জাবিরের নিকট উট বিক্রি


 জাবিরের নিকট উট বিক্রিঃ রাসূলুল্লাহর ভালোবাসা, মমতা আর সহানুভূতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার বিস্ময়কর একটি ঘটনা

----------------------- * ---------------- সিরাহ বহু পর্যায়ে আমাদের সাথে অনুরণিত হয়। আমার জন্য, একটি ঘটনা আমার সবচেয়ে প্রিয়। সাহাবাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (স) এর কত বেশি মমতা এবং সহানুভূতি ছিল তা এ ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়। আর তা হলো জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) এর বিখ্যাত ঘটনা। এ ঘটনার নাম 'জাবিরের নিকট উট বিক্রি।' সীরাতে এমন একটি ঘটনা আছে যাকে বলা হয় 'জাবিরের নিকট উট বিক্রি।' ঘটনাটা যে কতটা ভালোবাসাপূর্ণ, শক্তিশালী, আবেগময়, সহানুভূতিশীল এবং মমতাময় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যিই। কিভাবে আপনি এ মানুষটিকে ভালো না বেসে থাকতে পারেন!! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যখন এ ঘটনাটি পড়বেন। জাবির রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পনের বছর বয়সে এতিম হয়ে পড়েন। জাবিরের বয়স ছিল ১৫ যখন তাঁর বাবা আব্দুল্লাহ (রা) ওহুদে শহীদ হয়ে যান। তিনিই ছিলেন একমাত্র ভাই এবং সবার বড়। তাঁর সাতজন বোন ছিল। সাত বোন! দেখাশোনা করার জন্য। আর তিনি ছিলেন সবার বড়। তাই, জাবের দুঃখ-দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় এবং মানসিক চাপে অভিভূত হয়ে পড়েন। দায়িত্বের বোঝা খুব দ্রুতই তার কাঁধে এসে পড়লো। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। জাবের এখন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ভার অনুভব করছেন। একটি অভিযানে... এর দুই বছর পরে, তো জাবেরের বয়স এখন ১৭ বছর। তরুণ মানুষ। সে সময়ের ১৭ বছরের একজনকে আমাদের সময়ের ২৩-২৪ বছরের একজনের সাথে তুলনা করতে পারেন। আমাদের ১৭ বছরের মতো ভাববেন না। আমাদের ১৭ বছরেরগুলা তো...আল্লাহু মুস্তাআন। তাদের কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু সে সময়ের ১৭ বছর। তো, অভিযান থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেয়াল করলেন জাবের খুবই বৃদ্ধ এক উটের পিঠে। এটা ছিল একটি সামরিক অভিযান। আর জাবির বৃদ্ধ এক উটের পিঠে সওয়ার হয়ে আছে। ফলে সে সমগ্র সেনাবাহিনীর পেছনে পড়ে আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সম্মুখভাগে। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন জাবের একেবারে পেছনে পড়ে আছে। তো তিনি তার উটের গতি কমিয়ে দিলেন। লোকদের বললেন সবাই এগিয়ে যাও। প্রত্যেকে এগিয়ে যাও। তিনি তাঁর উটকে স্লো করে দিলেন যেন জাবের তাঁকে ধরতে পারেন। এখন রাসূল (স) এবং জাবের পাশাপাশি চলছেন। সেই সময় জাবের বৃহত্তর পরিসরের বিবেচনায় বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। তিনি মদিনার এক কিশোর মাত্র। জীবনের এ পর্যায়ে তিনি এখনো বিখ্যাত হয়ে উঠেননি। এ পর্যায়ে তিনি আবু বকর ওমরের মত কেউ ছিলেন না। এ মুহূর্তে তিনি শুধুই একজন কিশোর। রাসূল (স) তাঁর উটটির গতি কমিয়ে দিলেন এবং জাবেরের কাছে এলেন। তারপর বললেন- "মাহইয়াম?" যার অর্থ হলো খুবই মমতাময়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করা- "কি খবর তোমার?" এটা ফুসহা নয়, 'কাইফা হালুক' নয়। মাহইয়াম? কি অবস্থা তোমার? আক্ষরিক অর্থেই। এমনকি বাক্যাংশটিও খুবই মোলায়েম। তোমার সব ঠিক আছে তো? উত্তরে জাবের বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা মারা গেছেন। তিনি অনেক টাকা ঋণ রেখে গেছেন। আমাকে সাত বোনের দেখাশোনা করতে হচ্ছে। এভাবে তিনি তাঁকে তার জীবন কাহিনী শোনাতে লাগলেন। এ হাদিসের অনেকগুলো ভার্শন রয়েছে। আমি একটি ভার্শন বর্ণনা করছি। যদি আরও বিস্তারিত জানতে চান আমার সিরাহ লেকচার শুনুন। আমি এখন একটি ভার্শন বলছি। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, জাবেরের জামায় একটি শুকনো দাগ। তখনকার সময়ে শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করলে জামায় সুগন্ধির দাগ লেগে থাকতো। আর ঐ সময়ে সুগন্ধি ছিল দামী জিনিস, তাই এ দাগকে একটি ভালো সাইন মনে করা হতো। বর্তমানে আমরা পারফিউমের কোনো দাগ পছন্দ করি না। তাই, আমাদের পারফিউম কোনো দাগ রেখে যায় না। কিন্তু, ঐ সময়ে আপনি চাইতেন জামায় দাগটা থাকুক, যেন মানুষ বুঝতে পারে আপনি পারফিউম ব্যবহার করেছেন। তো, রাসূল (স) জাবেরকে বললেন- এটা কী? তোমার জামায় পারফিউম! জাবের বললেন- "আমি মাত্র বিয়ে করেছি। ইয়া রাসূলাল্লাহ!" এরপর রাসুল (স) ঐ বিখ্যাত কৌতুকটি করলেন। "তুমি কি তোমার বয়সী কাউকে বিয়ে করেছ? নাকি বয়স্ক কাউকে বিয়ে করেছ?" সে বলল- "না, আমি একটু বয়সী এক মহিলাকে বিয়ে করেছি।" রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- "তোমার বয়সী কাউকে বিয়ে করলে না কেন? তোমরা দু'জনে একত্রে মজা করতে পারতে।" তিনি আক্ষরিক অর্থেই তাকে এটা বলেছেন। আপনাদেরকে ঘটনার প্রসঙ্গটা বুঝতে হবে। তিনি ছেলেটাকে উৎফুল্ল করে তুলতে চাইছেন। "তুলাইবুহা ওয়া তুলাইবুকা, তুদাহিকুহা ওয়া তুদাইকুকা।" তোমরা একত্রে খেলতে পারতে এবং একত্রে হাসতে পারতে। কেন নিজের বয়সী কাউকে বিয়ে করলে না? সে বলল- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি বয়সী একজনকে বিয়ে করেছি কারণ, আমি আমার বোনদের জন্য তাদের মায়ের মত কাউকে চেয়েছিলাম। সুবহানাল্লাহ! তিনি সেক্রিফাইস করছেন। আমার ছোট ছোট বোনদের জন্য এমন কেউ দরকার যার অভিজ্ঞতা আছে। যে বিধবা বা যার সন্তান আছে। তাই, আমি এমন একজনকে চেয়েছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তোমার উটের কি হয়েছে? কেন তুমি সবার পেছনে পড়ে আছ? সে বলল- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি জানেন, আমার বাবা কোনো টাকা পয়সা রেখে যাননি। তিনি ঋণ রেখে গেছেন। আমার কাছে শুধু এ উটটাই আছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন এবং উটটিকে মৃদু আঘাত করলেন। সাথে সাথে উটটি দ্রতগামী একটি উটে পরিণত হয়ে গেলো। দৌড়ে এগিয়ে যেতে থাকলো। এখন রাসূল (স)কে তাকে ধরতে হবে। আর জাবের দারুণ খুশি হয়ে গেলো। আমি মাত্রই টেসলা মডেল এস প্লেইডে আপগ্রেড হয়ে গেলাম। জানেন তো টেসলা প্লেইড কী? নাকি আপনাদের ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে? প্লেইড বিশেষ করে। যদি না জেনে থাকেন গুগলে সার্চ করুন। (সবচেয়ে দ্রুতগতির টেসলা গাড়ি)। মাত্র আমি আপগ্রেইড পেয়ে গেলাম। এখন উটটি প্রাণবন্ত, তেজী। এখন জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে। এটাই এখন আমার উট। এরপর রাসূল (স) বললেন- ”তোমার উটটি আমার নিকট বিক্রি করো, ও জাবের।” ভাবতে পারেন? এ সমস্ত কিছুর পর! তোমার উটটি আমার নিকট বিক্রি করো, ও জাবের। জাবের ১৭ বছরের একটি ছেলে হওয়ায়, অনেকগুলো বোন থাকায়...সে বলল- “আমি পারব না, ও আল্লাহর রাসূল!” না। কারণ, তার বোনেরা আছে। আমি পারব না, ও আল্লাহর রাসূল! এটাই আমার একমাত্র উট। আমি আপনার নিকট এটি বিক্রি করতে পারব না। এটাই আমাদের একমাত্র সম্বল। উটটি বিক্রি করে দিলে আমি কিছুই করতে পারবো না, ব্যবসা, যাতায়াত কোনো কিছুই না। আমার এ উটটি দরকার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আবার বললেন- আমার নিকট এটি বিক্রি করো, ও জাবের। এভাবে দশ বার! তিনি অনুরোধ করে গেলেন। দশ বার!! জাবেরকে বলেছেন উটটি বিক্রি করতে। জাবেরও দশ বার! আমি পারবো না, ও আল্লাহর রাসূল! এভাবে কতবার আপনি না বলতে পারবেন? শেষমেষ জাবের বলল, আচ্ছা আমি আপনার নিকট এটি বিক্রি করবো। তো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুক্তিসঙ্গত একটি মূল্য প্রস্তাব করলেন। কারো কারো মতে- দুই, তিন দিরহাম এরকম কিছু। জাবের বলল- ও আল্লাহর রাসূল! এটা যথেষ্ট নয়। তো, সে বার বার দরাদরি করতে লাগলো। অবশেষে, সে একটি উটের স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে দশগুণ বেশি দামে রাজি হলো। দশগুণ বেশি দামে! জাবের বলল- আচ্ছা আমি আপনার নিকট এটি এরকম অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করবো। কিন্তু ও আল্লাহর রাসূল! আমি কি উটটিতে চড়ে অন্তত মদিনা পর্যন্ত যেতে পারি? যেন বাকি পথটা আমার হেঁটে যেতে না হয়। আমি কি অন্তত কিছু সময়ের জন্য আমার উটটিতে চড়তে পারি? এখান থেকে আসলে ফিকহের পুরো একটি অধ্যায় রচনা করা হয়েছে। ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শর্ত। সুবহানাল্লাহ! ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যেমন, আপনি আপনার পুরনো গাড়িটি বিক্রি করে দিলেন। আর বললেন যে, পাঁচদিন পরে আমি আমার নতুন গাড়ি পাবো। ততদিন পর্যন্ত আমি গাড়িটি চালাতে চাই। গাড়ি আপনার কিন্তু আমাকে পাঁচদিন এটি চালাতে দিতে হবে। এই হাদিস অনুযায়ী এ ধরণের চুক্তি হালাল। তো, আমরা এই হাদিস থেকে ফিকহের নিয়ম কানুনও বের করেছি। আপনি কি আমাকে শহর পর্যন্ত যেতে দিবেন, উটটি আপনার। কিন্তু আমাকে এটুকু করার অনুমতি দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- আচ্ছা ঠিকাছে। এরপর জাবের চিন্তা করতে শুরু করল। "হ্যাঁ, আমি অনেক টাকা পাচ্ছি।" উট কিন্তু গাড়ির মত নয়। উটের সাথে মালিকের এক ধরণের বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। "আমাকে নতুন একটি উট কিনতে হবে। আমার অভ্যাসের সাথে একে খাপ খাওয়াতে হবে। উটটি আমাকে পছন্দ করবে কিনা জানি না। নতুন উটটা ভালো হবে কিনা জানি না।" এভাবে সে চিন্তায় পড়ে গেলো। "আমার উটটি বিক্রি করা কি ঠিক হয়েছে?" দিনশেষে এটি আমার পরিবারের উট। এটা আমাকে চিনে, আমার পরিবারের সবাইকে চিনে। সে এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। কিন্তু যাইহোক, সে একটি চুক্তি করেছে, তাকে চুক্তিটি রক্ষা করতে হবে। সে মসজিদে হেঁটে এলো। চেহারায় কিছুটা দুঃখের ভাব। সে বলল- ইয়া রাসূলাল্লাহ! উটটি আমি বাইরে বেঁধে রেখেছি। তো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলালকে বললেন তাকে ঐ টাকাটা প্রদান করো। তাকে ঐ ৪০ দিরহাম প্রদান করো। জাবের অর্থগুলো নিল এবং বাহিরের দিকে হাঁটা দিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- "ও জাবের! তুমি কোথায় যাচ্ছ?" সে বলল- "আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি, ইয়া রাসূলাল্লাহ!" তিনি বললেন- "তোমার উট?" সে বলল- "ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি আপনার।" রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- "ইয়া জাবের! তুমি কি মনে করেছ আমি প্রতারণা করে তোমার উট তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিবো? টাকাগুলো তোমার এবং যাও, উটও নিয়ে যাও।" তাহলে এই সমগ্র ঘণ্টাব্যাপী উপাখ্যান কি জন্য করা হলো? এটি ছিল একটি হালাল কৌশল। যেন তিনি জাবেরকে কিছু টাকা দিতে পারেন এবং সে যেন মনে না করে যে, এই টাকাটা তাকে সদকা করা হয়েছে। এটি ছিল একটি হালাল কৌশল জাবেরকে উৎফুল্ল করে তুলতে এবং ভালো পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্যের কতগুলো মুদ্রা তাকে প্রদান করতে। এবং তার উটটিকেও শক্তিশালী করে তুলতে। যাও, টাকা এবং উট উভয়টা তোমার। উভয়টা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। যে ব্যাপারটি আমাকে বিস্মিত করেছে তা হলো-- এই মুহূর্তে জাবের সমাজের প্রতিষ্ঠিত কেউ নয়। এই মুহূর্তে জাবের এখনো এমন কিছু করার সুযোগ পায়নি যা তাকে সমাজে উচ্চ মর্যাদা প্রদান করবে। কিন্তু, তবু আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র কাফেলা পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি লক্ষ্য করছেন বিশাল এই কাফেলায় একটি কিশোর কী করছে। তারপর এই কিশোরের দুঃখ কিছুটা লাঘব করতে এবং তাকে এমনভাবে কিছু টাকা দিতে যেন সে অপমানিত বোধ না করে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেন! এখান থেকে যদি আপনি আমাদের রাসূলের চরিত্র, সহানুভূতি এবং দয়া না দেখেন তবে কি আর বলবো। - ড. ইয়াসির কাদি

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট