ফিতনার এই যুগে আমার বাচ্চাদের কীভাবে বড় করবো?
ভয়াবহ ফিতনার এই যুগে আমার বাচ্চাদের কীভাবে বড় করবো?- নোমান আলী খান আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটির মত বা ইউরোপের অনেক দেশের মত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু… আমরা সেখানে ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ করতে চাই, ইসলামী স্কুল, কিশোর প্রজেক্ট বা এ ধরণের প্রজেক্ট চালাতে চাই আমাদের সন্তানদের ইসলামী পরিবেশে বড় করার জন্য। আমি সবার আগে এ কথা বলে শুরু করতে চাই যে, আমাদের সবার উচিত আন্তরিক দোয়া করা এমন যে কোনো প্রচেষ্টার জন্য। যা কিছুটা অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা করছে, কিছুটা সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে এবং আগুয়ান প্রজন্মের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ আমি অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই। একই বিষয়, কিন্তু ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে। বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ম্যানেজমেন্ট ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসার কারণে আমি আপনাদের বলতে পারি, যখন কোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পান, আপনার Goals বা লক্ষ্যগুলো নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করার পর আপনি সিদ্ধান্ত নিবেন কি কি পদক্ষেপ করতে হবে সেসব লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য। আর কোন কোন সময়ে সে লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবে। এবং প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য আপনাকে কি কি উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে হবে, যেন ঐ লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছতে পারেন। অতএব, সবার আগে যে বিষয়ে আপনার পরিষ্কার জ্ঞান থাকতে হবে তা হলো লক্ষ্যসমূহ। এরপরে আপনি যা যা করবেন, পরের সকল পদক্ষেপগুলো এখন ঐ লক্ষ্যগুলো দ্বারা নির্ধারিত হবে। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে- এই পদক্ষেপটি কি আমাকে আমার লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছেতে সাহায্য করছে? এই স্টেপ এবং ঐ গৌলটির মাঝে কি সুস্পষ্ট সম্পর্ক আছে? প্রায় সময় যা ঘটে...ব্যবসায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে মানুষ পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আমি আপনাদের রাজনীতির একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কেউ একজন ভাবল- আমি এই দেশ পরিবর্তন করবো। আমি অমুক পরিবর্তন আনবো। আমার অমুক ভিশন আছে। এটাই আমার লক্ষ্য। আমি ক্ষমতায় আসলে ঠিক এটাই করবো। পরিশেষে, সে নির্বাচনে অংশ নিল। একবার হারলো। আবার অংশ নিল। আবার হারল, আবার অংশ নিল। অবশেষ একিদন, বহু ক্যাম্পেইনের পর সে বিজয় লাভ করলো। সে বিজয় লাভ করলো তার ঐ পুরাতন লক্ষ্যগুলোর উপর ভিত্তি করেই। এখন, ক্ষমতায় আসার পর নতুন নতুন সব বিবেচনার বিষয়, আপস-মীমাংসা, জটিলতা সামনে এসে পড়লো। এসব ঘটতে থাকলো। এখন সে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে লাগলো বা নীতি বাস্তবায়ন করতে লাগলো। আর তার অনুসারীরা অবাক হয়ে...থামুন! আপনি না বলেছিলেন আপনার ভিশন অমুক? আর আপনি এখন এসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, কিন্তু এগুলো তো সরাসরি ঐ লক্ষ্যগুলোর দিকে পরিচালিত করছে না। তখন উনি বলেন, আমি জানি। কিন্তু জীবন অনেক জটিল। আমাদেরকে কখনো ডানে যেতে হয়, কখনো বামে যেতে হয়। আমি একটু ঘুরে আবার ফিরে আসব। এবং শেষমেশ লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছাবো। এমনটা বলে, তাই না? এরপর আপনি এসব লিডারদের উপর আস্থা হারাতে থাকেন। যারা আপনাকে কিছু ওয়াদা দিয়েছিল, পরিষ্কার একটি ভিশন দিয়েছিল। এরপর পরিশেষে তারা অন্য দিকে পথ চলতে শুরু করলো। ব্যবসার জগতেও তাদের একটি কনসেপ্ট আছে। তা হলো- প্রজেক্টটা এতো বড় যে ব্যর্থ হতে পারবে না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যেন বিষয়টা হাতে নাতে বুঝতে পারি। এক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিল সে রেস্টুরেন্ট দিবে। সে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা পিজা বানাতে চায় বা কিছু একটা। তাই সে বিশাল এক স্টোভ কিনে নিয়ে আসলো। কিন্তু ক্রয় করার পরে জানল যে এটা আসলে সেরা স্টোভ নয়। সে প্রচুর টাকা এর পেছনে ব্যয় করল! বিশাল বিনিয়োগ করে ফেললো! সে এমনকি স্পেশাল বাবুর্চিও নিয়ে এলো, যে জানে কীভাবে এটি চালাতে হয়। কিন্তু এখন এ স্টোভটি সবচে সেরা পিজা বানাচ্ছে না। এখন তাকে এটি ফেলে দিতে হবে। কিন্তু সে তো ইতোমধ্যে অনেক বেশি টাকা এর পেছনে ব্যয় করে ফেলেছে! তাই সে ভাবল-- না, যেভাবেই হোক এটা দিয়েই আমাকে কাজ করতে হবে। আমার কাছে এটাই আছে। এটা এতো বড় যে ব্যর্থ হতে পারবে না। এর পেছনে আরও টাকা ঢালি। আমি অনেক দূর চলে এসেছি। এখন বিশাল এক ক্ষতি হয়ে যাবে যদি এটাকে ফেলে দিই এবং আবার নতুন করে শুরু করি। একটা ভুল যেহেতু করে ফেলেছি। কি আর করবো! আমার গোড়ালিকে কাদার মধ্যে আরও বেশি ডুবাই। তাহলে কী হয়? মূল লক্ষ্য হারিয়ে যায় এবং এর সাথে আপস করা হয়। ব্যাপারটা হলো যদি সত্যি আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জন করে চান, কারণ আমি আর আপনি মানুষ, আমরা হয়তো একটি পদক্ষেপ নিবো যা ভুল হবে। পদক্ষেপটা সেরা পদক্ষেপ ছিল না। আমাকে নিজের প্রতি সৎ থেকে বলতে হবে, ঐ স্টেপটা ব্যর্থ একটা স্টেপ ছিল। মনে হয় আমাকে ভিন্নভাবে চেষ্টা করতে হবে। আমাকে নতুন কিছু চেষ্টা করে দেখতে হবে। এরপর আমরা ভিন্ন একটি পদক্ষেপ নিই। সম্ভবত সেটা বেশ সফল একটা স্টেপ হয়। আপনার লক্ষ্য যদি পরিষ্কার থাকে, সবাই যেভাবে করছে সেভাবে করলে হয়তো কাজ করবে না, আপনাকে হয়তো নতুন কিছু চেষ্টা করে দেখতে হবে। এখন, ব্যাপারটা হলো যখন আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া কথা আসে, ভালো তারবিয়া দেয়ার কথা আসে, ধর্ম আঁকড়ে ধরে থাকার সুযোগ দেওয়ার কথা আসে, কিছু মূল্যবোধ শেখানোর কথা আসে, যেন তারা দুনিয়ার মোকাবেলা করতে পারে। চলুন, আগে লক্ষ্যগুলো নিয়ে কথা বলি। আমার মাথায় লক্ষ্য হলো-- একটি দশ বছর বয়সের মুসলিম বাচ্চার এমন প্রস্তুতি থাকা উচিত, যেন সে সরকারি স্কুলের পরিবেশ মোকাবেলা করতে পারে। সরকারি স্কুলের পরিবেশে গেলে তারা কী দেখবে? কোন ধরণের কথাবার্তা তারা শুনবে? কোন ধরণের চিন্তাভাবনাগুলো তাদের সামনে অনাবৃত হয়ে পড়বে? তাদের প্রস্তুতি থাকা উচিত কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মোকাবেলা করতে হবে। এমনকি আপনি যদি তাদের ফোন না দেন, আইফোন না দেন, টিকটক একাউন্ট খুলে না দেন, ইন্সটাগ্রাম ইন্সটল করে না দেন তাদের ডিভাইসে। এর মানে এটা নয় যে, তাদের এমনসব বন্ধু নেই যাদের এগুলোতে এক্সেস আছে। সুতরাং, তাদের সামনে এগুলো এসে পড়বে। সুতরাং, আমার দশ বছরের সন্তানের জন্য আমার লক্ষ্য হলো-- এগুলোর সম্মুখীন হওয়া প্রতিরোধ করা নয়। কারণ এমনকি আমি প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিলেও, এটা ঘটবেই। আমি বিভ্রান্তির মাঝে বাস করছি যদি আমি মনে করি এটা ঘটবে না। একভাবে না হলে অন্যভাবে তারা এগুলোর সম্মুখীন হয়ে পড়বে। আমি যদি তাদেরকে এগুলোর সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করার প্ল্যান করি, এটা শুধুই সাময়িক একটি প্ল্যান। কারণ, কয়েক বছর পরে তারা এতোটা বড় হবে যে, তারা চারদিক থেকে সবধরনের জিনিস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়বে। তাই, আমাকে এই দশ বছরের বাচ্চার মাঝে এমন কিছু নির্মাণ করে দিতে হবে, এমনকি আরও ছোট বয়সেরও, যেন সে মোকাবেলা করতে পারে যে ব্যাপারগুলো সামনে আসছে সেগুলোর; যে দুনিয়া তাদের সামনে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে তার। তাই, আমি যদি একটু পেছনে সরে এসে চিন্তা করি, আমি শুধু চাই আমার দশ বছরের বাচ্চাটা যেন জানে কীভাবে নামায আদায় করতে হয়। আমি মনে করি, এটি অতি চমৎকার একটি লক্ষ্য। খুবই প্রশংসনীয়। অতি উত্তম কাজ আমাদের বাচ্চাদের নামাজ পড়া শেখানো। কীভাবে অজু করতে হয়, বাথরুমে গেলে কীভাবে নিজেকে পরিষ্কার করতে হয়, কি কি দোয়া পড়তে হয়, হালাল খাবার খাওয়ার অভ্যাস। এর সবকিছুই অসাধারণ। কিন্তু নামাজ, অজু, হালাল খাবার কি তাদের প্রস্তুত করছে আসন্ন স্কুলের পরিবেশ মোকাবেলা করার জন্য? নাকি তারা এমন কিছু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়বে যার জন্য তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না? অনেক পিতামাতা ভাবে- আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে কুরআন মুখস্ত করাবো। আমি তার স্কুলের পড়া বন্ধ করে দিবো। আমি নিশ্চিত করবো যে সে সমগ্র কুরআন মুখস্ত করেছে। আমি তাকে হেফয মাদ্রাসায় ভর্তি করাবো। সে দুই বা তিন বছর সময় নিবে এবং কুরআনের হাফিজ হয়ে যাবে। তার তাজবিদ হবে অতি সুন্দর। সে নামাজের ইমামতি করতে পারবে, আমরা এমনকি তার পেছনে তারাবির নামাজ পড়তে পারবো। আমরা তখন তাকে নিয়ে উৎসবের আয়োজন করবো। এখন এই ১৩ বছরের বাচ্চাটি যে কুরআনে হাফেজ, একদিন তাকে স্কুলে যেতে হবে। সে আরও দেখবে সোশ্যাল মিডিয়া কি কি আছে, যা কিছু আছে ইউটিউবে, এবং ইন্টারনেটে যা সহজেই দেখা যায়। এবং ১৩ বছরের অন্যসব বাচ্চারা কী নিয়ে কথা বলছে। সে এ সমস্ত কিছুর মুখোমুখি হয়ে পড়বে। এখন, আমি যদি ভাবি-- তার তাজবিদ তাকে এসব সঙ্কটে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করবে, অথবা তার যে সুরাতুল বাকারা মুখস্ত আছে এটাই তাকে প্রস্তুত করে ফেলেছে আসন্ন ফিতনার মোকাবেলার জন্য...তাহলে আমার বুঝে সমস্যা আছে। কারণ, আমি লক্ষ্যগুলো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারিনি। নামাজ শেখার পদক্ষেপ, কুরআন মুখস্ত করার পদক্ষেপ ঐ পদক্ষেপগুলো ছিল আরও ভালোভাবে আল্লাহর ইবাদাত করার লক্ষ্যের দিকে কয়েকটি পদক্ষেপ মাত্র। এটা অত্যন্ত ভালো একটি লক্ষ্য। অন্য কথায়, আমি যদি আমার বাচ্চাকে কুরআন মুখস্ত করতে উৎসাহিত করি, এবং নামাজ পড়া শেখাই, ধর্ম শেখাই এবং হালাল হারাম সম্পর্কে কিছু শেখাই, এবং ফিকহ নিয়ে কিছু শেখাই, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাহ নিয়ে কিছু শেখাই---এর সমস্ত কিছুই তাদের শেখাবে কীভাবে আরও ভালোভাবে আল্লাহর ইবাদাত করা যায়। খুবই ভালো। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, এ ব্যাপারগুলো তাদেরকে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করছে। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি লক্ষ্য। (৭:৫০ মিনিটের অনুবাদ। সম্পূর্ণ খুতবা ২৮:২১ মিনিট)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন