ক্বুরআন খতমের পর ভুল আমল থেকে সাবধান!

 


ক্বুরআন খতমের পর ভুল আমল থেকে সাবধান! (১) খাতমে ক্বুরআনের দুয়া পড়ার কোন দলীল নেইঃ ক্বুরআন মাজীদের শেষ পৃষ্ঠার পর ‘দুআয়ে খাতমিল ক্বুরআন’ নামে লম্বা যেই দুআ প্রায় মুসহাফে ছাপা রয়েছে, এই দুআ ক্বুরআন বা হাদীসের কোথাও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা দুয়া। “ক্বুরআন খতম করার পর নির্দিষ্ট কোন দুআ নেই।” মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহঃ ২০/১৬৫, ১৮৬।

শায়খ বাকর আবু যায়দ রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “অনেকে বলে, খতমে ক্বুরআনের দুয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহি’মাহুল্লাহর লেখা। এর কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং এই দুয়া তাঁর দিকে সম্বন্ধ করা সঠিক নয়। বিধেয় নয় তারাবীহর সালাতে খাতমে ক্বুরআনের দুয়া পাঠ করা।” আল-আজযাউল হাদীসিয়্যাহঃ ২৯০ পৃষ্ঠা। (২) ক্বুরআন খতম করে তার সওয়াব মৃতদের নামে বকশানো যাবে? ক্বুরআন তিলাওয়াত করে মৃতদের নামে বখশে দিলে তার সওয়াব তারা পাবে না। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, وَأَن لَّيۡسَ لِلۡإِنسَٰنِ إِلَّا مَا سَعَىٰ ٣٩ “মানুষ নিজে যা উপার্জন করেছে তা ছাড়া সে অন্য কিছুই পাবেনা।” সুরা আন-নাজমঃ ৩৯। এই আয়াত হতে ইমাম শাফেয়ী রহি’মাহুল্লাহ হুকুম বেরে করেছেন যে, “ক্বুরআন তিলাওয়াত করে তার সওয়াব মৃতদের জন্য বখশিস করে দিলে তা তাদের কাছে পৌঁছাবে না। কারণ, তা সেই মৃত ব্যক্তির আমল নয়, আর না উপার্জন।” তাফসীর ইবনে কাসীর। সুতরাং আপনারা ক্বুরআন খতম দেওয়ার পর এই কথা বলবেন না যে, হে আল্লাহ! তুমি এর সওয়াব অমুকের আমল নামায় লিখে দেন। বরং ক্বুরআন খতমের পর মুনাজাতে বলবেন, হে আল্লাহ! তুমি অমুককে মাফ করে দাও, অমুকের প্রতি রহম করো, তাকে তুমি জান্নাত দান করো...।” (৩) মসজিদের ইমামকে দিয়ে ঘোষণা দেওয়াঃ অনেকে ক্বুরআন খতম দেওয়ার মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, সালাতের আগে বা পরে, জুমুআ’হর দিনে মুসল্লিমদেরকে যেনো বলে দুআ করার জন্য। এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং আপনি নিজে নিজে আপনার পছন্দ মোতাকে দুআ করবেন, মানুষের মাঝে ঘোষণা করার কোন প্রয়োজন বা উপকারীতে নেই। বরং এতে রিয়ার আশংকা আছে। (৪) মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে মসজিদের হুজুর বা মাদ্রাসার ছাত্র ভাড়া করে ক্বুরআন খতম দেওয়া বিদআ’তঃ ড. আব্দুল্লাহ জাহাংগীর রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “আমাদের দেশের অতি প্রচলিত কর্ম কারো মৃত্যু হলে তার জন্য ক্বুরআন খতম করা। এই আমলের ব্যাপারে কোন দলীল নেই। কোনো মৃত মানুষের জন্য রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ কখনো ক্বুরআন খতম করেননি। এছাড়া কারো জন্য কুরআন খতম করলে তিনি সাওয়াব পাবেন, এরূপ কোনো কথাও কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয় নি। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, কুরআন ও হাদীসে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সন্তানগণকে মৃত পিতামাতার জন্য দান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ, সিয়াম পালন, হজ্জ ও উমরা পালনের কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন খতম, তাসবীহ তাহলীল পাঠ ইত্যাদি ইবাদতের কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, যেহেতু দান, সিয়াম, হজ্জ, উমরা ও দোয়ার দ্বারা মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আশা করা যায় যে, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ তাহলীল ইত্যাদি ইবাদত দ্বারাও তারা উপকৃত হবেন। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতা, খতম ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।” হাদীসের নামে জালিয়াতি। ক্বুরআন খতমকারীর জন্য ফেরেশতারা দুয়া করেনঃ সাআ’দ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “ক্বুরআন খতম যদি রাতের প্রথমভাগে হয়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য মাগফিরাত (ক্ষমা) প্রার্থনা করতে থাকে। অনেক সময় আমাদের মাঝে কারো অল্প পরিমাণ ক্বুরআন (খতম পূর্ণ হওয়ার জন্য) বাকী থাকতো, তাহলে আমরা সকাল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত (খতম দেওয়া) বিলম্বিত করতাম।” সুনানে দারেমীঃ ৩৪৮৬, ইমাম নববী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। অর্থাৎ অল্প পরিমাণ ক্বুরআন বাকী রেখে কেউ যদি রাতের প্রথম অংশ (মাগরিবের পর) অথবা সকালে (ফযরের পর) ক্বুরআন খতম পূর্ণ করে, তাহলে সে বেশি সময় ধরে ফেরেশতাদের দুয়া লাভ করবে। এইজন্য কোন কোন সাহাবীর রাত বা দিন শুরু হওয়া পর্যন্ত ক্বুরআন খতম দেওয়াকে পিছিয়ে দেওয়ার অভ্যাস ছিলো। শায়খ আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “পূর্ববর্তী উলামা কিরামগণ রাতের প্রথমভাগে বা দিনের প্রথম প্রহরে ক্বুরআন খতম করা মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা যে ব্যক্তি রাতে ক্বুরআন খতম করে তার জন্য ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত দুয়া করতে থাকেন, আর যে দিনের বেলায় খতম করে তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দুআ করতে থাকে। এ মতটি সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে মাওকুফ সূত্রে বর্ণিত রয়েছে। ইমাম দারা ক্বুতনী এই বর্ণনাকে হাসান বলেছেন।” শায়খের লিখিত কিতাব “আল-ক্বুরআনের সুমহান মর্যাদা”। ক্বুরআন খতমের পর নতুন খতম শুরু করাঃ শায়খ ড. সা’দ বিন নাসির আস-শাষরী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “ইমাম আল-ক্বুরতুবী রহি’মাহুল্লাহ বলেছেন, “ক্বুরআন তিলাওয়াতের একটি আদব হচ্ছে, যখন সম্পূর্ণ ক্বুরআন খতম (অর্থাৎ সম্পূর্ণ ক্বুরআন পড়া একবার শেষ হবে) তখন প্রথম থেকে পুনরায় শুরু করা।” ইমাম ক্বুরতুবী রচিত “মুক্বাদ্দিমা আহকামিল ক্বুরআন”-এর ব্যাখ্যা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যেনো ক্বুরআন খতম দেওয়ার পর আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে যে, আমার ক্বুরআন পড়া শেষ। বরং এক খতম দেওয়ার পরে পুনরায় আরেক খতমের পড়া শুরু করবে, যাতে করে পরের খতম যেন সময়মতো শেষ করতে পারে সেইদিকে সে সতর্ক থাকে।
*******************************************************
আপনি শেষ কবে ক্বুরআন খতম দিয়েছেন? আমরা সকলেই জানি, মহাগ্রন্থ আল-ক্বুরআন আল্লাহর কালাম। এই ক্বুরআন পড়া অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারী বিশেষ একটা ইবাদত। “ক্বুরআন খতম দেওয়া” অর্থাৎ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ক্বুরআন একবার পড়ে শেষ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা আমল, যে ব্যাপারে আমাদের অনেকেই উদাসীন হয়ে আছি। এমন অনেকেই আছে, যাদের বাবা-মা ছোটবেলায় হুজুর রেখে একবার ক্বুরআন খতম দিয়েছিল, কিন্তু বড় হওয়ার পরে তাদের আর কোনদিন ক্বুরআন খতম দেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি! আবার অনেকে এক বছর বা দুই বছর হয়ে যায়, তবুও তাদের ক্বুরআন খতম শেষ হয় না। অনেকে শেষ কবে ক্বুরআন খতম দিয়েছিলো, সেটাই বলতে পারবে না। নিঃসন্দেহে এটা কোন ব্যক্তির ক্বুরআনকে অবহেলা করার স্পষ্ট নিদর্শন, মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। আমি প্রথমে নিজেকে এবং আমার প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনদেরকে আন্তরিক আহবান জানাবো, আপনারা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ক্বুরআন তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট করুন। সারা দিনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেনো, আপনার এই আমল যেনো কোনমতেই মিস না হয়। আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিদিন অন্তত অর্ধেক পারা, এক বা দুই পারা, বা যদি সম্ভব হয় আরো বেশি ক্বুরআন পড়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যেনো আপনার একবার ক্বুরআন খতম সম্পন্ন হয় সেই লক্ষ্য স্থির করবেন। শায়খ আব্দুর রাক্বীব বুখারী হা’ফিজাহুল্লাহ সমস্ত মুসলিমদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, “ক্বুরআনুল কারীম যেন প্রতিদিন আপনার সংগী হয়। আপনি যেন প্রতিদিন ক্বুরআনুল কারীমের কিছু অংশ আরবীতে তিলাওয়াত করেন, এর অর্থ পড়েন, এর ব্যাখ্যা বুঝার চেষ্টা করবেন। আপনি ক্বুরআনুল কারীমের সাথে যত বেশি সময় দেবেন, আপনার জন্য তত ভালো। বেশি পড়তে না পারলে অন্তত আধা ঘন্টা, পনের মিনিট, দশ মিনিট এমনকি পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও প্রতিদিন ক্বুরআন পড়ার চেষ্টা করবেন। এমন কোন দিন যেন না যায় যে, আপনি সেইদিন আপনার নির্ধারিত ক্বুরআনের অংশ পড়েননি। প্রতিদিন অন্তত তিনটা আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়ুন। এই ক্বুরআনুল কারীম তিলাওয়াতের দুনিয়া এবং আখিরাতে অনেক উপকার রয়েছে। ক্বুরআন ক্বিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে।” কত দিনে ক্বুরআন খতম দেওয়া উচিত? শায়খ আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “আল্লাহর কিতাব হতে মুসলিমের গাফিল হওয়া উচিত নয়। ক্বুরআন তিলাওয়াত করে খতম করা উচিত। সালাফগণের অভ্যাস ছিল ক্বুরআন খতম করা। তাদের কেউ কেউ দুই মাসে এক খতম করতেন, কেউ আবার মাসে একবার খতম করতেন, আবার কেউ দশ দিনে, আট দিনে খতম করতেন। অধিকাংশে সাত দিনে খতম করতেন, আবার কেউ এর চেয়ে কম সময়েও খতম করতেন। উত্তম হচ্ছে সাত দিনে খতম করা, কেননা তা এক দল সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত, যেহেতু তারা ক্বুরআনকে সাত হিযবে ভাগ করেছেন। তাঁরা প্রতিদিন এক হিযব পরিমাণ ক্বুরআন পড়তেন।” শায়খের লিখিত কিতাব “আল-ক্বুরআনের সুমহান মর্যাদা”। এ সম্পর্কিত হাদীসের দলীলঃ (১) আ’বদুল্লাহ ইবনু আ’মর রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছেন, তুমি ক্বুরআন এক মাসে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি এর চাইতে অধিক সামর্থ রাখি। তিনি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে বিশ দিনে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি এর চাইতে বেশি সামর্থ রাখি। তিনি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে পনের দিনে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি এর চাইতেও অধিক শক্তি রাখি। তিনি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে দশ দিনে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি আরো সামর্থ রাখি। তিনি সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে সাত দিনে, কিন্তু এর চাইতে কম সময়ে খতম করবে না। সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ফাযায়িলি ক্বুরআন, হাদীস নং-৫০৫৪। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ সিয়াম, অনুঃ আজীবন রোযা রাখা নিষেধ। আবু দাউদঃ ১৩৮৮। ইমাম আবূ দাউদ রহি’মাহুল্লাহ বলেন, সহীহ মুসলিমের বর্ণনাটি পরিপূর্ণ। (২) আ’বদুল্লাহ ইবনু আ’মর রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা সূত্রে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে ক্বুরআন খতমের সময়সীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, চল্লিশ দিনে। অতঃপর বলেনঃ এক মাসে, অতঃপর বলেনঃ বিশ দিনে, অতঃপর বলেনঃ পনের দিনে, অতঃপর বলেনঃ দশ দিনে, সর্বশেষে বলেন, সাত দিনে।” আবু দাউদঃ ১৩৯৫। সুনানে আত-তিরমিযী, অধ্যায়ঃ ক্বিরাআত, হাদীস নং-৮০৬৯। (৩) আ’বদুল্লাহ ইবনু আ’মর রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি ক্বুরআন এক মাসে খতম করবে। তিনি বলেন, আমার এর চাইতে অধিক শক্তি আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাহলে তিন দিনে খতম করবে। আবু দাউদঃ ১৩৯১। হাসান সহীহ। তিনদিনের কম সময়ে ক্বুরআন খতম দেওয়া উচিত নয়ঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তিনদিনের কম সময়ে যে ব্যক্তি ক্বুরআন খতম করবে, সে ক্বুরআন বুঝবে না।” আবু দাউদঃ ১৩৯৬। উল্লেখ্য এই নিষেধাজ্ঞা সাধারণ সময়ের জন্য। রমাদ্বানের ফযীলতপূর্ণ সময়ে আমাদের সালাফগণ যখন নেক আমলের সওয়াব বাড়ানো হয়, তখন অনেকেই তিন দিনের কম সময়েও একবার ক্বুরআন খতম দিতেন। আগের যুগের নেককার লোকেরা ক্বুরআন খতম দেওয়াকে গুরুত্ব দিতেনঃ (১) আব্দুর রহমান ইবনু আবী লাইলা রহি’মাহুল্লাহ (মৃত্যু ৮৩ হিজরী) একজন সিনিয়ার নেককার তাবেয়ী ছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনু আবী লাইলা সম্পর্কে তাঁর একজন সাথী ছাবিত রহি’মাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, “আব্দুর রহমান ইবনু আবী লাইলা রহি’মাহুল্লাহ ফযর সালাত আদায় করার পর সূর্য্য উদিত হওয়া পর্যন্ত ক্বুরআন পড়তেন।” এই রেওয়ায়েতের একজন রাবী বলেন, “ছাবিত রহি’মাহুল্লাহ নিজেও একই কাজ করতেন।” সুনানে আদ-দারেমীঃ ৩৩৯০, ইবনু সা’দ, আত তাবাকাতঃ ৬/৭৫। সনদ সহীহ। (২) হাদীসের বিখ্যাত ইমাম কাতাদা রহি’মাহুল্লাহ (মৃত্যু ১২০ অথবা ১২৯ হিজরী), তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সর্বদা প্রতি সপ্তাহে একবার অর্থাৎ সাত দিনে ক্বুরআন খতম করতেন। আর রমাদ্বানের প্রতি তিন দিনে তিনি একবার খতম করতেন এবং রমাদ্বানের শেষ দশদিন প্রতিদিন এক খতম করে পড়তেন। (রমযান মাসের ৩০ আসর)। (৩) সৌদি আরবের প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন শায়খ মুহাম্ম’দ বিন সালিহ আল-উসায়মিন রহি’মাহুলাহর (মৃত্যু-২০০১) দৈনন্দিন আমল বর্ণনা করে শায়খ সামি আল-সুক্বাইর হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “শায়খ ইবনে উসায়মিন রহি’মাহুলাহ যুহরের চার রাকআ’ত সুন্নত সালাত ঘরে আদায় করতেন। এরপরে তিনি মসজিদে যেতেন। তিনি যুহর ও আসরের ওয়াক্তে মসজিদে যেতে যেতে ক্বুরআন পড়তেন। এইভাবে তিনি আধা পারার বেশি ক্বুরআন পড়তেন। রমাদ্বানের বাহিরে সারা বছর ধরে তাঁর অভ্যাস ছিলো, প্রতিদিন দুই পারা ক্বুরআন পড়া। এইভাবে তিনি প্রতি মাসে দুই বার ক্বুরআন খতম দিতেন। আর রমাদ্বানে তিনি প্রতি তিন দিনে একবার ক্বুরআন খতম দিতেন। অর্থাৎ রমাদ্বানে একদিনে তিনি দশ পারা ক্বুরআন না দেখে মুখস্থ পড়তেন।” (৪) মদীনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, মসজিদে নববীর মুদাররিস শায়খ আব্দুর রাজ্জাক্ব আল-বদর হা’ফিজাহুল্লাহর দৈনিক আমল সম্পর্কে উস্তাদ আবু আওযায়ী আব্দুস সালাম হা’ফিজাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, “শায়খ আব্দুর রাজ্জাক্ব আল-বদর হা’ফিজাহুল্লাহ আসর সালাতের পর প্রায় দুই ঘন্টা সময় ধরে সন্ধ্যা বেলার যিকির ও ক্বুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করেন।” চিন্তা করুন, যদি সন্ধ্যাবেলার যিকিরগুলো করতে সর্বোচ্চ আধা ঘন্টার মতো সময় লাগে, তাহলে শায়খ আব্দুর রাজ্জাক্ব আল-বদর হা’ফিজাহুল্লাহ আসরের পর মাগরিবের পূর্বে প্রায় দেড় ঘন্টার মতো সময় ক্বুরআন পড়ার জন্য ব্যয় করেন। আপনি মনে করতে পারেন, উনারা তো বড় আলেম ছিলেন, একারণে আল্লাহ তাঁদের জন্য ক্বুরআন পড়া সহজ করে দিয়েছিলেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য কি এমন ক্বুরআন পড়া সম্ভব? আল্লাহ চাইলে সম্ভব। পূর্ব যুগে মুসলিম উম্মতের নেককার সাধারণ লোকেরাও অনেক ক্বুরআন পড়তেন। (৫) আমার মায়ের এক চাচা প্রতিদিন ফযর সালাতের পর ঘরে ফিরে সকাল পর্যন্ত উচ্চস্বরে দীর্ঘ সময় ক্বুরআন পড়তেন। এমনকি তাঁর ক্বুরআন তিলাওয়াত বাড়ির আঙ্গিনার অন্য প্রান্ত থেকে শোনা যেতো। এটা আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগের কথা, আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। (৬) কয়েক বছর আগে মদীনা থেকে পাশ করা বাংলাদেশি একজন শায়খ তার মায়ের আমল বর্ণনা করেছিলেন। শায়খের মা সারা জীবন প্রতি মাসে দুই বার ক্বুরআন খতম দিতেন। বৃদ্ধ হয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে এখন তিনি প্রতি মাসে একবার ক্বুরআন খতম দেন। আগে এমন অনেক নেককার লোক ছিলেন, যারা খুব বেশি ক্বুরআন পড়তেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম সমাজে সত্যিকার অর্থে ক্বুরআন পড়া মুসলমানদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। আর একারণে মুসলমানদের মাঝে এখন নাস্তিক্যবাদ, খুন, সমকামীতা, ধর্ষণ, সুদ, ঘুষ, জিনা-ব্যভিচার, পরকীয়া, ধোঁকাবাজি এবং পাপী লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। আল্লাহ আমাদেকে হেফাযত করুন। যাই হোক, আপনি যদি আন্তুরিক চেষ্টা করেন, আল্লাহ চাইলে আপনার দ্বারাও নিয়মিত ক্বুরআন খতম দেওয়া সম্ভব। সেই লক্ষ্যে আপনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুয়া করুন, আল্লাহ যেনো আপনাকে সহীহভাবে তিলাওয়াত করতে পারেন। নফল বা সুন্নত সালাতের সিজদাতে এই দুয়া পড়ার চেষ্টা করুনঃ اللّٰهُمَّجْعَلَ القُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِي، وَنُوْرَ صَدْرِي، وَجَلاَءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّيْ অর্থঃ আল্লা-হুম্মাজআ’লাল ক্বুরআ-না রবীআ’ ক্বালবী, ওয়া নূরা ছদরী, ওয়া জালা-আ হুযনী, ওয়া যাহা-বা হাম্মী। অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি ক্বুরআনকে বানিয়ে দাও আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার বক্ষের নূর (জ্যোতি), আমার দুঃখের অপসারণকারী এবং দুঃশ্চিন্তার দূরকারী। ক্বুরআন খতম দেওয়ার পর কি দুয়া পড়বেন?এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ক্বুরআন খতম করা ‘মুস্তাহাব’ বা উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয় একটি আমল। যেকোন নেক আমলের পর সেই আমলের উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুয়া করা যায়। এটা দুয়া কবুলের জন্য একপ্রকার বৈধ উসীলা। সুতরাং যখনই আপনার ক্বুরআন খতম সম্পন্ন হবে, তখন আপনি আল্লাহ তাআ’লার কাছে মুনাজাত করার চেষ্টা করবেন। (১) মুনাজাতের আদব হিসেবে দুই হাত তুলে হা’মদ ও সানার পর দুরুদ পড়বেন। অতঃপর আপনার পছন্দমতো দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত কল্যাণের জন্য দুয়া করবেন। (২) সর্বপ্রথম দুয়া করবেন, আল্লাহ যেনো আপনার ক্বুরআন পড়ার মাঝে যেই ভুল-ত্রুটি হয়েছে তা মাফ করে দেন। আল্লাহ যেনো দয়া করে আপনার ক্বুরআন পড়া কবুল করে নেন। আপনি যেনো আরো সুন্দর ও সহীহভাবে, যেইভাবে আল্লাহ ভালোবাসেন, সেইভাবে ক্বুরআন পড়তে পারেন তার জন্য প্রার্থনা করবেন। (৩) অতঃপর দয়াময় আল্লাহ যেনো এই ক্বুরআন খতমের উসীলায় আপনাকে ক্ষমা করেন, আপনার পিতা-মাতা, আপনার পরিবার-পরিজন এবং সমস্ত মুমিন মুসলিমদেরকে মাফ করেন এই দুয়া করবেন। (৪) অতঃপর আপনার পছন্দমতো যেকোন দুয়া, বিশেষ কোন নেক প্রার্থনা থাকলে তা বলবেন। (৫) পুনরায় দুরুদ এবং সানা পড়ে মুনাজাত শেষ করবেন। আপনি চাইলে ক্বুরআন খতমের পর আপনার পরিবারের লোকদেরকে নিয়ে একত্রে মুনাজাত করতে পারেন, এটা করা জায়েজ আছে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি সাল্লামের খাদেম, বিশিষ্ট আনসারী সাহাবী আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর আমল ছিলো, “যখন তিনি ক্বুরআন খতম করতেন, তখন তিনি তাঁর পরিবারের লোকদেরকে সমবেত করে দুআ করতেন।” ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ, দারেমী, ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ ৭/১৭২।

*************************************************
❖ কিয়ামতের দিন “গুররান-মুহাজ্জালীন” বলে কাদেরকে ডাকা হবে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি হবেঃ যারা নিয়মিত ওযু করেন। সর্বাবস্থায় অজুকারী উম্মতদেরকে কেয়ামতের দিন তাদেরকে "গুররান-মুহাজ্জালীন" বলে ডাকা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও; এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে।] (সূরা মায়িদা, আয়াত নং-৬) নু’আইম আল-মুজমির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মসজিদের ছাদে উঠলাম। তিনি ওযু করে বললেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আমার উম্মতদেরকে কেয়ামতের দিন তাদেরকে ‘গুররান-মুহাজ্জালীন’ বলে ডাকা হবে। (অর্থাৎ ওযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো উজ্জ্বল অবস্থায় উপস্থিত হবে) কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার উজ্জ্বলতাকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম, সে যেন তা (বৃদ্ধি) করে। [বুখারী ১৩৬]

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট