ধৈর্যের সাধারণ প্রকারভেদ
ধৈর্যের সাধারণ প্রকারভেদ — ড. ইয়াসির ক্বাদী আমাদের আলেম-ওলামারা বলেছেন— ধৈর্য তিন প্রকার। প্রথম প্রকার ধৈর্য হলো, বিপদে পড়লে ধৈর্য ধারণ করা। এই প্রকারের ধৈর্য সবচেয়ে নিম্নস্তরের। কারণ, এটা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। আপনার পক্ষে নিজের পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। যেমন— চাকরি হারানো, প্রিয় কারো মৃত্যু ইত্যাদি। এখন, এসব ক্ষেত্রে কিভাবে ধৈর্য প্রদর্শন করতে হবে? আপনাকে জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আশাবাদী মনোভাব পোষণ করতে হবে। এ বিপদটা কেন আপনার উপর এসে পড়লো আপনাকে এটা না বুঝলেও চলবে। আপনি দুঃখ অনুভব করতে পারবেন। দুঃখ অনুভব করা মানব প্রকৃতির অংশ। কাঁদতে পারবেন। শোকাহত হতে পারবেন। কিন্তু, কোনোভাবেই আল্লাহর বিজ্ঞতা, দয়া এবং ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। অন্তরেই এসব প্রশ্নকে পাত্তা দেয়া যাবে না, মুখে উচ্চারণ তো দূরে থাক। অতএব, এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য মানে বিপদে পড়লে আপনার চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষ করে আপনার জিহ্বা। আপনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিজ্ঞতাকে প্রশ্ন করতে পারবেন না। আর এ ধরণের ধৈর্য হলো সবচেয়ে নিম্নস্তরের ধৈর্য। দ্বিতীয় প্রকারের ধৈর্য হলো— পাপ করা থেকে এবং আল্লাহর অবাধ্য হওয়া থেকে ধৈর্য ধারণ করা ও নিজেকে বিরত রাখা। এই প্রকারের ধৈর্য কখনো কখনো তুলনামূলকভাবে বেশি কঠিন। কারণ, প্রচুর পাপ করার সুযোগ আমাদের সামনে সবসময় উন্মুক্ত। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করার মানে হলো— নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, আটকিয়ে দেওয়া, নিজের লালসায় লাগাম পরানো। আমাদের নিজেদের সংযত করা, টেনে ধরা, দমন করা। লোভনীয় কিছু সামনে আসলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি না। এই প্রকারের ধৈর্য ধারণ করার ক্ষেত্রে দক্ষ হওয়ার জন্য রামাদান মাস আমাদের সাহায্য করে। (নফল রোজাও এ ক্ষেত্রে সাহায্য করে।) চিন্তা করে দেখুন। রামাদানে আমরা নিজেদের খাদ্য এবং পানি পান থেকে বিরত রাখি। যৌন চাহিদা পূরণ থেকেও আমরা নিজেদের বিরত রাখি। সুতরাং, আমরা তখন শিখি কিভাবে আমাদের জন্য হালাল নয় এমন জিনিস থেকেও নিজেদের বিরত রাখবো। আমরা তখন খাওয়া এবং পান করা থেকে বিরত থাকি একমাত্র এই কারণে যে আল্লাহ বলেছেন খাওয়া এবং পান করা থেকে বিরত থাকো। তাই, আমরা খাই না এবং পান করি না। তাহলে, মন্দ কাজের ব্যাপারে কী করবেন? আল্লাহ যখন বলেন মদ পান করো না, সব ধরণের মাদক থেকে দূরে থাকো, চুরি করো না, ব্যভিচার করো না ইত্যাদি। এভাবে আমরা যখন বৈধ কাজ খাওয়া এবং পান করা থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠি, আমাদের জন্য তখন হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠা সহজ হয়ে যায়। তৃতীয় প্রকারের ধৈর্য, যা সর্বোচ্চ লেভেলের, এ ধরণের ধৈর্য অবলম্বন করা সত্যিই কঠিন। এর পরিবর্তনশীল অবস্থার কারণে, এ ধরণের সবরের কথা আমাদের মাথায়ও না আসার কারণে। আর তা হলো— সময় নষ্ট করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। উপকারী কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে আটকিয়ে রাখা। সবসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাতে মগ্ন থাকা। এই প্রকারের ধৈর্য ধরার মানে— নিজেকে আটকিয়ে দেওয়া, বাধা দেওয়া, সংযত করা এমনকি হয়তো হালাল কিছু থেকেও। (কাজটিতে হয়তো গুনাহ নেই, কিন্তু কোনো সওয়াবও হবে না।) এ ধরণের কাজে বেশি জড়িয়ে পড়লে তা মাকরূহে পরিণত হয়। অতিরিক্ত বেহুদা কাজে, সময় নষ্ট হওয়ার কাজে যুক্ত হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এবং নিজের জন্য বেশি উপকারী কাজে যুক্ত থাকা। বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করা, মুখস্ত করা, নামাজে সেগুলো তিলাওয়াত করা, অতিরিক্ত জিকির করা, অতিরিক্ত দান করা। আবারো, রামাদান মাস আমাদেরকে এই ধরণের ধৈর্য ধারণ করাও শেখায়। কারণ, এই সময়ে আমরা সবাই একটু হলেও বেশি ভালো কাজ করার চেষ্টা করি। সে সময় আমরা বেশি বেশি কুরআন পড়ি, বেশি বেশি সালাত আদায় করি। আমরা নিজেদেরকে সাধারণ সময়ের চেয়ে একটু হলেও বেশি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাতে নিমগ্ন রাখি। ------------------ ধৈর্যের পুরস্কার জান্নাত — ড. ইয়াসির ক্বাদী আল্লাহ তাঁর ক্ষমা, জান্নাত এবং জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা পাওয়াকে ধৈর্য ধারণ করার সাথে যুক্ত করেছেন। আমি আবারো বলছি, আল্লাহ তাঁর ক্ষমাকে ধৈর্যের সাথে যুক্ত করেছেন। আল্লাহ কুরআনে বলেন- اِلَّا الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ - "তবে যারা সবর করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।" (১১:১১) তাহলে আল্লাহর ক্ষমা ধৈর্যের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। জান্নাতে প্রবেশ এবং জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা পাওয়াকেও ধৈর্য ধারণের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ কুরআনে বলেন, جَنّٰتُ عَدۡنٍ یَّدۡخُلُوۡنَهَا وَ مَنۡ صَلَحَ مِنۡ اٰبَآئِهِمۡ وَ اَزۡوَاجِهِمۡ وَ ذُرِّیّٰتِهِمۡ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یَدۡخُلُوۡنَ عَلَیۡهِمۡ مِّنۡ کُلِّ بَابٍ ﴿ۚ۲۳ - "স্থায়ী জান্নাতসমূহ, যাতে তারা এবং তাদের পিতৃপুরুষগণ, তাদের স্ত্রীগণ ও তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা সৎ ছিল তারা প্রবেশ করবে। আর ফেরেশতারা প্রতিটি দরজা দিয়ে তাদের নিকট প্রবেশ করবে।" سَلٰمٌ عَلَیۡکُمۡ بِمَا صَبَرۡتُمۡ فَنِعۡمَ عُقۡبَی الدَّارِ - (আর বলবে) ‘‘তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ তোমরা ধৈর্যধারণ করেছিলে। আখিরাতের এ পরিণাম কতই না উত্তম"। (১৩:২৩-২৪) কল্পনা করুন, আপনি জান্নাতে আছেন। জান্নাতের আসন সমূহে হেলান দিয়ে শুয়ে জান্নাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। আর ফেরেশতারা দলে দলে এসে আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তখন তাঁরা কী বলে অভিনন্দন জানাচ্ছেন? "সালামুন আলাইকুম বিমা সবারতুম- তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ তোমরা ধৈর্যধারণ করেছিলে।" তাহলে দেখা যাচ্ছে, ফেরেশতারা জান্নাতে আপনার অবস্থান এবং মর্যাদাকে এই দুনিয়ায় আপনি যে ধৈর্য দেখিয়েছেন তার সাথে যুক্ত করেছেন। আর জান্নাতের যে কোনো জায়গা নয়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সর্বোচ্চ ধাপের জান্নাতের কথা ধৈর্য ধারণের সাথে যুক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন- اُولٰٓئِکَ یُجۡزَوۡنَ الۡغُرۡفَۃَ بِمَا صَبَرُوۡا - "এদেরকেই তাদের ধৈর্যধারণের কারণে জান্নাতের সুউচ্চ স্থান দান করে পুরস্কৃত করা হবে।" (২৫:৭৫) তাহলে ধৈর্য আপনাকে জান্নাতের সুউচ্চ লেভেল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে। এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা স্বয়ং আপনাকে অভিনন্দন জানাবেন আপনি যে ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন তার জন্য। আক্ষরিক অর্থেই কুরআনে এসেছে- اِنِّیۡ جَزَیۡتُهُمُ الۡیَوۡمَ بِمَا صَبَرُوۡۤا ۙ اَنَّهُمۡ هُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ - "আজ আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম তাদের ধৈর্য ধারণের কারণে, আজ তারাই তো সফলকাম।" (২৩:১১১) এখানে আল্লাহ ফাস্ট পার্সনে কথা বলছেন। তিনি সাধারণত এভাবে কুরআনে কথা বলেন না। আল্লাহ সাধারণত থার্ড পার্সনে কথা বলেন। "আমরা করব বা তাদের প্রতি আশীর্বাদ করা হবে..." কিন্তু এই আয়াতে তিনি ফাস্ট পার্সনে কথা বলছেন। তিনি আমাদের সরাসরি সম্বোধন করে বলছেন- "ইন্নি জাজাইতুহুমুল ইয়াওমা বিমা সবারু- নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম।" তাহলে আল্লাহ নিজে ধৈর্যশীলদের পুরস্কৃত করবেন। তারপর আল্লাহ বলেন, আন্নাহুম হুমুল ফা-ইজুন- এরাই হলো তারা যারা জিতে গেছে। কুরআনে জান্নাত জিতার একটা রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করার একটা রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। কারা সত্যিকারের জয় লাভ করেছে? আল্লাহ বলেন- আন্নাহুম হুমুল ফা-ইজুন- এরাই হলো তারা যারা জিতে গেছে।" ------------ * -------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন