আয়াতুল কুরসি


 আয়াতুল কুরসিঃ সুরা বাক্বারাহর ২৫৫ নাম্বার আয়াতকে ‘আয়াতুল কুরসী’ বলা হয়। আয়াতুল কুরসীতে তাওহীদ, ইখলাস, আল্লাহর ইসমে আযম, আল্লাহর ক্ষমতা ও সিফাত, ‘আল্লাহর কুরসির’ মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এইজন্য এই আয়াতটি হচ্ছে ক্বুরানুল কারীমের শ্রেষ্ঠ আয়াত বলা হয়েছে এবং সহীহ হাদিসে এই আয়াতটি বিভিন্ন সময়ে পাঠ করার অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, আয়াতুল কুরসী হচ্ছে সুরা বাক্বারাহর ২৫৫ ও ২৫৬ নাম্বার। এটা ভুল! সুরা বাক্বারাহর শুধুমাত্র ২৫৫ নাম্বার আয়াতটিকেই আয়াতুল কুরসী বলা হয়, ২৫৬ নাম্বার আয়াত আয়াতুল কুরসির অন্তর্ভুক্ত নয়।

আয়াতুল কুরসী নিয়মিত পড়লে কুফুরী কালাম, তাবীজ-কবজ, যাদু, চোখের নজর, জিনের আসর বা ক্ষতি ও অন্যান্য বিপদ আপদ থেকে সুরক্ষা করে। প্রত্যেক ফরয সালাতের পরে একবার করে আয়াতুল কুরসি পড়লে মৃত্যুর পরে রয়েছে জান্নাত। শয়তানের প্রভাব এবং ভূত-প্রেত থেকে বাঁচার জন্য আয়াতুল কুরসি পাঠ করা পরীক্ষিত একটি আমল। আয়াতুল কুরসী ক্বুরানুল কারীমের শ্রেষ্ঠ বা সবচাইতে মর্যাদাবান আয়াত। আবু জর জুনদুব ইবনে জানাদাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উপর নাযিলকৃত কোন আয়াতটি সবচাইতে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আয়াতুল কুরসী।” নাসায়ী, আহমাদ। দিনে রাতে মোট আট বার আয়াতুল কুরসী পাঠ করা সুন্নাহঃ (১) প্রতিদিন সকালে একবার বিকালে একবারঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালবেলা আয়াতুল কুরসী পাঠ পড়বে, বিকাল হওয়া পর্যন্ত সে জিন শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিকালে পড়বে, সে সকাল হওয়া পর্যন্ত জিন শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে থাকবে।” হাকিমঃ ১/৫৬২। (২) প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে একবারঃ প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে আয়াতুল কুরসী একবার পাঠ করার ফযীলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, মৃত্যু ছাড়া আর কোন কিছুই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।” ইবনে সুন্নীঃ ১২০, নাসায়ী, ইবনু হিব্বান, হাদীস সহীহ, শায়খ আলবানী, সিলসিলা সহীহাহঃ ৯৭২। (৩) রাতে বিছানায় শয়ন করে ঘুমানোর পূর্বে একবারঃ ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করার ফযীলত সম্পর্কে সহীহ বুখারীর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “যখন তুমি বিছানায় ঘুমুতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর সব সময় একজন হেফাযতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।” সহীহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬১, হাদিস নং-৫৩০। এখানে হাদীসটা আসলে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা আসলে এক জিনের সাথে এক সাহাবীর আশ্চর্যজনক দীর্ঘ একটা ঘটনার ছোট্ট একটা অংশ। সম্পূর্ণ কাহিনীটা জানার জন্য আপনারা রিয়াদুস সালেহীনের ১০২২-নং হাদীস দেখতে পারেন। মুখস্থ করার টিপসঃ আয়াতুল কুরসীর সুন্দর দেখে একটি তেলাওয়াত নিয়ে প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ বার করে শুনুন। শোনার সাথে সাথে কয়েকবার করে দেখে দেখে পড়বেন। এইভাবে ৩-৪ দিন বা আরো বেশিদিন চেষ্টা করলে ইন শা’আল্লাহ অনেক কম সময়ের মাঝেই আয়াতুল কুরসী বা যেকোন দুয়া, সুরা সহজেই মুখস্থ করে ফেলতে পারবেন। তার জন্য দরকার আপনার চেষ্টা ও আন্তরিক ইচ্ছা। আয়াতুল কুরসীর সা’দ আল-গামদির তেলাওয়াত খুব সুন্দর, আপনার তার বা অন্য যে কারো তিলাওয়াত শুনে শুনে মুখস্থ করতে পারেন। আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম। اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ উচ্চারণঃ আল্লা-হু লা- ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হা’ইয়ুল ক্বাইয়ূম। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ-ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিস-সামা-ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ। মাং যাল্লাযী ইয়াশফাউ’ ই’ন্দাহু ইল্লা বি-ইযনিহ। ইয়া’লামু মা বাইনা আয়দীহিম ওয়ামা খালফাহুম, ওয়ালা ইউহী’তুনা বিশাইয়িম-মিন ই’লমিহী ইল্লা বিমা-শা’-আ; ওয়াসিআ’ কুরসি-ইয়ুহুস-সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ; ওয়ালা ইয়াউদুহু হি’ফযুহুম, ওয়া হুওয়াল আ’লিইয়ুল আ’যীম। অর্থঃ আল্লাহ! যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। কোন তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবকিছু তাঁরই মালিকানাধীন। তাঁর হুকুম ব্যতীত এমন কে আছে যে তাঁর নিকটে সুপারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে, সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসমুদ্র হতে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতুটুকু তিনি দিতে ইচ্ছা করেন। তাঁর কুরসী সমগ্র আসমান ও যমীন পরিবেষ্টন করে আছে। আর সেগুলির তত্ত্বাবধান তাঁকে মোটেই ক্লান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহান। ‘আল্লাহর কুরসী’ (১) যদিও কুরসী শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, চেয়ার বা বসার আসন। কিন্তু সঠিক মত অনুযায়ী, কুরসী অর্থ হচ্ছে পা রাখার জায়গা। মহান আল্লাহ বলেন, وَسِعَ كُرْسِـيُّهُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ উচ্চারণঃ ওয়াসিআ’ কুরসি-ইয়ুহুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ। অর্থঃ তাঁর (আল্লাহর) কুরসী সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টন করে আছে। ক্বুরআনের মুফাসসির, প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহু এই আয়াত সম্পর্কে বলেছেন, “কুরসী হচ্ছে পা রাখার জায়গা, আর আল্লাহ ছাড়া কেউ কোনদিন কল্পনাও করতে পারবে না যে আরশ কত বড়।” মাওক্বুফ সনদে বর্ণনা করেছেন ইবনে আবি শায়বা তাঁর ‘সিফাত আল-আ’রশ, এবং হাকিম তাঁর মুসতাদরাক-এ, বর্ণনাটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। (২) কুরসী আল্লাহ তাআ’লার বৃহৎ সৃষ্টির একটি। আল্লাহ তাআ’লা কুরসীর বর্ণনায় বলেন যে, আল্লাহর কুরসী আকাশ এবং যমীন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। তার প্রশস্ততা, আকৃতির বড়ত্ব এবং ক্ষেত্রের বিশালতার কারণে। ভূমণ্ডল এবং নভোমন্ডলের তুলনা কুরসীর সাথে খুবই ক্ষীণ তুলনা। যেমন কুরসীর তুলনা আরশের সাথে দুর্বল তুলনা। আবু যর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেন, আমি মসজিদে হারামে প্রবেশ করি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে একাকী দেখে তাঁর পাশে বসে পড়ি এবং জিজ্ঞাসা করি, “হে আল্লাহর রাসুল! আপনার প্রতি নাযিল হওয়া কোন আয়াতটি শ্রেষ্ঠ?” তিনি বললেন, “আয়াতুল কুরসী; আল্লাহর কুরসী এতো বড় যে, কুরসীর তুলনায় আসমান এবং যমীন যেন মরূভূমিতে পড়ে থাকা একটি আংটির মতো। আর আরশের শ্রেষ্ঠত্ব কুরসীর তুলনায়, যেমন মরূভূমির শ্রেষ্ঠত্ব সেই বালার প্রতি।” হিলইয়াহঃ ১/১৬৬, আযামাহঃ ২/৬৪৮-৬৪৯, আসমা ওয়াস সিফাত, বায়হাকীঃ ২/৩০০-৩০১, সহীহ শাইখ আলবানী। সিলসিলা সহীহাহঃ ১০৯। (৩) ইবনে যায়েদ বলেন, “আমার পিতা আমাকে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “কুরসীর মধ্যে সপ্তাকাশের অবস্থান ঠিক যেন, একটি ঢালের মধ্যে নিক্ষিপ্ত সাতটি দিরহামের (মুদ্রার) মত।” তিনি বলেন, আবু যর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালামকে একথা বলতে শুনেছি, “আরশের মধ্যে কুরসীর অবস্থান হচ্ছে ঠিক ভূপৃষ্ঠের কোন উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকা একটি আংটির মত।” (৪) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “দুনিয়ার আকাশ এবং এর পরবর্তী আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। আর এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের। এমনিভাবে সপ্তম আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। একইভাবে কুরসী এবং পানির মাঝখানে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের। আরশ হচ্ছে পানির উপরে। আর আল্লাহ তাআ’লা আরশের উপরে রয়েছেন। কিন্তু (এতো দূরে থাকলেও) তোমাদের আমলের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই।”

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট