খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ)----2

 ওয়ারাকা খাদিজা (রাঃ) কে অনেক কাজে সাহায্য করেন।


খাদিজা (রাঃ) শুধু সম্পদশালী ভালো ব্যবসায়ী নয় তিনি সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজেই উদাহরন্ত। বিশেষত আরব নিজের স্ত্রী গর্ভে কন্যা সন্তান জন্মের সংবাদ শুনলে নবজাতককে আতুঁরঘরে হত্যা করে ফেলে কিংবা কিছুদিন পর শিশু অবস্থায় তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে। আরবে কন্যাসন্তান হত্যার এই প্রবণতার পেছনে অন্য অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণ মূলত গােত্রীয় কৌলিন্য রক্ষা। গােত্রীয় লােকজন মনে করে, কন্যাসন্তান জন্ম নিলে একসময় এ মেয়েকে অন্য গােত্রের লােকজন বিয়ে করে তাদের শয্যাসঙ্গী করবে। এটা তাদের জন্য অপমানজনক। তেমনি তারা মনে করে, কন্যাসন্তান মানে একধরনের বােঝা। তারা যুদ্ধ করতে পারেনা, গােত্রের সম্মান রক্ষায় লড়াইয়ে অংশ নিতে পারে না, জীবিকা উপার্জনে। সক্ষম নয়। সন্তান জন্মদান ছাড়া তাদের আর কোনাে সক্ষমতা নেই। এসব কারণে কন্যাসন্তান জন্মকে আরবের লােকজন অপয়া মনে করে। ফলে জন্মের পর বা শিশু বয়সে তাদের হত্যা করা একটা কুপ্রথায় পরিণত হয়েছে। মক্কা ও আশপাশের অঞ্চলে এমন ঘটনা অহরহ ঘটত তখন। খাদিজা (রাঃ) এমন নির্দয় পিতার ঘরে কন্যাশিশু জন্মের সংবাদ পেলে লােক পাঠিয়ে সে কন্যাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং তাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। শুধু প্রতিপালন নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হলে তিনি তাদের যােগ্য ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেন। আর এসব কাজে তাঁকে অকুণ্ঠ সহযােগিতা করেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেল। আরবের নারীমুক্তিতে খাদিজা (রাঃ) এমন সাহসী পদক্ষেপকে ওয়ারাকা বরাবর সমর্থন দিয়ে আসছেন। মক্কার কুরাইশনেতাদের ভ্রুকুটি থেকে নিজের বােনকে সযত্নে সুরক্ষা করেন তিনি। পণ্ডিত ব্যক্তি বলে পারতপক্ষে তার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস করে না কেউ। খাদিজা ওয়ারাকার কাছে এসে আসলেন এবং সেই বৃদ্ধার সকল কথাগুলো খুলে বললেন। ওয়ারাকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটির বিবরন, আদ্যোপান্ত জানতে লাগলেন খাদিজা (রা) থেকে। সবকিছু শুনে কিছুক্ষন দৃষ্টির চোখ নিচু করে নিরব হয়ে রইলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন নবী আসবেন, খুব শিগগির আসবেন। নবী আগমনের সকল নিদর্শন প্রকাশ হতে শুরু করেছে। পাপে ছেয়ে গেছে ধরণীতল, মানুষ নিজে নিজেদের দেবতা সেজে বসেছে, মূর্তি পূজা করছে। এই অন্ধকার কালিমা ভেদ করে খুব শীঘ্রই আলোকবর্তিতা হাতে নিয়ে নবীর আগমন ঘটবে। তিনি আসবেন, এই আরবেই আসবেন। আমি তাঁর বিষয়ে গভীর ভাবে কিছু বলতে পারবোনা। সবকিছু জানার জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তাঁর নাম হবে আহমাদ। তিনি এই নামেই সবার কাছে পরিচিত হবেন। খাদিজা (রাঃ) এর হৃদয় আনচান করে ওঠে। তার হৃৎপিন্ড কথা বলে উঠে অন্য কেউ। অনাগত এক মানুষের জন্য তার হৃদয় থেকে কেন অযথাই উথলে ওঠে প্রেমের সরোবর? আজকাল খাদিজা (রাঃ) এর ঘুম খুব কম হয়। রাতে স্বস্তিতে ঘুমােতে পারেন না। একটু ঘুমােলে কী সব স্বপ্ন দেখেন, সে স্বপ্নের বাস্তবতা তিনি বুঝে ওঠতে পারেন না। স্বপ্নের মাঝে প্রায়ই দেখেন-আকাশ থেকে নেমে আসছে রুপালি ধবধবে আলােক বিচ্ছুরণ। সে আলাে তাঁর ঘরের ছাদ ভেদ করে আশ্রয় নিচ্ছে তাঁর সমগ্র সত্ত্বায়, তার কোলজুড়ে ছােটাছুটি করছে ঝলমলিয়ে। ঝলমল করতে করতে সে আলাে মিনারের মতাে অবয়ব নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে। ঘর থেকে সিগ্ধ শুভ্র-শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরাে মক্কা, মক্কা থেকে জাজিরাতুল আরব, আরব থেকে পুরাে কায়েনাত আলােকিত হয়ে উঠছে সে আলােকমঞ্জুরিতে। এরপর তার ঘুম ভেঙে যায়। একটু এদিক-সেদিক করে একই স্বপ্ন প্রায় দেখেন। তিনি বুঝতে পারেন না কেন বারবার একই স্বপ্ন দেখেন। মাঝেমধ্যে এমন স্বপ্ন দেখে হাঁপিয়ে ওঠেন। বিছানায় বসে একা একা ভাবেন নিজের অতীত জীবন নিয়ে। নিজের বৈধব্য নিয়ে ভাবেন অনেক সময়। বয়স ৩০ পেরিয়েছে, এরই মধ্যে দু-দুবার বিদগ্ধ স্বাদ পেয়েছেন বৈধব্যের। জীবন নিয়ে একধরনের বিতৃষ্ণ হয়ে গেছেন তিনি। বিয়ে বিষয়টির প্রতি একটা বিরাগ চলে এসেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছেন-বিয়েমুখাে আর হচ্ছেন না এ জীবনে। দ্বিতীয় স্বামী আতিক ইবনে আইয়াদ পরলােকগমন করেছেন বেশ কিছুদিন হলাে, এরই মধ্যে মক্কা এবং আশপাশের নানা গােত্র থেকে প্রতিদিন দু-একজন আসছে তাঁর কাছে বিয়ের পয়গাম নিয়ে। তিনি সবাইকে সাফ জবাব দিয়ে দিচ্ছেন, 'বিয়ের বিষয়ে আপাতত কিছু ভাবছি না। দয়া করে মাফ করবেন আমাকে।' সাধারণ পাণিপ্রার্থীদের তাে দু-এক কথায় বােঝানাে যায়, কিন্তু কোনাে গােত্রপতি বা নামজাদা ব্যক্তিদের নিয়ে বাধে বিপত্তি। তাঁরা কিছুতেই হাল ছাড়তে চান না। তা ছাড়া খাদিজার কাছে একবার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর। সেটা আবার কবুল না হলে গােত্রপতিদেরও বেশ আত্মসম্মানে লাগে আর কি। এই তাে কিছুদিন আগে মক্কার আবুল হাকাম (আবু জেহেল) বেশ ঘটা করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। আবুল হাকামের প্রস্তাব খাদিজা হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে বেশ মনঃক্ষুন্ন হন তিনি। আশপাশের লােকজনের সঙ্গে নাকি বেশ চোটপাটও দেখান এ বিষয়ে। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না খাদিজার (রাঃ) এর । মক্কার বিত্তশালী নারী তিনি। তার সম্পদের কারণে লােকজন তাকে "কুরাইশ রাজকুমারী" নামে ডাকে। ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর। সুনাম শুধু মক্কা নয়, ছড়িয়ে আছে সুদূর রােম-পারস্য, ইয়েমেন, গাসসাসিনা, হিরা ও দামেস্ক পর্যন্ত। গ্রীষ্মকালীন ব্যবসা মৌসুমে পুরাে মক্কার ব্যবসায়ীদের যে পণ্যসামগ্রী সিরিয়ায় রপ্তানি হয়, খাদিজা (রাঃ) এর একার পণ্য রপ্তানি হয় তাঁদের সমুদয় পণ্যের চেয়ে অধিক। আবার শীতকালীন মৌসুমে যখন তাঁর পণ্য ইয়েমেন অভিমুখে রওনা হয়, তখন তাঁর উটের কাফেলায় ভরে যায় মক্কার প্রান্তর । সুতরাং, এমন ধনবতী নারীকে বিয়ে করতে উৎসাহী হওয়ার কারণ সবার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু খাদিজা (রাঃ) নতুন করে বিয়ে-শাদি কিংবা ঘর-সংসারে ব্রতী হতে তেমন আগ্রহ নেই। কীভাবে আগ্রহ হবে? তাঁর স্বপ্নে যে আজকাল ধরা দিচ্ছে উর্ধ্বলােকের আলােকবিভা! কেমন করে তিনি অগ্রাহ্য করবেন এ আলাের ঝরনাধারার স্বর্গীয় সম্মােহন! চাচাতাে বােন উম্মে কিতালের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মনের মধ্যে ফুটিয়ে তুলছে বেহেশতি গুলিস্তান। চাচাতাে ভাই ওয়ারাকার প্রাজ্ঞ অনুধাবন তার মনমুকুরে যেন উদাগিত করছিল আকাক্ষার নতুন চারাগাছ। মনে দ্বিধা-সত্যিই কি তিনি আমার হবেন? যিনি আসবেন সকল তমসার জীর্ণতাকে বিদীর্ণ করে। যিনি এ মানবতাকে নতুন এক আলােয় আলোকিত করবেন। নবুওয়াতের জ্যোতিতে বিধৌত করবেন তামাম জাহান। তবে কেন আমি প্রতিদিন এমন স্বপ্ন দেখি? নিশ্চয় এর কোনাে ঐশ্বরিক ইশারা রয়েছে! এমন ভাবনায় খাদিজা আপ্লুত হন। আল্লাহ তাআলা খাদিজাকে অঘােষিত নবির জন্য প্রস্তুত করছিলেন। তার অন্তঃকরণকে তৈরি করছিলেন রাসুলের ভালােবাসার জন্য। তার হৃদয়ের সিংহাসন সজ্জিত করছিলেন নবি মুহাম্মদের (সাঃ) এর জন্য। স্বপ্নের অলৌকিক আলােক বিচ্ছুরণের কথা জানানাের জন্য খাদিজা (রাঃ) এলেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে। তার কাছে খুলে বললেন প্রতিটি স্বপ্নের আদ্যোপান্ত, যা যা দেখেন তিনি স্বপন মাঝার, যা কিছু ঘটে তার ঘুমঘােরে। ওয়ারাকার চোখের কোণে এক বিন্দু জল টলমল করে উঠল। খাদিজা (রাঃ) এর কথা শেষ হতেই তিনি দুই হাত উত্তোলিত করে উল্লাসধ্বনি করে উঠলেন, সুসংবাদ! মারহাবা, হে আমার বােন! তােমার জন্য এ এক অবশ্যম্ভাবী সুসংবাদ, খাদিজা (রাঃ) ! এ স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে তােমার জন্য এক ঐশী উপহার। এ আলাের অবয়ব খুব শিগগির আল্লাহ তােমাকে দান করবেন। সবকিছু আল্লাহই ভালাে জানেন, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করাে—এ আলাে কেবল একজন নবির হতে পারে। এ আলােক বিচ্ছুরণ একজন নবির আগমনকে ওয়ারাকার উল্লাসধ্বনি থামতে খাদিজা (রাঃ) খানিকটা কেঁপে উঠলেন। যতটা খুশি হলেন, তার চেয়ে বেশি বিহ্বল হলেন। চাচাতাে ভাই ওয়ারাকার কথার মধ্যে কিছুটা প্রচ্ছন্নতা জড়িয়ে আছে। তিনি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কোনাে কথা বললেন না। খাদিজা (রকঃ) কে চুপ করে থাকতে দেখে ওয়ারাকা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে এবার বলে উঠলেন, 'আমার কথা বিশ্বাস কর খাদিজা, শেষ নবি ইতিমধ্যে পৃথিবীতে আগমন করেছেন এবং তুমি তাঁর স্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। এমনকি তােমার জীবদ্দশাতেই তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হবেন। তাঁর আনীত ধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তুমি হবে তাঁর ধর্মের প্রথম অনুসারী। আমি যদি আরও স্পষ্ট করে বলতে চাই-তিনি হবেন এ কুরাইশ বংশের হাশেম গােত্রের একজন পুরুষ।'

-জান্নাতুন নেসা তারিন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে