খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ)

 


খাদিজা (রাঃ) আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, তাঁর হাত-পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে, তিনি এখনই পড়ে যাবেন। হৃদয়ের সকল তন্ত্রীতে যেন বয়ে যাচ্ছে অপার্থিব কোনাে শােণিত ফোয়ারা। শরীরের প্রতিটি বিন্দু থেকে উচ্চারিত হচ্ছে আনন্দের গীতিকবিতা।

খাদিজা এত আনন্দ সহ্য করতে পারছিলেন না, জলদি নিজের বাড়ি চলে এলেন। এত দিন তিনি কেবল স্বপ্ন আর কল্পনার অলীক কুসুমে প্রতিপালিত করেছেন তার অনাগত নবিকে, কিন্তু এখন যে তিনি বাস্তবতার খুব কাছে। তিনি যেন চোখ বন্ধ করলেই তাঁকে দেখতে পান চোখের আয়নায়। শেনবির সান্নিধ্যধন্য হওয়ার আনন্দ জড়িয়ে রাখে তাঁকে। কিন্তু আবার নিজের দিকে তাকালে অনিচ্ছুক ভয় এসে জাপটে ধরে তাঁকে। তাঁর বয়স চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই, যৌবনের পড়ন্তবেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ভাগ্য কি তার প্রতি সুপ্রসন্ন হবে? খাদিজা (রাঃ) এর মাথায় নিদারুণ চিন্তার ঝড় বইতে লাগল। স্বপ্নপুরুষ এত দিন কল্পনায় ছিল, সেই তাে ভালাে ছিল। কিন্তু এখন যে তাঁর আগমন অত্যাসন্ন। তিনি প্রভুর দরবারে হাত পাতলেন-হে আল্লাহ! তুমিই বলে দাও, কোথায় গেলে পাব তাকে। খাদিজা (রাঃ) অপেক্ষা করছিলেন। পৃথিবী অপেক্ষা করছিল। সমগ্র সৃষ্টি প্রতীক্ষমাণ ছিল খাদিজা (রাঃ) ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর শুভ পরিণয়ের জন্য। রাব্বুল আলামিন ধীরে ধীরে সাজিয়ে তুলছিলেন এই যুগলের ভালােবাসার অমর কাহিনিকাব্য। খাদিজা (রাঃ) তাঁর কাক্ষিত মানুষের আরেকটু কাছে আসার সুযােগ পেলেন। মক্কায় এ বছর বেশ খরা চলছে। উট ও মেষ চরানোর মতো পর্যাপ্ত ঘাস পাওয়া যাচ্ছেনা কোথাও। মক্কার সামর্থ্যবানরা দামেস্কে যাবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কুরাইশ নেতা আবু তালিব বংশমর্যাদায় যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও সাংসারিক অবস্থা ততটা সচ্ছল নয়। তাঁর সন্তানেরা সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো শক্ত সামর্থ্যবান হয়নি। তাঁর প্রতিপালিত ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সাঃ) ই পরিবারে রোজগারের অনেকখানি। আবু তালিবের বয়স হয়েছে। এখন আর এদিক সেদিক যেতে পারেনা। আর তাঁর এত্তটা সামর্থ্য নেই যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কে পুজি করে, মেষ পালকের চারনভুমিতে বা ব্যবসায় কাজে দামেস্কে পাঠাবে। আর অন্যদিকে খাদিজা (রাঃ) এর কোনো কাজের লোকের অভাব নেই। তবুও তিনি একজন সৎ, আদর্শের চরিত্রের অধিকারী এবং আমানতকারী লোক যাকে ব্যাবসার দায়িত্ব দিয়ে দামেস্কে পাঠাবেন তাই নিয়োগের ঘোষনা দিয়েছেন মক্কায়। আবু তালিব ঘোষনা শুনে মুহাম্মদ (সাঃ) কে ডেকে, তিনি তাঁকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে দামেস্কে পাঠাতে চান আর তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) সম্মতি জানালেন। কিন্তু তিনি আবু তালিবের যে বংশমর্যাদা সেটা নিয়ে খাদিজা (রাঃ) এর কাছে কাজের কথা বলতে যাওয়াটা শোভম দেখায় না। তাই আবু তালিবের বোন অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ফুফু আতিকা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। যার কিনা বিয়ে হয়েছে খাদিজা (রাঃ) এর ভাই আওয়ামের সাথে। আর তাই ভাবি হবার খাতিরে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাজের বিষয়ে কথা পাতলেন খাদিজা (রাঃ) এর কাছে। ভ্রাতৃবধু আতিকা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কথা বলার আগে বেশ কয়েকজন কুরাইশী এসেছিলেন নিয়োগ পাবার জন্য কিন্তু তার নিষ্কলুস চরিত্রের অধিকারী ছিল না একেক জন একেক নেশায় মত্ত। ভ্রাতৃবধূ আতিকার কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা শােনার সঙ্গে সঙ্গে খাদিজা (রাঃ) এর ভেতরে অন্য রকম এক কম্পন শুরু হয়ে গেল। মুহাম্মদ (সাঃ)! আহমদ! আল আমিন! এই কি সেই ব্যক্তি? এই কি সেই সত্যধারা প্রবাহের শেষ সমীরণ? ওয়ারকার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সেই নাম, সেই বংশ, চারিত্রিক উৎকর্ষে সেই রাজটীকা, ভদ্রতা আর মানবতায় যিনি তুলনাহীন, যার সত্যবাদিতা আর বিশ্বস্ততার কাহিনি সুবিদিত পুরাে মক্কায়! এ মুহাম্মদ (সাঃ) কি সেই তিনি নন? আহা! কোথায় খুঁজেছি এত দিন তাকে আমি? অধীর হয়ে তার অপেক্ষায় প্রতীক্ষমাণ থেকেছি। হৃদয় থেকে উৎসারিত হতে লাগল—এত দিন কোথায় ছিলেন? খাদিজা (রাঃ) দেরি না করে খবর পাঠালেন আবু তালিবের কাছে। আবু তালিব মুহাম্মদ (সাঃ) কে না পাঠিয়ে নিজে এলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) কে পাঠানাের আগে কিছু বিষয়ে আলােচনা করে নেওয়া দরকার। তিনি খাদিজা (রাঃ) এর কাছে এসে তার ভাতিজার উত্তম গুণাবলি বর্ণনা করলেন। এটা করলেন যতটা না খাজিদা (রাঃ) কে বােঝাতে, তার চেয়ে নিজের হৃদয়ের দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা প্রশমন করতে। কেননা তিনি এর আগে মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে যখন দামেস্ক সফর করেছিলেন, তখন এক ইহুদি পাদরির মুখে ভাতিজার ব্যাপারে অস্বাভাবিক কিছু কথা শুনেছিলেন। সে কথাগুলাে এখনও তার মনে পাথরের মতাে ভারী হয়ে আছে। তিনি কারও কাছে তা প্রকাশ করতে পারেননি। কেননা এ সময়ের ইহুদিরা যদি মুহাম্মদ (সাঃ) এর এমন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানতে পারে, তবে তাকে হত্যা করতে কসুর করবে না মােটেও। হিংসার বশবর্তী হয়ে এর আগে তারা নবি ঈসা (আ.)-কে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। তারও আগে তারা হত্যা করেছে শত শত নবিকে। এই ভয়ে ভাতিজাকে তিনি সব সময় নিজের কাছে আগলে রাখেন। খাদিজা (রাঃ) এর কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে বলার পর তিনি দাবি করলেন-অন্যদের আপনি আপনার ব্যবসা পরিচালনার জন্য যে পারিশ্রমিক প্রদান করেন, মুহাম্মদ (সাঃ) কে তার দ্বিগুণ দিতে হবে। কেননা তার ব্যক্তিত্ব অন্য সবার চেয়ে আলাদা, ব্যবসায়িক হিসেবে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততাও অন্যদের থেকে তুলনাহীন। সুতরাং একটি নয়, পারিশ্রমিক হিসেবে তাঁকে দুটি উট প্রদান করতে হবে। খাদিজা (রাঃ) আবু তালিবের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। তিনি কি সত্যিই আবু তালিবের কথা শুনছিলেন? তার শারীরিক অবয়ব উপবিষ্ট ছিল আবু তালিবের সামনে, কিন্তু সমগ্র অন্তরাত্মা ভেসে বেড়াচ্ছিল অন্য কোথাও। তার চোখ খােলা,কিন্তু তাঁর চোখের তারায় ঝিকমিক করছিল অন্যলােকের অপার্থিব ছায়াছবি। খাদিজা (রাঃ) আবু তালিবের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আবু তালিব যা দাবি করলেন, সব বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলেন। যার পায়ের সামনে লুটিয়ে দিতে পারেন তাঁর সমস্ত সর্ব, সেখানে দুটি উট তাে তাঁর কাছে তুচ্ছ। তিনি আবু তালিবকে শুধু বলতে পারলেন, হে আবু তালিব! আপনি আপনার ভাতিজার জন্য যা দাবি করেছেন তা অসাধ্য নয় এবং তা সন্তোষজনক পারিশ্রমিক। আমি শপথ করে বলছি, আপনি যদি এর চেয়ে অধিক কিছু দাবি করতেন, তবে আমি তা দিতেও প্রস্তুত।' এলেন যুবক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম খাদিজার কাছে ব্যবসার যাবতীয় নির্দেশনা বুঝে নেওয়ার জন্য। খাদিজা (রাঃ) নির্ণয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এ যুবকের দিকে। আগে যদিও দু-একবার তাঁদের দেখা হয়েছে, কিন্তু এবারকার সাক্ষাৎ একেবারেই অন্য রকম। বিশেষত খাদিজা (রাঃ) এর কাছে তাে এ চন্দ্রাভিযানের সমতুল্য। তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে লাগল মুহাম্মদ (সাঃ) এর মুখাবয়ব, তার চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি, অঙ্গচালনা, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতিটি সূক্ষ্ম প্রকাশে। খাদিজা (রাঃ) এর চোখজুড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মানব। সত্যিই কি তিনি? হৃদয় অলিন্দে এখনাে কয়েক বিন্দু দোলাচল জমে আছে। না, তিনি কোনাে সন্দেহের দোলাচলে দুলতে রাজি নন। তিনি তাকে তুলে ধরতে চান সকল সন্দিগ্ধতার ঊর্ধ্বে। হৃদয় থেকে যখন মুছে যাবে সন্দেহের সকল তমসা, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। খাদিজা (রাঃ) তার বিশ্বস্ত ক্রীতদাস মায়সারাকে একান্তে ডাকলেন। প্রথমেই তাঁকে জানালেন, এই বাণিজ্য সফরে তাকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ভৃত্য হয়ে যেতে হবে। কিন্তু এটা তার মূল দায়িত্ব নয়, তাঁর কাজ হচ্ছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ছায়াসঙ্গী হয়ে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করা। তাঁর প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতা, ব্যবসায়িক আলােচনা সব যেন তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন। শুধু তা-ই নয়, যাওয়া-আসার পথে প্রতিটি ঘটনা তাঁকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হবে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটি কদমও যেন তার অগােচরে কোথাও না পড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কাফেলা রওনা হলাে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পথে। খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ) - দ্বিতীয় অংশ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে