ফিতনার এই যুগে বাচ্চাদের কীভাবে বড় করবো? (৩য় পর্ব)
ভয়াবহ ফিতনার এই যুগে আমার বাচ্চাদের কীভাবে বড় করবো? (৩য় পর্ব) —নোমান আলী খান অনেক সময় পিতা-মাতা কিছু নিয়ে কথা বলছে, আর বাচ্চা হিসেবে তুমি তাদের সামনে এলে। তখন তারা বিরক্ত হয়ে...যাও! আমরা এখন কথা বলছি। অন্য রুমে যাও। বাচ্চাটা তখন মনে মনে ভাবে— উনাদের সাথে তো আমার কথা বলার সুযোগ নেই। এরপর পিতামাতা বলে— "হ্যাঁ, সে তেমন কথা বলে না।" হ্যাঁ, সে কথা বলে না। কারণ, আপনারা তাকে কথা বলার কোনো সুযোগই দেন না। বস্তুত, এই একই শিশু যখন অনলাইনে যায়, ইন্সটাগ্রামে একাউন্ট খোলে বা টিকটকে একাউন্ট খোলে এরপর কোথাও কমেন্ট করে বা ভিডিও পোস্ট করে বা অন্য কিছু পোস্ট করে—মানুষ তাদের সাথে কথা বলা শুরু করে। মানুষ বলে—এটা খুবই মজার ছিল! ঐটা অত্যন্ত সুন্দর ছিল! এভাবে সে বৈধতা পেতে শুরু করে। তার কাছে তখন মনে হয় তার কথা মানুষ শোনে। কিন্তু তার তো এই অনুভূতিটা বাসা থেকে পাওয়ার কথা ছিল। তার তো এমন মনে হওয়ার কথা ছিল—আমি কী বলতে চাই আমার বাবা তা শোনে। আমার মা-ও আমাকে শোনে। তো এখন, আমাদের বাচ্চারা এমন মনোভাব গড়তে শুরু করে যে, তারা আপনাকে বলে না। তারা আপনাকে বলবে না—"আমার ফিল হচ্ছে যে, আপনি আমার কোনো কেয়ার করেন না।" আর আপনার মাথায় আপনি তখন—"কেয়ার করি না বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছ? আমি তোমার সব বিল প্রদান করি। টেবিলে খাবার আসে কোত্থেকে? আমি তোমাকে অমুক গিফট দিয়েছি। অমুক করেছি, তমুক করেছি। ছুটিতে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছি। আমি কেয়ার করি না বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছ!!" "আস্তাগফিরুল্লাহ! আজকের দিনের বাচ্চাগুলা অতিশয় স্বার্থপর। তারা বুঝে না। তাদের বুঝাতে হবে। পরের খুৎবায় তাদের এগুলো বুঝাবেন। তারা জানে না তারা কী ফিল করছে। আমাদেরকে তাদের অনুভূতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে।" আমাদের বাচ্চারা যেহেতু তাদের মনোভাব প্রকাশ করে না, তারা এগুলো বলে না, তাই আমরা নিজেদের বুঝ দেই—না, না, আমার ছেলে কখনো এমন অভিযোগ করে না। আমার ছেলে কখনো কিছু বলে না। ভাই, অন্য বাচ্চাদের এ সমস্যা আছে। আমার বাচ্চার এ সমস্যা নেই। আলহামদুলিল্লাহ! আমার পরিবার! মাশাআল্লাহ! বাচ্চাগুলো পারফেক্ট ! আলহামদুলিল্লাহ! আমি এমন কথা অসংখ্য বার শুনেছি। এই একই পারফেক্ট বাচ্চাটা যখন ষোল বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন তার জিহ্বাটা একটু বড় হতে শুরু করে। সে একই বাবা-মা এখন পুরাই স্তম্ভিত! শায়েখ! ইমাম! আমার ছেলের কি হল জানি না! কত লক্ষ্মী একটা ছেলে ছিল! জানি না, হঠাৎ করে তার কী হলো! সে কথা শুনে না। পাল্টা ধমক দিয়ে কথা বলে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আমাকে বলেও না কোথায় যাচ্ছে। হঠাৎ করে এসব ঘটছে কেন? এখন ইস্যুটা হলো—আপনি ভাবছেন এগুলো হঠাৎ করে ঘটছে। কিন্তু এগুলো আসলে বাচ্চাটার মাথায় ঘটে চলছিল একটু একটু করে ৫, ৬, ৭, ৮ বছর ধরে। শেষ পর্যন্ত এক সময় বাচ্চাটার মনে এ বিশ্বাস পোক্ত হয়ে উঠে যে, আমার বাবা-মা আমাকে বুঝে না। তারা বুঝে না আমি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমনকি আমি যদি তাদের বলতে চাই আমি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এখানে উপবিষ্ট অনেক তরুণ জানে আমি কী নিয়ে কথা বলছি। যে কথোপকথনগুলো আসলেই কলেজে হয় বা যে ধরণের কথাবার্তা বাস্তবেই হাই-স্কুলে হয়, বা যে কথোপকথনগুলো প্রকৃতই অনলাইনে হয়, বা যেগুলো আসলেই তোমার মিডল স্কুল বা প্রাইমারি স্কুলে হয়; যদি তোমার বাবা-মা জানতো কি কি কথা তোমার কানে আসে বা কি ধরণের কথা তুমি বলে থাকো, কাকে বলেছ আর সে তোমাকে কি বলেছে— তুমি জানো যে তোমাকে ইমারজেন্সি হেল্পে কল করতে হবে। কেউ একজন হাসপাতালে যাচ্ছে। হয় তারা মূর্ছা যেয়ে, তীব্র হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে, হার্ট এটাকে বা তোমাকে ধোলাই করা হচ্ছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কারণ, তারা এ ধরণের কথাবার্তার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ, পিতামাতা এবং সন্তানের মাঝে এমন একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে যা দিন দিন শুধু বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। কোনো কথাবার্তাই আর হচ্ছে না। আমরা কুরআনের আয়াত পড়ি যেখানে আল্লাহ শেষ ফলাফলটা বর্ণনা করেন। আমি যেমন বলেছি আপনি শেষ ফলাফল সম্পর্কে শিখতে পারেন, কিন্তু আপনাকে তো সেই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কেও জানতে হবে যেগুলো ঐ শেষ ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। فَخَلَفَ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ - "তাদের পরে এলো নষ্ট এক প্রজন্ম..." (১৯:৫৯) যদি পরবর্তী প্রজন্ম উপকারী হয়, প্রডাক্টিভ হয় তখন তাদের 'খালাফ' বলা হয়। লামের উপর জবর যোগে। আর যদি পরবর্তী প্রজন্ম নষ্ট হয়, হতাশ এক প্রজন্ম হয় তখন তাদের 'খালফ' বলা হয়। তাহলে 'ফাখালাফা মিম বা'দিহিম খালফুন'। লামের উপর সাকিন যোগে। এর মানে হলো—তাদের পরে পরবর্তী প্রজন্ম এলো যারা ছিল হতাশ এক প্রজন্ম। কীভাবে তারা হতাশাজনক প্রজন্ম? اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ- "তারা তাদের নামাজ বিনষ্ট করলো।" আল্লাহ বলেননি তারা নামাজ পড়েনি। তারা নামাজ পড়েছিল কিন্তু বিনষ্ট করে ফেললো। অন্য কথায়, নামাজের তো একটি উদ্দেশ্য থাকার কথা ছিল। পরের নতুন প্রজন্ম এলো, এমনকি যখন তারা নামাজ আদায় করত, তাদের কোনো ধারণাই ছিল না এই নামাজের উদ্দেশ্য কী ছিল। اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ- নামাজের তো রূপান্তর করার কথা ছিল...আপনি যদি নামাজের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন, নামাজের তো আমার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করার কথা। যেভাবে আমি দুনিয়াকে দেখি তাতে রূপান্তর নিয়ে আসার কথা। কিন্তু এটা যখন ঘটে না, তখন আপনি আয়াতের পরবর্তী অংশ বুঝতে পারবেন। اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ وَ اتَّبَعُوا الشَّهَوٰتِ - তাদের ফিলিংস যে দিকে যেতে বলল তারা সেদিকেই চলল। তাদের কামনা আছে, অনুভূতি আছে, হরমোন আছে। আর তারা এ চাহিদাগুলো পূরণে উঠে পড়ে লাগলো। মন যা চাইলো তারা তাই করলো। পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এমন আচরণই বেরিয়ে আসলো। আমরা সুরাতুল মারিয়ামের এ আয়াতটি পড়ি। আর ভাবি, এমনটি ইতিহাসে ঘটেছিল। এখন আর ঘটবে না। তাই না? আল্লাহ ইতিহাস এ জন্য উল্লেখ করেন না যে, এটা অতীতের মৃত বিষয়। তিনি ইতিহাসের উল্লেখ করেন কারণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আর তিনি ঈমানদারদের এ ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কারণ, আমি আমার সন্তানদের এ ফাঁদে পড়তে দিতে চাই না। তাহলে কীভাবে আমি নিশ্চিত করবো আমার সন্তানেরা যেন এক নম্বর স্টেপে পরিণত না হয়। اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ- তারা যেন নামায বিনষ্ট না করে। কীভাবে এ ধর্মের সাথে তারা একটি সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তুলবে। আপনিই আপনার বাচ্চার ধর্মের চূড়ান্ত শিক্ষক। আমি পরোয়া করি না আপনার ধর্মীয় জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, আরবি জানেন বা না জানেন, আলেম হন বা না হন। ইসলামের জন্য আপনার বাচ্চার সবচেয়ে বড় শায়েখ হলেন আপনি নিজে। এ চাকরি আউটসোর্স করতে পারবেন না। কোনো ইউটিউব ভিডিও এ চাকরি করে দিতে পারবে না, কোনো ইমাম এ চাকরি করে দিতে পারবে না। কোনো ইসলামী স্কুলও না, কোনো সানডে স্কুলও না। অন্য কেউ এ চাকরি করে দিতে পারবে না। আপনি নিজে এ দায়িত্বের ৯৯ শতাংশ বহন করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো এক শতাংশের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে। শুধু এক শতাংশ। বাকি সমস্ত কিছু আপনার কাছ থেকেই আসছে। আপনি নিজে আপনার বাচ্চার ব্যক্তিত্ব গঠনের চূড়ান্ত প্রভাবক। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এর মানে কী। কোন কোন পদক্ষেপগুলো আপনি একজন পিতা হিসেবে—যে পুরুষেরা আমার সামনে বসে আছেন—আপনারা পিতা হিসেবে এবং আপনারা মাতা হিসেবে—যে নারীরা নারীদের সেকশনে বসে আছেন— আপনাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি কি পদক্ষেপ আপনারা গ্রহণ করবেন যেন আপনাদের বাচ্চারা নিজে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ সম্পর্কের ভেতরে যা যা করছেন তা কি তাদেরকে ওই লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তুত করছে? আমাদের মাথায় আমরা ভাবি—যদি স্কুল নির্মাণ করি, যদি আরও বড় বড় সেন্টার নির্মাণ করি, আমরা যদি বাগ্মী কোনো ইমাম খুঁজে পাই তরুণদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। না। তরুণদের সমস্যা সমাধানে আপনি ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য পেতে পারেন, প্রতিষ্ঠানগুলো সাহায্য করবে, প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তা বের করবে। ইমামেরা, স্কলারেরা, নেতারা, ইয়ুথ ডিরেক্টরেরা সাহায্য করবে। কিন্তু সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটে বাসায়। আসল জিনিস ঘটে ঘরে। আর এটা ঘটে প্রারম্ভিক বছরগুলোতে। বড় হওয়ার শুরুর দিকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন