খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ) - শেষ অংশ


 অবশেষে মুক্তি এসেছে। নিজের বাড়ি যাওয়ার ছুটি মিলেছে। বাকিনিরাপদ রাখতে নিজের ভালােবাসা আর মমতার ডানা ছড়িয়ে তার নিচে তাঁকে আগলে রাখতেন।অবশেষে মুক্তি এসেছে। নিজের বাড়ি যাওয়ার ছুটি মিলেছে। বাকি জীবনটা তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) কে এভাবেই ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে, ভালােবাসার পরশ দিয়ে ভরিয়ে রাখতে চান। মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াতকে বিশ্ববাসীর কাছে উড্ডীন করতে চান সগৌরবে। কিন্তু দীর্ঘ নির্বাসন শুষে নিয়েছিল তাঁর শরীরের শেষ প্রাণশক্তিটুকু। বাড়ি ফিরে বেশ কয়েক দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলেন নিবিড় শয্যায়।

নবুওয়াতের দশম বছরের ১০ রমজান। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বাড়ি। দীর্ঘদিন বসবাস না করার ফলে বাড়িটি এখন শ্রীহীন। এখানে-সেখানে মাকড়সার ঝুল। দেয়াল থেকে খসে পড়েছে পােড়ামাটির পলেস্তারা। টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছে এ সন্ধ্যারাতে। রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বসে আছেন প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) এর পাশে। খাদিজার শরীরটা শুকিয়ে কেমন এতটুকুন হয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটরাগত। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য বলিরেখা। শ্বাস নিতে দারুণ কষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি শ্বাস যেন রাসুলের বুকে প্রবল হাতুড়পেটা হয়ে আঘাত করছে। শিআবে আবু তালিবে মক্কার মুসলমানদের নির্বাসন শেষ হয়েছে এই তাে কদিন হলাে। রাসুল (সাঃ) এর চোখের সামনে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে দুঃখদিনের প্রতিটি স্মৃতি। কী করে ভুলবেন তিনি সেসব দুঃখময় প্রতিটি প্রহর! অভুক্ত-অর্ধাহারী হয়ে কাটাতে হয়েছে কত দিন! এখন নির্বাসন থেকে মানবিক মুক্তি মিলেছে ঠিকই, কিন্তু রাসুল (সাঃ) এর হৃদয়ের মুক্তি যেন তমসায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তিন দিন আগে পরলােকগমন করেছেন প্রিয় চাচা আবু তালিব । রাসুল (সাঃ) এর সবচেয়ে বিশ্বজন, সবচেয়ে অভয়দাতা। ব্যথায় মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। অব্যক্ত কান্নায় হু হু করে ভেঙেছে হৃদয়ের ভালােবাসার প্রতিটি মর্মরসৌধ। মক্কার প্রতিটি পাথর আর ধূলিকণা সাক্ষী আছে সে বেদনার। প্রতিটি সৃষ্টি স্তব্ধ হয়েছিল বেদনার অলৌকিক নােনাজলে। হায়! আজ প্রিয়তমা খাদিজা (রাঃ) ও মৃত্যুশয্যায়। মাঝরাত। পরম কাঙ্ক্ষিত প্রেম মুহাম্মদ (সাঃ) এর কোলে মাথা রেখে তার ২৫ বছরের একান্ত সহধর্মিণী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিভৃতে চলে গেলেন আল্লাহর কাছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বােবাকান্নায় আছড়ে পড়লেন প্রিয়তমার শয্যাপাশে। কোথাও কেউ নেই! চারদিকে কী নিস্তব্ধ আজ মক্কার নিকষ আঁধার রাত্রি। হায় বেদনা! হায় যাতনা! হায়, অশ্রুর বিয়াবানে বুঝি সমাধি হলাে এ ভালােবাসার যুগলবেদনার! এই সেই খাদিজা (রাঃ) -যিনি মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি বলে মুহাম্মদ (সাঃ) কে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের সর্বস্ব সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর চরণতলে। এই সেই খাদিজা-হেরার গুহায় ধ্বনিত 'ইকরা' যখন ভীতবিহ্বল করেছিল ধ্যানমগ্ন মুহাম্মদকে, দৌড়াতে দৌড়াতে মুহাম্মদ (সাঃ) আড়াই মাইল পথ পাড়ি দিয়ে। এই সেই খাদিজা (রাঃ) -যিনি মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি বলে মুহাম্মদ (সাঃ) কে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের সর্বস্ব সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর চরণতলে। এই সেই খাদিজা-হেরার গুহায় ধ্বনিত ‘ইকরা যখন ভীতবিহ্বল করেছিল ধ্যানমগ্ন মুহাম্মদ (সাঃ) কে, দৌড়াতে দৌড়াতে মুহাম্মদ (সাঃ) আড়াই মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌছেছিলেন যার ঘরে, তিনি এই অতল প্রেমময়ী খাদিজা (রাঃ) । এই খাদিজা (রাঃ) কাছে এসেই সদ্য নবি হওয়া মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নির্ভাবনায় বলেছিলেন, 'আমাকে চাদরাবৃত করে দাও, চাদরাবৃত করাে আমার পুরাে সত্ত্বা!' খাদিজা (রাঃ) বুক দিয়ে আগলে ধরেছিলেন নবুওয়াতের আলােকবিভায় সদ্যস্নাত নবিছুল মুরসালিনকে। তার বুক থেকেই তাে আলাে পেয়েছিল নুরে মুহাম্মদ (সাঃ) ! এই সেই খাদিজা (রাঃ)-মক্কার মুশরিকদের আঘাত, গালি আর গলাধাক্কা খেয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আঘাতশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন, তিনি বুকভরা মমতায় সারা রাত্রি জেগে মুহাম্মদ (সাঃ) এর শরীর থেকে তুলার মতাে তুলে নিতেন সমন্ত অবসাদ, যাবতীয দুঃখ-ক্লেশ, ব্যথার দান। পরদিন মুহাম্মদ (সাঃ) দীনের পয়গাম হাতে পথে নামতেন নতুন এক রাসুল (সাঃ) হয়ে, নতুন এক পয়গাম্বর হয়ে। এই সেই খাদিজা (রাঃ) -মক্কার অন্যতম বিত্তশালী বলে যার খ্যাতি ছিল, নিজের প্রিয়তম স্বামী নবি মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য সমস্ত বিত্ত-বৈভব তুচ্ছ করে, সকল পিছুটানছিন্ন করে নিঃস্ব-রিক্ত হাতে গিরিপথে বরণ করেছিলেন দীর্ঘ বন্দীনিবাস । আজ সেই খাদিজা (রাঃ) তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁকে হাহাকারের অথইয়ে ভাসিয়ে গেলেন। হায় আল্লাহ! তােমার দেওয়া এই শ্রেষ্ঠ উপহারের ওপর আমি খুশি, তুমিও তার ওপর খুশি হয়ে যাও ! ১০ বছর পর। প্রিয়তমা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুর তিন বছর পর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাতের আঁধারে মাতৃভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে চলে গিয়েছিলেন ইয়াসরিবে । হিজরতের সাত বছর পর আবার তিনি ফিরে এলেন মক্কায়। তবে এবার রাতের আঁধারে নয়, ফিরে এলেন সূর্যদিনের ঝলমলে রােদুর হাতে নিয়ে। বিজয়ীর বেশে মাথা উঁচু করে। হিজরত করেছিলেন সঙ্গে কেবল আবু বকরকে নিয়ে, আজ ফিরে এসেছেন ১০ হাজার প্রদীপ্ত সেনানী নিয়ে। তিনি তাঁর সেনানীদের নিয়ে বীরদর্পে পা রাখলেন প্রিয় মাতৃভূমি মক্কার বালিয়াড়ি আঙিনায়। তিনি মক্কা শহরে প্রবেশ করলেন। তার মক্কা আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে গেল। এক অর্থে এখন তিনি সমগ্র আরবের মুকুটহীন সম্রাট। যদিও তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রেরিত হননি, তিনি পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন কেবলই মানবজাতির আলােকিত ভবিষ্যতের জন্য, কিন্তু তার হেদায়েতের আলােকবিভায় মাথানত করেছে আরবের সকল বিভূতি। সকল সিংহাসন পদানত হয়েছে তাঁর চরণতলে। শহরে প্রবেশ করে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তার হেদায়েতের আলােকবিভায় মাথানত করেছে আরবের সকল বিভূতি। সকল সিংহাসন পদানত হয়েছে তার চরণতলে। শহরে প্রবেশ করে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। শহরের এ-গলি ও-গলি ঘুরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তার পেছনে সারিবদ্ধ সাহাবিরা তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। তাদের মুখে ধ্বনিত হচ্ছিল বিজয়ের নাড়া। আল্লাহু আকবারের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল মক্কার পৌত্তলিক ইথারে রাসুল (সাঃ) এগিয়ে যাচ্ছিলেন সবার আগে আগে। তিনি কোথাও থামছেন না। রাসুল (সাঃ) এর পেছন পেছন আগত সাহাবি এবং মক্কার বিজিত অধিবাসীরা উৎসুকহয়ে আছে-মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায় যাচ্ছেন? একসময় তিনি এসে থামলেন হাজুন নামক স্থানের জান্নাতুল মুয়াল্লা করগাহে। এখানেই শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরা। ২৫ বছরের দাম্পত্যজীবনের এক বেহেশতি বন্ধন চাপা পড়ে আছে এই জান্নাতুল মুয়াল্লার শুকনাে মাটির তলে। প্রেম আর ভালােবাসার এক অতল আধার নিভৃতে ঘুমিয়ে আছে মুয়াল্লার নির্জন প্রান্তরে। ১০ বছর পর মক্কায় প্রবেশ করে তিনি সর্বপ্রথম হাজিরা দিতে এলেন তাঁর প্রিয়তমার কবরগাহে। খাদিজা (রাঃ) সেই অতলান্ত প্রেম এখনও ধূপশিখার মতাে বিধি জ্বলে আছে মুহাম্মদ (সাঃ) মনমুকুরে । কী করে ভুলবেন তিনি তার প্রথম প্রেম, প্রথম প্রিয়তমাকে! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রিয়তমার কবরের পাশে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত। বােবাকান্নায় অশ্রুত হৃদয়ের আহাজারি। এত দিন পর, এতগুলাে বছর পর আবার তিনি অশ্রুসজল হয়ে দাঁড়াতে পারলেন খাদিজা (রাঃ) কবরের পাশে। দূর মদিনায় কত দিন তিনি খাদিজার বিরহে ব্যথিত হয়েছেন, কত দিন তিনি খাদিজা (রাঃ) বেদনায় একা কেঁদেছেন, সে কথা তিনি আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আজ ব্যথাতুর । খাদিজা (রাঃ) তাে সেই কবেই চলে গিয়েছেন। তারপর চলে গেছেন এক-এক করে তিন কন্যাও-রােকাইয়া, উম্মে কুলসুম, জয়নব। সবাই তাদের মায়ের সঙ্গে গিয়ে শরিক হয়েছেন। দুই ছেলে তাে আগেই চলে গিয়েছিলেন। এখন কেবল ফাতেমা জীবিত আছেন। আজ এখানে দাঁড়িয়ে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যথায় আবার মুষড়ে পড়লেন। তবু আজ তিনি খাদিজার (রাঃ) পাশে এসে দাঁড়াতেপেরেছেন, ভালােবেসে অশ্রু বিগলিত হতে পেরেছেন। তিনি রবের শােকরিয়া জানালেন। আল্লাহর দরবারে হাত তুললেন। প্রিয়তমা খাদিজা (রাঃ) জন্য দোয়া করলেন আল্লাহর কাছে। সকল সাহাবির কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হতে লাগল- আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন। খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ) - অষ্টম (শেষ) অংশ || উম্মুল মুমিনিন || জান্নাতুন নেসা তারিন
source-md rehad sarker/youtube

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট