আয়েশা বিনতে আবু বকর (রাঃ) - দশম (শেষ অংশ)


দুই বছর পর । রাসুল (সাঃ)-পরবর্তী খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আবু বকরের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে। তিনি মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কী বারে ইন্তেকাল করেছিলেন?

আয়েশা উত্তর দিলেন, সােমবারে।' ‘আজ কী বার?" আজ সােমবার।' আবু বকর ওপরের দিকে নিঃসীম শূন্যতায় তাকিয়ে হৃদয়ের ব্যক্ততা প্রকাশ করে বললেন, 'আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, এ রাতের পর যেন আরেকটি রাত আমার জীবনে না আসে। আয়েশা (রাঃ) এর হৃদয়টা বেদনায় মােচড় দিয়ে উঠল। আয়েশা (রাঃ) এর চোখ জলে ভরে গেল। আবু বকর (রাঃ) মেয়েকে কাঁদতে নিষেধ করলেন। তিনি আয়েশা৷ (রাঃ) কাছে আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'রাসুল (সাঃ) কে কয়টি কাপড় দিয়ে কাফন দেওয়া হয়েছিল? আয়েশা (রাঃ) বিমূর্ত মুখে জবাব দিলেন, 'আমরা তাঁকে তিনটি কাপড় দিয়ে কাফন দিয়েছিলাম। এগুলাে সাহুলিয়া ছিল। তবে এর মাঝে তার মাথার রুমাল ও জুব্বা অন্তর্ভুক্ত নয়।' আবু বকর (রাঃ) নিজের পরনের কাপড়ের দিকে ইশারা করে বললেন, “আমাকে আমার পরনের কাপড় দিয়েই কাফন দিয়ে। এটাতে জাফরানের সামান্য দাগ আছে, কাফন দেওয়ার আগে ধুয়ে নিয়ে। এর সঙ্গে আর দুটো কাপড় যােগ মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা তার কাফনের জন্য পুরােনাে জামা বেছে নিলেন। কোনাে আড়ম্বরতা নেই, কোনাে লৌকিকতার বালাই নেই। একদম সাদামাটা বিদায়যাত্রার প্রস্তুতি। পিতার এমন কথা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল আয়েশা (রাঃ) এর । তিনি বললেন, কিন্তু আপনার জামা তাে পুরােনাে!' আবু বকর (রাঃ) শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, এই পুরােনাে জামাতেই হয়ে যাবে। মৃতদের চেয়ে জীবিতদের নতুন কাপড়ের বেশি প্রয়ােজন। কাফনের কাপড় তাে মাটির অত্যাচারে একসময় নষ্টই হয়ে যাবে।” আবু বকরের আরেকটি অন্তিম ইচ্ছা ছিল। তিনি চাচ্ছিলেন, রাসুল (সাঃ) এর পাশে যেন তাঁর কবর রচিত হয়। সারাটা জীবন যেভাবে তিনি রাসুলের সঙ্গে কাটিয়েছেন সকল মুহূর্ত, মৃত্যুর পরও তিনি সেভাবেই রাসুল (সাঃ) এর পাশে থাকতে চান। মক্কার পীড়নক্লিষ্ট দিনগুলােতে, গুহার অন্ধকারে, উহুদ যুদ্ধের সময়ে তিনি যেভাবে রাসুল (সাঃ) এর ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন, সেভাবে যেন মৃত্যুর পরও রাসুল (সাঃ) এর কবরসঙ্গী হতে পারেন। তিনি কন্যা আয়েশা (রাঃ) কাছে তার ঘরে রাসুল (সাঃ) এর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার আবেদন জানালেন। পিতার এমন আবেদনে আয়েশা (রাঃ) এর না করার কোনাে কারণ ছিল না। রাসুল (সাঃ) এর পর তিনিই তাে ইসলামকে পুনরুজ্জীবন করেছেন। আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুর পর তাঁকে আয়েশার ঘরে রাসুল (সাঃ) এর কবরের ডান পাশে সমাহিত করা হলাে। আয়েশা (রাঃ) এর স্বপ্নে দেখা দ্বিতীয় চাঁদ আজ খসে পড়ল তাঁর ভাঙা কুটিরে। প্রথম খলিফা আবু বকর (রাঃ) এর পর দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু ১০ বছর ইসলামি খেলাফতের শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত রইলেন। ইসলামের বিজয় নাকারাকে তিনি আরব থেকে আফ্রিকা-ইউরােপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন। যে ইসলাম হেরা গুহার অন্ধকারে বিভাসিত হয়েছিল ইকরা' ধ্বনির মাধ্যমে, তিনি সে ধ্বনিকে অর্ধেক পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত করলেন। একাধারে ১০ বছর ইসলামি খেলাফতের সেবা করার পর তাঁরও সময় হয়ে এল প্রিয়তম বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার। এক ভােরে মসজিদে নববিতে ফজরের নামাজে ইমামতির সময় ফিরােজ নাহওয়ান্দি আবু লুলু নামের এক পার্সিয়ান গুপ্তঘাতক তার পেটে বিষমাখা ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। পরপর ছয়বার আঘাতের ফলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। রক্তে ভেসে যেতে লাগল তার চারপাশ । মসজিদে নামাজরত লােকজন তাকে ধরে তার বাসভবনে নিয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে খুব বেশি সময় বাকি নেই আর। তিনি তাঁর ছেলে আবদুল্লাহকে কাছে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, তুমি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রাঃ) এর কাছে যাও। তাঁর কাছে গিয়ে বলবে না যে, খলিফা উমর (রাঃ) আমাকে পাঠিয়েছেন। বলবে, উমর ইবনে খাত্তাব আমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর কাছে আবেদন করবে-উমর তাঁর পূর্ববর্তী দুই বন্ধুর পাশে সমাহিত হতে চান।' অর্ধেক পৃথিবীর শাসনকর্তা উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। অনেক আগে থেকেই তাঁর মনে এ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তিনি খলিফা হওয়ার কারণে কখনাে আয়েশা (রাঃ) এর কাছে এমন আবেদন করতে পারেননি। হয়তাে আয়েশা (রাঃ) তাঁকে ভুল বুঝতে পারেন, উমর খলিফা হওয়ার কারণে এমন আবেদন করছেন। আয়েশা (রাঃ) হয়তাে খলিফার ক্ষমতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁকে অনুমতি দিয়ে দিতেন। আয়েশা (রাঃ) প্রথমে একটু থমকে গেলেন। কিন্তু ইসলামের জন্য উমরের ত্যাগ আর রাসুল (সাঃ) এর সঙ্গে তাঁর আন্তরিকতা মুহূর্তে তাঁকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্রতী করল। তিনি আবদুল্লাহকে বললেন, রাসুল (সাঃ) এর পাশের স্থানটি যদিও আমি নিজের জন্য মনে মনে নির্বাচন করে রেখেছিলাম, তবে উমরের জন্য সন্তুষ্টচিত্তে আমি তা। ছেড়ে দিচ্ছি। এ ব্যাপারে উমর (রাঃ) কে অগ্রাধিকার দিতে আমার দ্বিধা নেই।' উমর (রাঃ) মৃত্যুর পর রাসুল (সাঃ) এর বা পাশে সমাহিত করা হলো। সময় ফুরিয়ে আসছে। ১৩ জুন ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দ, ৫৭/৫৮ হিজরি সনের রমজান মাসের ১৭ তারিখ। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের শাসনকালের শেষ সময় চলছিল। উম্মুল মুমিনিন বেশ কয়েকদিন থেকে অসুস্থ। রাতের বেলা অসুস্থতা আরাে বেড়ে গেল। মসজিদে নববিতে আগত মুসল্লিরা এশার নামাজ শেষে তাঁর জন্য দোয়া করলেন। বেতের নামাজ শেষ করে যখন সবাই মসজিদে থেকে বেরুতে যাবেন, এমন সময় আয়েশার হুজরা থেকে মৃত্যুসংবাদ গুঙিয়ে ওঠল মদিনার বাতাসে। পুরাে মদিনা স্তব্ধ হয়ে গেল নিমেষে। কান্নার রােল পড়ে গেল ঘরে ঘরে। রাসুল (সাঃ) এর প্রেমময় জীবনের অনিঃশেষ আলােকবর্তিকা নিভে গেল আজ নিশিবেলায়। উম্মুল মুমিনিন মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তাকে যেন রাসুল (সাঃ) এর অন্য স্ত্রীদের সঙ্গে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয় এবং কাফনদাফনে যেন দেরি করা না হয়। যাতে লােকজন তার জানাজা দেখতে না পারে। তাঁর কথা মতাে এমনই করা হলাে। রাতেই তাহাজ্জুদের সময় তাঁকে। জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয়। রাতের বেলা হওয়া সত্ত্বেও জান্নাতুল বাকিতে এত লােকের সমাগম ঘটেছিল, এমন সমাগম এর আগে কখনাে দেখা যায়নি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সে সময় মদিনার ভারপ্রাপ্ত গভর্নর ছিলেন। তিনি জানাজার নামাজ পড়ান। কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান, আবদুল্লাহ ইবনে আতিক, উরওয়াহ ইবনে জুবায়ের এবং আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসুলের ভালােবাসার ছােট্ট পাখিকে মদিনার মাটির অতল অন্ধকারে শুইয়ে দেন। রাসুল (সাঃ) এর প্রিয়তমা আয়েশা (রাঃ) ঘুমিয়ে গেলেন রাসুল (সাঃ) এর শহরে। ভালােবাসার চিরন্তন সিলমােহর পৃথিবীর বুকে এঁটে দিয়ে গেলেন। যা অনাগত উম্মতকে দিশা দিয়ে যাবে অনন্তকাল। তিনি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি অবিস্মরণীয়। আয়েশা বিনতে আবু বকর (রাঃ) - দশম (শেষ অংশ) উম্মুল_মুমিনিন//by jannatunessa tarin
collected


Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট