আল্লাহ তাআ’লার নৈকট্য অর্জনের আমল

 


আল্লাহ তাআ’লার নৈকট্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত সহজ তিনটি আমল: মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে যাকে ভালোবাসে সে তার নৈকট্য অনুসন্ধান করে। মুমিন বান্দারা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে মহান আল্লাহকে, যার স্বীকৃতি দিয়ে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেনঃ

وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ وَلَوۡ يَرَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡ يَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥ “আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ রূপে গ্রহণ করে, তারা তাদেরকে ভালবাসে আল্লাহকে ভালবাসার মতোই। পক্ষান্তরে, যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে ভালবাসে সবচেয়ে বেশি।” সুরা আল-বাক্বারাহঃ ১৬৫। যেকোন নেক আমল সম্পাদন করা কিংবা যেকোন পাপ কাজ বর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভ করা যায়। তবে বান্দার সমস্ত আমলের মাঝে এমন কিছু বিশেষ আমল রয়েছে যেইগুলো আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন, যার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। এমনই কতগুলো নেক আমলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো, যেইগুলো আমল করা সহজ কিন্তু যার বিনিময়ে বান্দা সবচেয়ে বেশি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। (১) সিজদাঃ সিজদা এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা তার শরীর ও মন দিয়ে তার রব্বের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আনুগত্য প্রকাশ করে। একারণে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সিজদা করা হারাম এবং কুফুরী। সিজদার মাধ্যমে বান্দা তার শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ মাথাকে আল্লাহর সামনে জমীনে নত করে, অত্যন্ত বিনীত অন্তর নিয়ে নিজের দীনতা প্রকাশ করে এবং তার মহান রব্বের পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করে। মহান আল্লাহ ক্বুরআনে ওয়াহী নাযিলের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে সিজদার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে আদেশ করে বলেন, “তুমি সিজদা করো আর (আল্লাহর) নৈকট্য লাভ করো।” সুরা আল-আ’লাক্বঃ ১৯। *এটা সিজদার আয়াত, এই আয়াতের অংশটুকু যারা আরবীতে পড়বেন তারা রব্বের উদ্দেশ্যে একটি সিজদা করে নিবেন ইন শা আল্লাহ। তিলাওয়াতের সিজদার জন্য অযু শর্ত নয়। সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়, একারণে সিজদার সময় বান্দার দুআ বেশি কবুল হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বান্দা সিজদার সময় স্বীয় রব্বের সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয়। সুতরাং তোমরা (ঐ অবস্থায়) অধিক মাত্রায় দুআ কর।” সহীহ মুসলিমঃ ৪৮২, নাসায়ীঃ ১১৩৭, আবু দাউদঃ ৮৭৫, আহমাদঃ ৯১৬৫। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, “তোমরা সিজদায় দুআ করতে সচেষ্ট হও। কেননা, তোমাদের জন্য সেই দুআ কবুল হওয়ার উপযুক্ত।” সহীহ মুসলিমঃ ৪৭৯, নাসায়ীঃ ১০৪৫। উল্লেখ্য নামায, তিলাওয়াতের সিজদা এবং শুকরিয়ার সিজদা ছাড়া এমনিতে সিজদা করা জায়েজ নয়। সেইজন্য সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কিংবা সিজদাতে দুআ করার জন্য বেশি বেশি নফল এবং সুন্নত নামায পড়া উচিত। (২) ভিক্ষুকের মতো দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দুআ করাঃ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং সম্মানিত একটি আমল হচ্ছে দুআ। দুআর মাধ্যমে বান্দা তার রব্বের প্রতি ‘ইখলাস’ বা আন্তরিক বিশ্বাস এবং ‘তাওয়াক্কুল’ বা পূর্ণ আস্থা প্রদর্শন করে। একারণে, বান্দা যত আমল করে তার মাঝে দুআ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় একটি আমল। আমাদের দুআর উদ্দেশ্য সম্পর্কে শায়খ আব্দুর রাক্বীব বুখারী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “দুআতে আসলে কি হয়? (ক) দুআর মাধ্যমে একজন বান্দা তাঁর রব্বের কাছে আশ্রয় চায়, প্রার্থনা করে; যিনি দিতে সক্ষম তাঁর কাছে। (খ) যিনি দিতে পারবেন, যিনি ক্ষমতাবান তাঁর কাছে সে নিজের অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে আবেদন করা হয়। (গ) বান্দা তার হাব-ভাবে এটা বলতে চায়, “হে আমার রব্ব! তুমি হচ্ছ দাতা আর আমার কোন ক্ষমতা নেই।” (ঘ) দুআর মাধ্যমে দুআকারী নিজের দীনতা, হীনতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আর যার কাছে দুআ করা হয় তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও দানশীলতার আত্মিক ও মৌখিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেকারণে, দুআ হচ্ছে ইবাদত, যেটা আল্লাহ চানঃ বান্দা নিজেকে বিনয় ও নম্র করে, নিজেকে ছোট মনে করে সে তার মাবূদ বা রব্বের কাছে প্রার্থনা করে। এই ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের রব্ব বলেন, তোমরা আমার কাছে দুআ করো, আমি তোমাদের দুআ কবুল করবো।” নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআ’লার নিকট দুআর চেয়ে কোন জিনিস বেশি সম্মানিত নয়।” তিরমিযীঃ ৩৩৭০, ইবনে মাজাহঃ ৩৮২৯, হাদীসটি হাসান। দুআ আল্লাহর নিকট এতো প্রিয় একটি আমল যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআ’লার নিকট দুআ করে না, আল্লাহ তাআ’লা তার উপর রাগান্বিত হন।” তিরমিযীঃ ৩৩৭৩, ইবনে মাজাহঃ ৩৮২৭, হাদীসটি হাসান। দুআর একটি আদব হচ্ছে, ভিক্ষুকের মতো দুই হাত আকাশের দিকে তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করা। এইভাবে দুআ করলে আল্লাহ তাআ’লা সেই দুআ ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন, সুবহা’নাল্লাহ! প্রিয়নবী মুহা’ম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের রব্ব চিরঞ্জীব, দানশীল। তাঁর কোন বান্দা নিজের দুই হাত তুলে তাঁর নিকট দুআ করলে তিনি বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জা বোধ করেন।” আবু দাউদঃ ১৪৮৮, তিরমিযীঃ ৩৫৫৬, হাদীসটি সহীহ। উল্লেখ্য দুআ বা মুনাজাতের সময় হাত তোলা মুস্তাহাব, ফরয নয়। সুতরাং হাত তুলে কিংবা হাত না তুলে, যেইভাবে ইচ্ছ দুআ করা যায়। তবে সুযোগ থাকলে হাত তুলে দুআ করা উত্তম। (৩) শেষ রাতে আল্লাহর যিকির করাঃ রাতের শেষ অংশের ঘুম আমাদের সবার নিকট খুবই প্রিয়। একারণে অধিকাংশ মানুষ সেই সময় ঘুমে কাটায়। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লার কিছু প্রিয় বান্দা সেই সময়ে তাহাজ্জুদ নামায, ক্বুরআন তিলাওয়াত, তাওবা-ইস্তিগফার কিংবা দুআর মাধ্যমে আল্লাহর যিকির বা আল্লাহর স্মরণে কাটায়। কেননা সেই সময়ে মহান আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন আর ফযরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া পর্যন্ত তাঁর বান্দাদেরকে আহবান করতে থাকেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদার অধিকারী, বারকতময় রব্ব দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, “যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু দুআ করবে, আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।” সহীহ মুসলিমের অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন “তারপর তিনি (আল্লাহ তাআ’লা) হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন লোককে কর্য দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন।” সহীহ বুখারীঃ ১১৪৫, সহীহ মুসলিমঃ ৭৫৮, মিশকাত আল-মাসাবীহঃ ১২২৩। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ স্বয়ং আমাদের নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে তাঁর বান্দাদেরকে আহবান করতে থাকেন। একারণে শেষ রাতে আরামের ঘুম ত্যাগ করে মহান আল্লাহর যিকির করার মাধ্যমে আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন হয়। আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমর ইবনু আবাসাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “মহান আল্লাহ শেষ রাতে তাঁর বান্দার সবচেয়ে অধিক নিকটবর্তী হন। সুতরাং তুমি যদি পারো সেই সময়ে যারা আল্লাহর যিকির করে তাদের অন্তভুক্ত হও।” তিরমিযীঃ ৩৫৭৯, সহীহঃ তাঅ’লীকুর রাগীবঃ ২/২৭৬, মিশকাত আল-মাসাবীহঃ ১২২৯।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট