পরহেজগার একজন ব্যক্তি

পরহেজগার একজন ব্যক্তি

ইরাকের কুফা শহরে একজন যুবক সাধক বাস করতেন। আকার-আকৃতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন একজন যুবক এবং স্বভাব চরিত্রও ছিল তার অত্যন্ত সুন্দর। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার একজন ব্যক্তি। ঐ শহরেই বাস করতো একজন রূপবতী, সুন্দরী এবং জ্ঞানবতী নারী। সে একদিন ঐ যুবককে দেখেই তার প্রেমে পড়ে যায়। এভাবে মেয়েটি কিছুকাল চুপ থাকে। অবশেষে ধৈর্যধারণ করতে না পেরে একদিন মেয়েটি সেই যুবকের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার উদ্দেশ্য ছিল, যুবকটির পেছনে পেছনে গিয়ে তার বাড়িটি চিনে নেওয়া। কিন্তু যুবকটি সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে যখন মেয়েটির কাছাকাছি এলো, তখন মেয়েটি ছেলেটির সৌন্দর্য দেখে চুপ থাকার ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। মেয়েটি বলে উঠল, ওহে যুবক! আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, শোনার পর তোমার যা ইচ্ছা হয় করো। কিন্তু যুবকটি মেয়েটির সাথে কোন কথা না বলে চলে গেল। এরপর পুনরায় একদিন মেয়েটি সেই যুবকের পথে গিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ওহে যুবক! আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, দয়াকরে শোণ। যুবকটি তখন তার মাথা নিচু করে নিয়ে বললঃ এটা হল অপবাদের জায়গা। আমি অপবাদের পাত্র হতে ভয় পাই। মেয়েটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি তোমার ব্যাপারে ভালোরকম জানি, আমি এমনি এমনি তোমার রাস্তায় এসে দাঁড়াইনি। আমার মতো মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো থেকে আল্লাহ তার নেক বান্দাদের রক্ষা করুক। আল্লাহর কসম, তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার অন্তর ছাড়া অন্য কেউ আমাকে বাধ্য করেনি। আমি জানি, এই মামুলি সম্পর্কও লোকের কাছে যথেষ্ট খারাপ। তুমি ভালো মানুষ, আয়নার মতো স্বচ্ছ। যাকে সামান্যতম ক্রুটিও দাগ লাগিয়ে দেয়। যাইহোক, আমি তোমাকে যা কিছু বলতে চাই তার সারকথা হলো এই যে, আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তোমার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু হায়! আমি কোথায়, আর তুমি কোথায়! এরপর যুবকটি মেয়েটির আর কোন কথা না শুনে চুপকরে বাড়িতে গিয়ে নামাযের জন্য দাঁড়ালো, কিন্তু নামাযে তার কিছুতেই মন বসাতে পারলো না। তাই সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে একটি কাগজে কিছু কথা লিখে বাড়ি থেকে বের হলো। মেয়েটি তখনো রাস্তার সেই জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। সেখানে গিয়ে যুবকটি মেয়েটির দিকে কাগজটি ছুঁড়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল। আর মেয়েটি কাগজটি নিয়ে খুব খুশি মনে বাড়ি চলে এলো এবং কাগজটি খুব যত্নের সাথে খুলে পড়তে শুরু করলো। কাগজটিতে লিখা ছিল......। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। হে নারী, জেনে রেখো যখন আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপ করা হয়, তখন তিনি ধৈর্যধারণ করেন। পুনরায় যখন দ্বিতীয়বার পাপ করা হয়, তখনও তিনি আল্লাহ তায়ালা তা গোপন রাখেন; কিন্তু কেউ যখন পাপ কাজ করতে করতে, পাপ কাজে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ তার উপর এত বেশি অসন্তুষ্ট হয়ে জান যে, তার সেই অসন্তোষকে আসমান, জমিন, পাহাড়, পর্বত, গাছপালা এমনকি জন্তু-জানোয়ার পর্যন্ত কেউই আর বরদাশত করতে পারে না। সুতরাং কোন মানুষের মধ্যে এমন কি ক্ষমতা আছে যে, সে তা বরদাশত করবে? সুতরাং তুমি যা কিছু বলেছ, সেসব যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমি তোমাকে সেই দীনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যেদিন আকাশ গলে পড়বে, পাহাড়-পর্বত তুলার মতো টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে থাকবে এবং সমস্ত সৃষ্টি জগৎ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে অবনত হবে। আল্লাহর কসম! আমি নিজের আত্মসংশোধনে দুর্বল হয়ে পড়েছি, তো অন্যের সংশোধন আমি কীভাবে করতে পারি! আর তুমি যা কিছু বলেছ, সেসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমি তোমাকে এমন এক চিকিৎসকের সন্ধান দিচ্ছি, যিনি মারাত্মক ক্ষত, আঘাত ও যন্ত্রণা সারানোর পক্ষে অধিকতম যোগ্য। আর তিনি হলেন বিশ্বজগতের প্রতিপালক অনন্ত মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তা। তুমি খাটি মনে তার সামনে হাজিরা দাও। আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক করতে ইচ্ছুক নই আল্লাহর এই নির্দেশের কারনে। মহান আল্লাহ নির্দেশ করেছেন যে, "(হে নবী) আপনি মানুষকে এক আসন্ন বিপর্যয়ের দিন (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন) সম্পর্কে সতর্ক করুন। যেদিন কলিজা মুখে উঠে আসবে তথা প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। ঐ দিন জালিমদের না কোন অভিভাবক থাকবে আর না এমন কোন সুপারিশকারী থাকবে যার কথা মানা হবে। আর আল্লাহ চোখের অপব্যবহার সম্পর্কে অবগত এবং তাও অবগত যা থাকে অন্তরের মধ্যে লুকায়িত (যা অন্যরা জানে না অর্থাৎ তিনি বান্দা-বান্দীদের সকল গোপন-প্রকাশ্য কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত)। (সুরা গফির/মুমিনঃ ৪০ঃ ১৮-১৯) সুতরাং তুমি চিন্তা করে দেখো, এই আয়াত থেকে কোথায় পালানো যেতে পারে? এরপর মেয়েটি কিছুদিন চুপ থেকে, আবার একদিন এসে ঐ যুবকটির রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো। যুবকটি আসার সময় দূর থেকে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, না এসে নিজের ঘরের দিকে ফিরে চলল, যাতে তার সাথে সাক্ষাৎ না হয়। মেয়েটি তাকে ফিরে যেতে দেখে বলতে লাগলো, ওহে যুবক! দয়া করে তুমি ফিরে যেও না, এরপর আর কখনো আমাদের সাক্ষাৎ হবে না। কেবল আল্লাহর সামনে সাক্ষাৎ হওয়ার দিনটি ছাড়া। এভাবে মেয়েটি অনেক কান্নাকাটি করলো এবং কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, আমি সেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি যার নিয়ন্ত্রণে তোমার অন্তঃকরণ। আমার পক্ষে যা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা তিনি সহজ করে দিন। এরপর মেয়েটি যুবকটির পেছনে গিয়ে বলল, আমাকে তোমার পক্ষ থেকে কিছু উপদেশ দিয়ে আমার উপকার করে যাও, যে উপদেশ আমি পালন করে চলব। যুবকটি তখন বলল, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, নিজের মনের অবৈধ কামনা-বাসনা থেকে তুমি সাবধান থাকবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন, "যে নিজের মনের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে, তার উদাহরণ তো হচ্ছে কুকুরের মতো। (সুরা আরাফঃ ১৭৬)। আর তুমি দুনিয়াকে এমনভাবে তৈরি করো, যাতে তুমি নিজের কামনা-বাসনা পূর্ণ না করার রোযা রেখেছ এবং তার ইফতারী করবে মৃত্যু দিয়ে। আর তুমি নিজের মৃত্যুর কথা এবং ইতিমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কথা বেশি বেশি স্মরণ করবে। তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নিজের কোন কুকর্ম মুছে দিত পেরেছে, আর না এমন কেউ আছে যে তার কোন সুকর্ম বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমি-তুমি তো এখনো জীবিত, তাই আমাদের জন্য তো এখনো তওবার মাধ্যমে আমাদের কুকর্মকে মুছে ফেলার এবং সুকর্ম করে সুকর্ম বাড়ানোরও সুযোগ রয়েছে। সুতরাং তুমি এই সুযোগকে হাতছাড়া করো না। মনে রেখো, আল্লাহর কাছে পাপ পরিত্যাগ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় কোন ইবাদত নেই। আর তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি তোমার নিজের ও তোমার কামনা-বাসনার মধ্যে লোহার প্রাচীর দাঁড় করাতে না পারবে। সব শেষে তোমাকে একটি আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, "হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। (সুরা লুকমানঃ ৩৩) মেয়েটি তখন তার ভুল বুঝতে পেরে মাথা নত করে নিল এবং আল্লাহর ভয়ে আগের থেকেও বেশি কান্না করতে করতে তার নিজের বাড়িতে চলে গেলো। আল্লাহর কাছে খাটি তওবা করে অনন্ত মহান আল্লাহর ইবাদত-আরাধনা শুরু করে দিল। এভাবে ইবাদত করতে করতে সে এমন আবেদা হয়ে গেলো যে, নিয়মিত রাতে উঠে সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ হেদায়েত দাণ করুক। আমিন...। রেফারেন্সঃ- যাম্মুল হাওয়া লেখকঃ আল্লামা ইবনুল জাওযীর (রহঃ) বাংলা অনুবাদকৃত বইয়ের পৃষ্ঠাঃ (৯৪-৯৭)

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট