্মপ্রাণ মুমিন বান্দা কখনো অন্যের সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় না। ধন-সম্পদ আহরণ দোষের হয় তখন, যখন অন্যের সম্পদের ওপর লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার চেষ্টা চালানো হয়। খ্যাতি-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদের মোহ সমাজজীবনে সব অনিষ্টের মূল। প্রকৃতপক্ষে ধন-সম্পদের লিপ্সা ও খ্যাতির প্রতি অতিশয় মোহ নিতান্তই ক্ষতিকারক। নবী করিম (সা.) উপমাসহকারে বলেছেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে যে রকম ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সম্মান লিপ্সা ও সম্পদের লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।’ (তিরমিজি)
এ জন্য মানুষের মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি, হিংসা-বিদ্বেষসহ নানা প্রকার মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কলহ-বিবাদ, হানাহানি এমনকি পর্যায়ক্রমে তা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণ, গুম, খুনখারাবির কারণ হয়ে যায়। ধনসম্পদের লোভ-লালসা ও আত্মসাৎপ্রবণতা মানুষের মন্দ স্বভাবের মধ্যে একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার। লোভী অন্যের ধনসম্পদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার হীন অপপ্রয়াস চালায়। পবিত্র কোরআনে এমন জঘন্য লোভ-লালসাকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার চক্ষুদ্বয় কখনো প্রসারিত করো না তার প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, এর দ্বারা তাদের পরীক্ষা করার জন্য; তোমার প্রতিপালকের প্রদত্ত জীবনোপকরণ উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৩১)
ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কখনো লোভাতুর দৃষ্টিতে পার্থিব ভোগ উপকরণসমূহকে দেখতে পারে না। ইহকালীন ভোগ-সামগ্রীকে লালসার দৃষ্টিতে দেখার স্বভাব মুমিন ব্যক্তির নয়। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ধনসম্পদ, মানসম্মান, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি লোভ দ্বীন ইসলাম ও ইমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাসুলুল্লাহ (সা.) লোভ-লালসাকে দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ বলে উল্লে­খ করে বলেছেন, ‘ইমান ও লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না। এর কারণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কেননা, ইমানের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা ও অল্পে তুষ্ট থাকা। আর লোভ-লালসার পরিণাম হচ্ছে অশান্তি, ধৈর্যহীনতা ও অস্বস্তিবোধ।’ (নাসাঈ ও তিরমিজি)
লোভের বশবর্তী হয়ে জোরপূর্বক কর্তৃত্ব গ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য কলহ-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। বিবেকবান ধর্মভীরু মানুষ জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র রাখার জন্য লোভ-লালসা বর্জন করে চলেন। যে ব্যক্তি লোভ জয় করতে পারে না, সে তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য অন্যায় ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করার ফলে অপহরণ, গুম, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। লোভী ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির নিজের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং দুর্নীতির পরিণাম সম্পর্কেও সে চিন্তাভাবনা করে না। ফলে অতিশয় লোভের পরিণতিতে সে বিপদগ্রস্ত হয় এবং তার জীবনে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই বলা হয়ে থাকে, ‘লোভী বঞ্চিত।’ যেহেতু লোভ মানুষের সব দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল উৎস, তাই ইহলৌকিক ও পরকালীন জীবনে সাফল্যের জন্য লোভ-লালসার কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। মানুষকে সৎ চরিত্রবান হতে হলে, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হলে ও আদর্শ সুশীল সমাজ গড়তে হলে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমানের উচিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে লোভ-লালসা বর্জন করে দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপনে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার অনুশীলন করা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
source-prothom alo

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট