খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিআল্লাহু আনহা - তৃতীয় অংশ
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে পৌঁছে গেল বানিজ্য কাফেলা। এখানে বিশাল বাজার। আরব, আফ্রিকা, রোম-পারস্য, এবং হিন্দু বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাদের নানা ধরনের পণ্যের পসরা বসিয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর পণ্য দিয়ে এক নির্দিষ্ট জায়গায় তাঁবু গাড়লেন কিছু সময়ের মধ্যেই। আর মায়সারা খাদিজা (রাঃ) এর কথা অনুযায়ী মুহাম্মদকে চোখে চোখে রাখছেন। মায়সারা তাঁর ব্যবহার যতই দেখছেন ততই মুগ্ধ হচ্ছে এবং ভাবছে কিভাবে একজন মানুষ এমন নিষ্কলুষ এবং কোমল হৃদয়ের হতে পারে। মায়সারা কোনো এক কাজে অন্যদিকে গিয়েছিলেন আর সেই সময়ই শুনলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে এক ইহুদি ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে তর্ক করছেন। লোকটি উচ্চস্বরে বলছেন, তোমার কথা ব্যাপারে সত্য হয়ে থাকলে লাত ও উজ্জা দেবীর নামে শপথ করো। মুহাম্মদ (সাঃ) কে যতবার শপথ করতে বললেন তিনি ততবারই না সূচক মাথা নেড়ে বললেন অসম্ভব। আমি কখনোই এইসবের নামে শপথ করবো না বরং আমি যখন এগুলোর সামনে দিয়ে যায় তখন মুখ ফিরিয়ে নেই। আর কিভাবেই বা শপথ করবেন মুহাম্মদ (সাঃ)! যার অন্তর জুড়ে আলোকিত করা হয়েছে আসমাউল হুসনা দিয়ে। কয়েকবার বলার পরও যখন লাত ও উজ্জার নামে শপথ করলেন না। তখন লোকটি পেছনে হটে গেল এবং মায়াসারা কে একা ডেকে নিয়ে বললেন, কখনোই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করো না। কোনো সন্দেহ নেই, তিনি একজন নবী, শেষ নবী। মায়সারা আরেকবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন যুবক মুহাম্মদে (সাঃ) এর দিকে। খাদিজা (রাঃ) এর কাছে বলার মতাে দারুণ একটা তথ্য গেঁথে নিলেন অন্তরে। মায়সারা জানেন না, তাঁর মুগ্ধতা কেবল শুরু হয়েছে। ভবিষ্যৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও মুগ্ধকর কিছু নিয়ে। ভালো ভাবে দামেস্কের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শেষ হলাে। মুহাম্মদ (সাঃ) যে পণ্য নিয়ে এসেছিলেন দামেস্কের বাজারে, বেশ ভালাে দামে বিক্রি করেছেন সেগুলাে। পুঁজিগত মূলধন দিয়ে এখান থেকে নতুন করে আবার পণ্য কিনে নিয়ে যেতে হবে মক্কায়। বাজার ঘুরে সুবিধাজনক দামেই কিনতে পারলেন ভালো মানের পণ্য। এবার ফেরার পালা। সব পণ্য উট ও গাধার পিঠে সাজিয়ে মক্কার পথ ধরলেন যুবক ব্যবসায়ী মুহাম্মদ (সাঃ) দীর্ঘ পথ। একদিন দুপুরবেলা পথক্লান্তিতে বুসরা নামক এক জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলেন তিনি। কাফেলা থামিয়ে একটি গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। দুপুর রােদে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা করবেন মক্কার পথে। মায়সারা কাছেই বসে পড়লেন। দুপুরের খাবারের আয়ােজনটা সেরে ফেলবেন এই ফাঁকে। এমন সময় দেখলেন, দূর থেকে অপরিচিত এক বৃদ্ধলােক হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। লােকটি তার দিকে এগিয়ে এলেও গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বিশ্রামরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে। মায়সারা লােকটির দৃষ্টির গভীরতা দেখে অবাক হলেন। লােকটিকে দেখেই মায়সারা চিনলেন তিনি খ্রিষ্টবিশ্বসী নেস্তরিয়ান একজন পাদরি। নেস্তুরিয়ান পাদরিটি হাঁপাতে হাঁপাতে মায়সারার কাছে এসে মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ওই যে গাছের নিচে যে লােকটি বিশ্রাম নিচ্ছেন,কে তিনি? চেনাে তাঁকে? মায়াসারা কৌতূহলী হলেন। কেননা এর আগে তিনি দামেস্কের বাজারে নতুন কিছু শুনেছেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে। এ পাদরিও কি তেমন কোনাে কথা বলবেন? তিনি বেশ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, 'তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) । মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। মক্কার হাশিম গােত্রের একজন যুবক। পাদরির ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তিনি মায়সারার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি যা জানি, তুমি তা জানাে না। শুনে রাখাে-আমি শপথ করে বলছি, এই গাছের নিচে যিনি বসে আছেন, তিনি একজন নবি ছাড়া আর কেউ নন! মায়সারা আবার বিস্মিত হলেন। খাদিজা (রাঃ) কি এ কারণেই তাঁকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ছায়াসঙ্গী করে পাঠিয়েছেন? এ কারণেই কি তাঁর প্রতিটি কাজকে অনুসরণ করতে বলেছেন? খাদিজা (রাঃ) কি মুহাম্মদের ব্যাপারে এই ভবিষ্যদ্বাণী আগে থেকেই জানেন? পাদরির প্রশ্নে মায়সারার চিন্তায় ছেদ পড়ল। পাদরি তার কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে আরও প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম, বেড়ে ওঠা, তাঁর বংশ, তাঁর চারিত্রিক বলয়, তার প্রভাব ও স্বভাব, তাঁর লেনদেন-সব বিষয়ে তিনি মায়সারাকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। মায়সারা একে একে তার সব কথার উত্তর দিলেন। সেই সঙ্গে সদ্য দামেস্ক বাজারে সংঘটিত বিতর্কের কথাটি বলতেও ভুললেন না। মায়সারার কথা শুনে নেস্তারিয়ান পাদরি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ছুটে গেলেন বিশ্রামরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে। তিনি তাঁর কপালে চুমু খেয়ে অত্যন্ত সম্রমের সঙ্গে পায়ের কাছে বসে পড়লেন। মুহাম্মদ (সাঃ) খ্রিষ্টান পাদরির এমন অকস্মাৎ ব্যবহারে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু পাদরির সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ঘােষণা করলেন, 'আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি সেই প্রতিশ্রুত নবি, যার ব্যাপারে তাওরাত ও ইঞ্জিলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। মায়সারা কাছ থেকে পাদরির কথা শুনলেন। এবার তাঁর দায়িত্ব যেন আরও বেড়ে গেল। নতুন নতুন প্রতিটি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তিনি আরও মনােযােগী হয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সর্বদিকে খেয়াল দেওয়া শুরু করলেন। প্রতিটি ঘটনা খাদিজার (রাঃ) এর কাছে বলার উত্তেজনায় তিনি অস্থির হয়ে আছেন। খানিক বিশ্রামের পর কাফেলা আবার রওনা হলাে। মায়সারার চোখ সারাক্ষণ মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর। এক মুহূর্তের জন্যও আর তাঁকে আড়াল করা চলবে না। দুপুরের তেজি রােদ বেশ তাতানাে এখনাে। দুরন্ত সূর্য যেন আগুনের হলকা ছােটাচ্ছে পথজুড়ে। মরুর চিকচিক মরীচিকায় চোখ রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মায়সারা দেখলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) যেখান দিয়ে উট নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে সূর্যের আলাের তেজ নিম্ন। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। অবাক কাণ্ড! আকাশের নীলিমায় এক খণ্ড ধূসর মেঘ মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। তিনি নিরীক্ষণের জন্য মেঘখণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন সত্যি,মুহাম্মদ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেঘও ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে সেদিকেই যাচ্ছে। দীর্ঘ কাফেলার আর সবখানে সূর্য ঝরাচ্ছে মধ্যাহ্নের তাতানো রোদ, শুধু মুহাম্মদের মাথার ওপর এক খণ্ড মেঘ তাঁকে শীতল ছায়া দিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে। মায়সারার চোখ এ দৃশ্য দেখে ছানাবড়া হয়ে গেল। মনে মনে আওড়ালেন-ধন্য তুমি মুহাম্মদ (সাঃ)! ধন্য কুরাইশ রাজকুমারী খাদিজা (রাঃ)! খাদিজা (রাঃ) এর দিন যেন ফুরােয় না। প্রতিদিন তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাফেলার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। কাফেলার জন্য, নাকি মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য? হয়তাে তা-ই হবে। হয়তাে অপেক্ষা করছেন মায়সারার জন্য, মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে সবকিছু জানার ব্যাপারে তিনি উতলা হয়ে আছেন। প্রতিদিন বাড়ির দোতলা থেকে তিনি চেয়ে থাকেন সিরিয়ার পথপানে, কখন আসবে দামেস্কি কাফেলা। অবশেষে কাফেলার আগমনী পদধ্বনি শােনা গেল মক্কার উপকণ্ঠে। খাদিজা (রাঃ) এর বুকের স্পন্দন তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগল-কী খবর নিয়ে এসেছেন মায়সারা? কেমন আছেন মুহাম্মদ (সাঃ) ? পথে কোনাে বিপদ হয়নি তাে? ব্যবসায়িক পণ্যের ব্যাপারে তার কোনাে মাথাব্যথা নেই। ব্যবসা যা হওয়ার হােক, সবার আগে তাকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর খবর শুনতে হবে! মুহাম্মদ (সাঃ) বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সরাসরি চলে গেলেন মক্কার বাজারে। সেটাই নিয়ম। দামেস্ক থেকে আমদানি করা সমুদয় পণ্য মক্কার বাজারে বিক্রি করে যাবতীয় হিসাব দাখিল করতে হয় প্রধান ব্যবসায়ীর কাছে। তাই তিনি খাদিজা (রাঃ) এর বাড়িতে না এসে পণ্য নিয়ে মক্কার বাজারে গিয়ে সওদাগরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যত দ্রুত সম্ভব তিনি এ কাজ সমাপ্ত করতে আগ্রহী। মায়সারার সে দায় নেই। ব্যবসায়িক কাজের কোনাে জবাবদিহি তাকে দিতে হবে না। তার কাজ ছিল সফরে মুহাম্মদ (সাঃ) এর দেখভাল করা এবং তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে সবকিছু আয়ত্ত করা। এখন তাঁর দায়িত্ব শেষ, আর দেরি না করে তিনি চলে এলেন খাদিজা (রাঃ) এর কাছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে চমকপ্রদ সব সংবাদ জমা করে নিয়ে এসেছেন খাদিজা (রাঃ) এর জন্য। যে পর্যন্ত সেগুলাে তাঁকে না জানাবেন, সে পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। এত দিন পর্যন্ত অনেক কষ্টে বুকের ভেতর আটকে রেখেছেন অবিশ্বাস্য কথামালা। খাদিজা (রাঃ) মায়সারার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আসতেই তাঁকে একান্তে ডেকে পাঠালেন। কৌতূহল বেশিক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে পারলেন না, জানতে চাইলেন সবকিছু। মায়সারাও অপেক্ষা করতে করতে পেরেশান। তাঁর চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ। তিনি সবিস্তারে বলতে শুরু করলেন একদম প্রথম থেকে-দামেস্ক যাওয়ার পথে যা ঘটেছে, যা ঘটেছে দামেস্কের বাজারে ইহুদি ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করার সময়, ফেরার পথে নেস্তরিয়ান খ্রিষ্ট পাদরি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আকাশ থেকে ছায়া দানকারী সেই মেঘখণ্ড, মুহাম্মদের ব্যবসায়িক সততা, ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে তারস্বচ্ছতা, অন্য আর সবার সঙ্গে চারিত্রিক আচরণ-সব তিনি খুলে বললেন খাদিজার কাছে। এ কদিনের জমানাে সব কথা একনাগাড়ে বলে গেলেন। খাদিজা (রাঃ) এর হৃদয় খুশিতে আত্মহারা হওয়ার জোগাড়। কিন্তু মায়সারার সামনে সেটা প্রকাশ করলেন না। তাঁর সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে তাকে বিদায় করে দিলেন। এবার তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। খাদিজা মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। খাদিজা (রাঃ) এর চোখে-মুখে বেহেশতি খুশি খেলা করছে। তার হেঁটে চলার ঝলমলে গতি দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর যেন আজ দুটো ডানা গজিয়েছে। পাখির মতাে ফুরফুরে হালকা হয়ে উড়ে যাচ্ছেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের বাড়ির দিকে। আজ তিনি ভয়হীন, নিঃশঙ্ক তাঁর হৃদয়। সন্দেহের সকল জড়তা উধাও হয়ে গেছে তার অন্তর থেকে। অবশেষে তার অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর শেষ হতে চলেছে। আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষের জন্য তাঁর ভালােবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে আজ। খাদিজা (রাঃ) খুশির আমেজ নিয়ে এলেন ওয়ারাকার কাছে। মায়সারার কাছে যা শুনেছেন মুহাম্মদের (সাঃ) এর ব্যাপারে, সব খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকার দৃষ্টিহীন চোখেও চিকচিক করে উঠল আনন্দাশ্রু। তাঁর এত দিনের প্রতীক্ষা তবে শেষ হলাে! সেই সে মহামানবকে তিনি নিজ চোখে দেখতে না পারলেও তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেন, তাঁর কথা শুনতে পাবেন। সুযােগ হলে হয়তাে তিনি তাঁর নবুওয়াতের রােশনিতেও বিভাসিত হতে পারবেন। বরিত হতে পারবেন শেষ নবির সম্মানিত উম্মত হিসেবে। ওয়ারাকা খাদিজা (রাঃ) কথা শুনে বলে উঠলেন, “খাদিজা, বােন আমার! তুমি যা বলছ তা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে মুহাম্মদ (সাঃ) এ যুগের নবি। আমি বিশ্বাস করি, এই সেই সময়, যখন নবির আগমন অবশ্যম্ভাবী। সময় সমাগত, এখন কেবল অপেক্ষার পালা।' (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মুল মুমিনিন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিআল্লাহু আনহা - তৃতীয় অংশ || উম্মুল মুমিনিন || -জান্নাতুন নেসা তারিন
source-md rehad sarker/youtube
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন