ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ

 


অনেক সময় আমরা বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ি আর এসব কাজের দীর্ঘ মেয়াদি ফল নিয়ে চিন্তা করি না। আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৮২ নাম্বার আয়াতে বলেন - ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ - "এ হল তারই প্রতিফল যা তোমরা ইতিপূর্বে নিজের হাতে পাঠিয়েছ।"

এই আয়াত আমাদেরকে যে দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখা শেখাচ্ছে তা হল: প্রতিটি শব্দ যে আমি উচ্চারণ করি, আমার করা প্রতিটি কাজ, আমার প্রতিটি অভিজ্ঞতা, যা কিছু আমি খরচ করি, যা কিছু আমি উপভোগ করি, যে মজা আমি এখন উপভোগ করি, যে মজা থেকে আমি এখন বিরত থাকি - এই সবকিছুর ভবিষ্যতে ফলাফল আছে। সবকিছুর। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যদি ছোট্ট একটি ইটের টুকরা নিয়ে পানিতে নিক্ষেপ করেন, কী হয়? পানিতে ছোট ছোট ঢেউ দেখা যায়। প্রতিটি নুড়ি পাথরের ঢেউ আছে, প্রতিটি শব্দের ঢেউ আছে, প্রতিটি দয়ার ঢেউ আছে, প্রতিটি অপমানকর কথার ঢেউ আছে, প্রতিটি মূর্খতার ঢেউ আছে, প্রতিটি পাপের ঢেউ আছে, প্রতিটি ভালো কাজের ঢেউ আছে। আমাদের করা প্রতিটি কাজের ঢেউ আছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা ইয়াসিনে বলেছেন - " ওয়া নাকতুবু মা কাদ্দামু ওয়া আ-সারাহুম" - আমি লিখে রাখছি তারা যা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করেছে, এবং যে চিহ্ন-রেখা তারা পেছনে রেখে গেছে। (ভাবানুবাদ) কারণ, আমরা যা কিছুই করি না কেন তা আমাদের ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে। তাই না? হ্যাঁ। কিন্তু আবার আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের চলা পথটাই দেখবে। আমাদের কাজ অন্যদেরও প্রভাবিত করে। আমরা আমাদের পেছনে একটা লাইন রেখে যাচ্ছি। এই আয়াতে যে একটি অসাধারন দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো হচ্ছে, আমরা যা কিছুই করি না কেন তা আসলে একটি বিনিয়োগ। আর আমরা মুসলিম হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা করি। প্রথমে পার্থিব একটি উদাহরণ দিচ্ছি, পরে দীন নিয়ে কথা বলবো। কলেজ জীবনে দেখেছি... আর আপনারাও ছাত্র জীবনে দেখে থাকবেন - কিছু কিছু ছাত্র পড়া লেখা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত থাকে। আর আরেকদল আছে যারা শুধু আড্ডাবাজি করে বেড়ায়। স্কুল-কলেজ জীবনে শুধু আনন্দ স্ফূর্তি আর আড্ডাবাজিতে কেটে যায় তাদের সময়। প্রতিটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়, ক্লাস ফাঁকি দেয়....কলেজ জীবনে সে তার জীবনের সেরা সময় কাটায়। আবার একই কলেজ বা ভার্সিটিতে অনেক ছাত্রকে পাবেন যারা অধ্যয়ন নিয়ে দারুন ব্যস্ত। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো মিস করছে, আড্ডা দেয়া মিস করছে, আনন্দ স্ফুর্তির প্রচুর সুযোগ তারা ছেড়ে দিচ্ছে। তারা শুধু পড়ছে, পড়ছে আর পড়ছে। তাদের মাথায় একটা লক্ষ্য আছে। আর তাদের বন্ধুরা যারা আড্ডা দিতে যাচ্ছে, কনসার্টে যাচ্ছে, খেলা দেখতে যাচ্ছে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে - "কিরে তোর কি কোনো জীবন নেই? এই সুযোগ তো আর কোনোদিন ফিরে পাবি না। এটাই তোর জীবনের সেরা সময়।" কিন্তু তারা বোঝে না যে, আড্ডা দেওয়া ছেলেগুলো বর্তমান উপভোগ করার জন্য বাঁচে। আর পড়ুয়া ঐ ছেলেটি বা মেয়েটি কিসের জন্য বাঁচে? ভবিষ্যতের জন্য। এই ছেলেরা সেমিস্টার মিস করে, পিতা-মাতার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট হারিয়ে ফেলে, কোনোমতে পাশ করে অথবা কলেজ-ভার্সিটি শেষ করতে পারে না। এখন এরা কোনো মুদি দোকানে বা কোনো গ্যাস স্টেশনে চাকরি করে। আমি বলছি না যে এই চাকরিগুলো খারাপ। কিন্তু, তুমি যখন জীবনে ভালো কিছু করার সুযোগ পেয়েছ আর তুমি তা নষ্ট করে ফেলেছো, তখন এই চাকরিগুলো সমস্যাজনক। তারা জীবনে ভালো কিছু করতে পারতো কিন্তু সুযোগ নষ্ট করে ফেলল। যারা জীবনে এইরকম কোনো সুযোগ পায়নি তাদের কথা ভিন্ন। তারা আর এরা এক নয়। অন্যদিকে, যে ছাত্রগুলো আনন্দ-স্ফূর্তির সুযোগ ইচ্ছা করেই পরিত্যাগ করেছিল, যে মজা করতে পারতো তা ছেড়ে দিয়েছিল...কারণ, তারা তাদের সময়কে দেখেছে একটি বিনিয়োগ হিসেবে। তারা দেখেছে বিরক্তিকর পড়া-লেখাকে বিনিয়োগ হিসেবে। ঘুম ত্যাগ করে রাতে উঠে অতিরিক্ত অধ্যয়ন করাকে তারা বিনিয়োগ হিসেবে দেখেছে। আর ভবিষ্যত জীবনে তারা এর রেজাল্ট পেয়েছে। এখন, তারা উন্নত জীবন-যাপন করছে। তারা এখন অধিক সুখী। এইসব কিছু পার্থিব সেন্সে, তাই না? যে ধারণাটি আমাদের মনে গেঁথে নিতে হবে - আমাদের করা প্রতিটি কাজের ঢেউয়ের মত চলমান প্রভাব আছে। যে সিদ্ধান্তগুলো আমরা নিয়ে থাকি, পরিণামে এগুলো আরো অন্য অনেক সিন্ধান্তের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। জীবনের সামনে কিছু কিছু দরজা খুলে যাবে আমাদের কাজের পছন্দ-অপছন্দের কারণে। আর কিছু কিছু দরজা বন্ধ থাকবে আমাদের কাজের পছন্দ-অপছন্দের কারণে। এটাই হলো - ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ - "এ হল তারই প্রতিফল যা তোমরা ইতিপূর্বে নিজের হাতে পাঠিয়েছ।" (৩:১৮২) এখন, দীনের দৃষ্টিতে ভেবে দেখি। একজন মুসলিম হিসেবে আমরা শুধু ভবিষৎ জীবনের দশ বছর, বিশ বছর নিয়ে চিন্তা করি না। একজন মুসলিম চিন্তা করে - "এই বিনিয়োগটা হলো যখন আমাকে কবর দেওয়া হবে সেই সময়ের জন্য। যখন ফেরেশতারা এসে আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে। আমার এই বিনিয়োগটা কি সেই ভবিষ্যতে সাহায্য করবে? আমাকে যেদিন কবর থেকে উঠানো হবে, সবাই যখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় চরম আতংকিত থাকবে, এই বিনিয়োগটা কি সেইদিন আমাকে কিছুটা নিরাপত্তা পেতে সাহায্য করবে? কারণ, সেইদিন সবাই দেওলিয়া থাকবে একমাত্র তারা ছাড়া যারা তাদের প্রচেষ্টাগুলো নিয়ে হাজির হবে। আমি কি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি? আল্লাহর জন্য আমি কি আমার প্রচেষ্টার বিনিয়োগ করেছি?" এভাবে এই ধারণা আমাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থাৎ এমনকি পরবর্তী জীবন নিয়েও চিন্তাশীল হিসেবে গড়ে তোলে। একইসাথে আমরা এই দুনিয়ার ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা করি। -- নোমান আলী খানের আলোচনা অবলম্বনে। -- Surah Al Imran Aayah 182 -- Bayyinah tv

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে