পৃথিবীতে মহানবী (সা.)–র অবদান

 


আবুল হাসান আলি আল হাসানি আন নদভি (৫ ডিসেম্বর ১৯১৩ - ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯) বিশ শতকের অসামান্য ইসলামি শাস্ত্রজ্ঞ ও মনীষী। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌতে অবস্থিত দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার মহাপরিচালক, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি, দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সভাপতি, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলর ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। তার রচনাবলির সংখ্যা পাঁচশরও বেশি। ১৯৮০ সালে তিনি প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস ফিলিপ জর্জের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ইসলাম নিয়ে জ্ঞানচর্চার অবদানের কারণে তিনি পেয়েছেন বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার (১৯৮০)।

মহানবীর(সা.) ঐতিহাসিক ভূমিকা

বিশ্বের মানুষ এখন যেমন বিবেক ও রুচির স্বাধীনতা উপভোগ করছে, শান্তিতে ও সৌহার্দ্যে জীবন যাপন করতে, শিক্ষা ও প্রচারের জন্য শক্তিমত্তা উৎসর্গ করতে এবং মুক্তচিন্তায় গবেষণা ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথে চলছে—একটা সময় পৃথিবী এতটা সহিষ্ণু ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন মানব গোত্র, গোষ্ঠী ও দলের সাজানো সহাবস্থান তখন দেখা যায়নি। বিচিত্র মতামত মেনে নেওয়ার পক্ষে এখনকার মতো উদারমনা পরিবেশও ছিল না। বহুবার দেখা গেছে, মানবজাতি আত্মধ্বংসের দিকে ঝুঁকেছে। এমনও হয়েছে যে, নিজের অপকর্মের কারণে টিকে থাকার সব অধিকার সে হারিয়েছে।

আমরা জানি, ইতিহাস রচনা করা হয়েছে তুলনামূলক সাম্প্রতিক কালের। প্রাগৈতিহাসিক যুগ তার চেয়ে অনেক অনেক দীর্ঘ। তারপরও বিভিন্ন সাম্রাজ্যের পতন এবং মানব সমাজের অবক্ষয়ের যেটুকু বিবরণ আমরা পাই, তার প্রথমটি পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকে।

সামান্য ইঙ্গিত দিচ্ছি।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এইচ জি ওয়েলস বাইজেন্টাইন ও সাসানি সাম্রাজ্যের অধঃপতন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ সময় যুযুধান ও ক্ষয়িষ্ণু, এ দুটি সাম্রাজ্যে বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শনের যেন মরণ হয়েছিল। এথেন্সের বিগত দার্শনিকরা তাদের দমন করার আগে অতীতের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসম্ভারগুলি সংরক্ষণ করেছিলেন যত্ন নিয়ে। কিন্তু তাদের পর পৃথিবীতে মানুষ বলতে আর কিছু ছিল না। ছিল না খোলামেলা বিবৃতি দেওয়ার ঐতিহ্য এবং লেখাজোকায় অনুসন্ধানী ভাবমর্যাদা ধরে রাখার মতো সাহসী ও স্বাধীন চিন্তায় অভ্যস্ত কোনো মুক্ত ভদ্রলোক।’ (‘আ শর্ট হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, ১২৪)

এরপর তিনি লেখেন, ‘পশ্চিম ইউরোপে শৃঙ্খলা বা ঐক্যের কোনো লক্ষণ ছিল না। বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য পরস্পরের ধ্বংসের জন্য দৃশ্যত মুখিয়েই ছিল। ভারতও ছিল বিভক্ত ও বিপর্যস্ত।’ (প্রাগুক্ত, ১৪৪)

রবার্ট ব্রিফল্টও একই রকম মন্তব্যে বলেছেন, ‘পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ বর্বরতার আঁধারে ডুবে ছিল। বর্বরতা ছিল আদিম বন্যতার চেয়েও ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। যেখানে সভ্যতার বিকাশ হয়েছে—যেমন, ইতালি ও গল (প্রাচীন ফ্রান্স)—সবই ছিল বিধ্বস্ত, ক্লেদাক্ত ও বিনষ্ট।’ (‘দ্য মেকিং অব দ্য হিউম্যানিটি’, ১৬৪)

জে এইচ ডেনিসনের লিখেছেন, ‘পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে সভ্য পৃথিবী বিশৃঙ্খলার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। সভ্যতা যেন তখন এক বিশাল বৃক্ষ, যার পত্রপল্লব পৃথিবীজুড়ে ছড়ানো, শাখা-প্রশাখায় ঝুলছে শিল্প-বিজ্ঞান-সাহিত্যের সোনালি ফল, অথচ গাছটি একেবারে নড়বড়ে...শেকড়সুদ্ধ পচা।’ (‘ইমোশন অ্যাজ দ্য বেসিস অব সিভিলাইজেশন’, ২৬৫)

ঠিক সেই সময় জগতের মালিক আরবে এমন এক ব্যক্তির জন্ম দেন, যাঁর কাঁধে পড়ে সবচেয়ে কঠিন কাজের ভার: মানবজাতিকে আসন্ন ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধার করা। শুধু তা-ই নয়, তাকে এমন সুউচ্চ মহিমায় উন্নীত করা, যা ইতিহাসবিদদের জ্ঞান এবং কবিদের কল্পনারও অতীত। যদি তাঁর কীর্তি ও কৃতিত্ব উপস্থাপন করার মতো তর্কাতীত ঐতিহাসিক প্রমাণ আজ না থাকত, তাহলে তা বিশ্বাস করাই কষ্টসাধ্য হতো।

এই ব্যক্তিটিই হলেন মুহাম্মদ (সা.) (তাঁর ওপর শান্তি নেমে আসুক), যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তিনি মানবজাতিকে যুগপৎ শঙ্কা ও আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তাদের দিয়েছেন নতুন জীবন, নতুন লক্ষ্য, নবীন শক্তি। দিয়েছেন মানুষের মর্যাদা, বুদ্ধিমত্তা ও আদর্শবাদের একটি বৈপ্লবিক ধারণা। মানুষকে তাঁর দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হলো, সত্যের প্রতি অনুরাগ, অসত্যের প্রতি বিরাগ, মিথ্যা প্রভুর প্রতি ঘৃণা, ন্যায় ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার আবেগ এবং এসব পুণ্যময় লক্ষ্য পূরণে নিজের জীবন দেওয়ার মানসিকতা।

ফলে বিশ্ব পেয়েছে একটি একটি নতুন জীবনের স্বাদ, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা যার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। দুর্বলেরা পেয়েছে অহঙ্কারী ও শক্তিমানদের কাছে আপন অধিকার দাবি করার সাহস। ক্ষমা ও দয়াশীলতা হয়ে উঠেছে জনসাধারণের স্বাভাবিক আচরণ। নিঃস্বার্থ পরোপকার মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

মানবতার সেই সর্বাধিক অনুগ্রহকারী সম্পর্কে এই অঞ্চলের, কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য উল্লেখ করা যাক। যেমন ফ্রান্সের লামার্তিন মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই মানুষটি কেবল সেনাবাহিনী, আইন, সমাজ, সাম্রাজ্য, লোকবলই পরিচালনা করেননি, একই সঙ্গে লক্ষ-লক্ষ মানুষ, তৎকালীন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানবজীবনকে আন্দোলিত করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি উপাসনার মঞ্চ, দেব-দেবী, ধর্ম-মতবাদ, ধারণা, বিশ্বাস ও আত্মাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছেন।’ (‘হিস্তোয়ার দো লা তার্কি’, ২/২৭৬-৭৭)

জন উইলিয়াম ড্র্যাপার লিখেছেন, ‘জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর চার বছর পর, ৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আরবে একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যিনি সকলের চাইতে মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন।’ (‘হিস্টরি অব ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব ইউরোপ’, ১/৩২৯)

ইসলামের নবী ও তাঁর অনুসারীরা মানবতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছিলেন, তা সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রসার ও উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। আমরা এখানে কেবল দুটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করব, যা ঐতিহাসিক প্রমাণ সমর্থিত।

 অনুবাদ: মনযূরুল হক

মনযূরুল হক: আলেম ও লেখক

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট