খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিআল্লাহু আনহা
মুহাম্মদ (সাঃ) এর পণ্য বেচাকেনা শেষ হলাে একসময়। তিনি সব হিসাব বুঝিয়ে দিতে এলেন খাদিজা রাঃ) এর কাছে। অন্যান্য বার যে পরিমাণ মুনাফা হয়, এবার তারচেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা হয়েছে খাদিজার (রাঃ) এর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়। কিন্তু ব্যবসার মুনাফা নিয়ে খাদিজা (রাঃ) এর কোনো মাথাব্যাথায় নেই। তিনি কেবল তাঁর সামনে উপস্থির মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে তাকিয়ে আছেন। এ যেন এক মহাকালের পরিচয়। অনন্তকাল থেকেই যেন খাদিজা (রাঃ) চেনেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর এ মুখশ্রী। কী প্রশান্ত, কী প্রাণােজ্জ্বল! ঐশ্বরিক দ্যুতিতে ঝলমল করছে তার মানব অবয়ব। কিন্তু খাদিজা (রাঃ) কীভাবে বলবেন তাঁর হৃদয়ের কথা? নিজের অপারগতায় মুচড়ে যেতে থাকেন তিনি। কেননা বয়সের তফাৎ এর বিষয়টি তাে রয়েছেই, তা ছাড়া খাদিজা (রাঃ) এ বয়সে আর বিয়ে করবেন না বলে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন এবং অনেক বিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি মুগ্ধতা তাঁর সকল প্রতিজ্ঞা উলটপালট করে দিয়েছে। আল্লাহর প্রেরিত পুরুষের সহধর্মিণী হওয়ার সৌভাগ্যের পরশমণি তাঁর হৃদয়কেব্যাকুল করে তুলেছে। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। খাদিজা (রাঃ) সারা দিন মনমরা হয়ে বসে থাকেন। মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা ভেবে ভেবে পেরেশান হন। এত কাছে পেয়েও তিনি তাকে হারাবেন? আল্লাহর এত বড় উপহার করতলে আসার পরও তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না? তাঁর চোখজুড়েজমা হয় বেদনার অশ্রু মাঝেমধ্যে তিনি ওয়ারাকার কাছে গিয়ে বিষন্ন মন নিয়ে বসে থাকেন। পণ্ডিত ওয়ারাকা তার বােনের এমন অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন। তাঁকে পরামর্শ দেন আর কয়েকটা দিন সবর করার। আল্লাহ যেহেতু একবার মুহাম্মদ (সাঃ) এর ভালােবাসায় খাদিজা (রাঃ) এর হৃদয় আলােকিত করেছেন, নিশ্চয় তিনি এ আলােকে অন্ধকারে হারাতে দেবেন না। দামেস্কের বাণিজ্য কাফেলা মক্কায় আসার পর তিন মাস হয়ে গেছে। এখনো খাদিজা (রাঃ) কোনাে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। একবার ভেবেছেন—সবকিছু পেছনে ফেলে এখনই গিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে গিয়ে মনের কথা বলবেন কিন্তু তিনি তো আর ছোট্ট কিশোরী নন তাছাড়া মানুষই বা কি বলবে ভেবে যান নি। তিনি পরিণীতা, নিজের মনােবেদনা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। এরই মধ্যে একদিন খাদিজা (রাঃ) এর অন্তরঙ্গ বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনিয়া বেশ কিছুদিন পর এলেন তার বাড়িতে। কিন্তু এবার এসে খাদিজা (রাঃ) কে কিছুটা অন্য রকম দেখতে পেলেন। এ খাদিজা (রাঃ) আগের সেই ব্যক্তিত্বময়ী দৃঢ়প্রত্যয়ী খাদিজা (রাঃ) নন। তাঁর মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। তাঁর কথার মধ্যে কেমন যেন অসংলগ্নতা। কী হয়েছে খাদিজা (রাঃ) এর? মনে মনে ভাবতে লাগলেন নাফিসা। খাদিজা (রাঃ) এর অস্থিরতা লক্ষ করে একসময় নাফিসা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তােমার? আমি তাে অনেক দিন থেকে তােমাকে জানি, কিন্তু এমন অস্থির তাে তােমাকে কখনাে দেখিনি? নাফিসার কথায় খাদিজা (রাঃ) কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও ভাবলেন কারও না কারও কাছে তাে বিষয়টি বলতেই হবে। না বললে সমস্যার সমাধান হবে না। শেষমেশ মুখ খুললেন, ‘নাফিসা, সখী আমার! আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ (সাঃ) কে তাে তুমি জানাে। তিনি উত্তম চরিত্রে প্রতিপালিত একজন যুবক। তাঁর মতাে চারিত্রিক নিষ্কলুষতাসম্পন্ন যুবক এরআগে আমি আর দেখিনি। তিনি সৎ, বিশ্বস্ত এবং পবিত্র একজন মানুষ। এমন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ যে কাউকে আকর্ষণ করবে। শুধু তা-ই নয়; তার ব্যাপারে অনেক ঐশ্বরিক ও অলৌকিক ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। অদ্ভুত সব বিষয় আমি জেনেছি। আমার ক্রীতদাস মায়সারা আমাকে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলাে বলেছে। এক খ্রিষ্টান পাদরি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে তার ব্যাপারে। আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ (সাঃ) সেই নবি, যার জন্য যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করা হচ্ছে।' বলতে বলতে খাদিজা (রাঃ) এর চোখ-মুখ আগ্রহে জ্বলজ্বল করতে লাগল। মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা বলতে গিয়ে কখন যে তাঁর মুখাবয়বে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে, তিনি খেয়াল করেননি। নাফিসা বান্ধবীর রক্তিম মুখ দেখে বিষয়টির আদ্যোপান্ত আন্দাজ করতে পারলেন। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি লুকিয়ে আগ বাড়িয়ে বললেন, 'হলােই-বা তিনি বিশেষ কেউ! কিন্তু তার সঙ্গে তােমার এই দীর্ঘ দিন-রজনীর অস্থিরতার কী সম্পর্ক? খাদিজা এবার আর কোনাে বক্তব্যে গেলেন না। সরাসরি নাফিসার কাছে নিজের মনােবাসনা মুক্ত করলেন, 'আমি তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। কিন্তু জানি না এ কাজে আমি কীভাবে এগােবো। বান্ধবীর এমন উদার আত্মসমর্পণে খুশিতে ভরে গেল নাফিসার হৃদয়। এমন শুভকাজে নাফিসা এগিয়ে না এসে পারেন না। তিনি নিজে এ কাজের দায়িত্ব নিলেন, “তােমার যদি সম্মতি হয়, তাহলে এ ব্যাপারে আমি অগ্রসর হতে ইচ্ছুক। খাদিজা বান্ধবীর সহসা সহযােগিতার কথা শুনে আপুত হলেন, “তুমি অগ্রসর হও, বাদবাকি আল্লাহর হাতে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তখন চাচা আবু তালিবের বাড়িতে ছিলেন। বাড়িতে আবু তালিব এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন। এমন সময় সেখানে নাফিসা এলেন। আবু তালিবের স্ত্রীকে সালাম দিয়ে নাফিসা বসে গেলেন সেখানে। এ কথা সে কথা জিজ্ঞেস করলেন কিছুক্ষণ। একটু পর মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী ব্যাপার, আপনি এখনাে বিয়ে করছেন না যে? প্রশ্নটা হঠাৎ হয়ে গেল, মুহাম্মদ (সাঃ) এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তিনি সহজভাবে জবাব দিলেন, 'বিয়ে করার মতাে প্রয়ােজনীয় সম্পদ নেই আমার! তেমন অবস্থা হলেই বিয়ে করে ফেলব।' নাফিসা কথা বাড়াতে লাগলেন, অর্থ-সম্পদ বিয়ের জন্য কোনাে প্রতিবন্ধকতা নয়। অর্থ-সম্পদ খুব সহজেই ফুরিয়ে যেতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সততা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র চিরকালীনআপনার এ বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।' মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগ্রহ দেখে তিনি কথা সামনে নিয়ে চললেন, ‘অর্থ-সম্পদের বিষয়টি বাদ দিন। এমন কেউ যদি আপনাকে প্রস্তাব দেয়, যার পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ ও সম্মান-প্রতিপত্তি রয়েছে এবং বংশমর্যাদায়ও যিনি অভিজাত, তাহলে কি আপনি বিয়ের জন্য রাজি হবেন? নাফিসা প্রকারান্তরে বােঝাতে চাইলেন, এমন একজন রয়েছেন, যিনি আপনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক। মুহাম্মদ (সাঃ) এর মনে স্বাভাবিক কৌতূহল জেগে উঠল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ রকম মেয়ে...কে তিনি? নাফিসা এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে নামটি উচ্চারণ করলেন,‘খাদিজা(রাঃ)।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন