যে ঢেউ আল-আকসাকে মুক্ত করেছিল

 


যে ঢেউ আল-আকসাকে মুক্ত করেছিল

------------------------*----------------------- ১০৯৯ সালের জুলাই মাসে ক্রুসেডাররা, তাদের দৃষ্টিত, আল আকসা আক্রমণ করে সফলভাবে দখল করে নেয়। আপনারা সবাই জানেন, মধ্যযুগের সবচাইতে ভয়ঙ্করতম গণহত্যা চালিয়েছিল তারা ওখানে। মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সম্পূর্ণ জেরুযালেম শহর গণহত্যার বলী হয়ে যায়। নারী, শিধু, হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে তারা। এর ফলাফল কি হয়েছিল? আমরা বেশীরভাগই সরাসরি ১১৮৭ সালে চলে যাই। এই ঘটনা ঘটেছিল ১০৯৯তে, আর আমরা লাফ দেই ১১৮৭-এ। সেই সালে কি হয়েছিল? সালাহুদ্দিন আইয়্যুবি, হিত্তিনের যুদ্ধ। কিন্তু এই ১০৯৯ থেকে ১১৮৭ এর মধ্যে কতো বছরের ব্যবধান? ৮৮, ৮৯ বছর। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়টা কেমন ছিল? কি হয়েছিল সে অন্তর্বতীকালীন সময়ে? অনেক কিছু! আমরা যদি সালাহুদ্দিনকে সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি বুঝতে না পারি, আমরা যদি সালাহুদ্দিন আসবার পূর্বসুত্রগুলো না ধরতে পারি, তাহলে আমরা স্বপ্ন দেখতেই থাকবো যে, আসমান থেকে আরেকজন সালাহুদ্দিন অলৌকিকভাবে নেমে আসবেন, যা করার করবেন। না, এভাবে হয় না। অনেক অনেক ঘটনা সালাহুদ্দিন তৈরির ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমরা আজকে সেগুলোর কিছু নিয়ে আলোচনা করবো। কারণ আমরা নিজেরাও এখন সেই মধ্যবর্তী সময়ে আছি। আমরা এখন ১০৯৯ আর ১১৮৭ এর মধ্যে আছি। এই বিষয়টা বুঝতে পারছেন আপনারা? ১১৮৭ আসবে। ওয়াল্লাহি ওই দিন আসবেই। আমি আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি তা আসবে। সেদিন আসবে কারন এটাই আল্লাহ তা’আলার ওয়াদা। এতে আমাদের পুরোপুরি ইয়াকিন আছে। কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমরা কি করবো? মিরাকেলের অপেক্ষায় বসে থাকবো শুধু? তৎকালীন মুসলিমরা কিন্তু এরকমটা করেনি। অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু আজকে শুধু প্রধান প্রধান কিছু ঘটনা আর কারণ বলবো। যেগুলো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নাড়া দেয়। আর আমাকে যেগুলো অনুপ্রাণিত করে সেগুলো কিছু হয়তো আপনারাও বুঝতে পারবেন। কারণ আমি যখন অতীতকে দেখি, তখন সরাসরি সালাহুদ্দিনের ঘটনায় ঝাপ মারিনা। আমি দেখি সালাহুদ্দিন কীভাবে শুরু হয়েছিল। আমি খুঁজি বাতাসের এই ঝাঁপটা কোত্থেকে আরম্ভ হয়েছিল। মজার কথা হলো, এই ধারা শুরু হয়েছিল মূলত পার্শ্ববর্তী দামেস্কের এক শহরের একজন আলীমের মাধ্যমে। পার্শ্ববর্তী দামেস্ক শহরের প্রধান কাযীর নাম ছিল যাইনুল ইসলাম আল হারাউই। তিনি দামেস্কের মসজিদে হালাকা দিচ্ছিলেন। আপনারা দামেস্কের সেই জনপ্রিয় মসজিদটি তো চেনেন তাই না? আচ্ছা এই লোক যাইনুল ইসলাম আর আল হারাউই কে ছিলেন? হারাউই কোত্থেকে এলো? কে বলতে পারবে? আল হারাউই? যখন বলে আল হারাউই তার মানে সে হারা থেকে? হাহাহাহা মানে সে হেরাত এর। হেরাত অঞ্চল কোথায়? আফগানিস্তান! দামেস্কতে আমাদের আফগানি এক দেশী শেইখ! তার ঘটনা বেশ আকর্ষণীয়। তাই তার অতীত আমাদের জানা উচিত। আফগানিস্তানে তার জন্ম বেড়ে ওঠা। ঠিক আছে? সেখানকার মাতৃভাষায় কথা বলছেন তিনি। সেখানকার স্থানীয় ভাষা কি? পাখতুন বা যা-ই হোক। আমি খুব ভাল করে মনে করতে পারছি না। ফারসিও আছে। একাধিক ভাষা ওখানে। তো তিনি আরবি শেখা শুরু করলেন। তার পরিবার বেশ দরিদ্র, নিতান্তই গরীব। শৈশবে তিনি অন্য মানুষদের হয়ে লিখে দিতেন। কারণ সবাই তো লিখতে পড়তে পারতো না। তিনি রাস্তার কোণায় বসে বসে যারা লিখতে পারে না তাদের হয়ে লেখার কাজ করতেন। সর্বনিম্ন বেতনের কাজ করতেন তিনি। তারপর টিনেজার বয়সে তিনি হেরাতে তার স্থানীয় এলাকার মসজিদে কুরআন শিক্ষক হলেন। একই সাথে তিনি কুরআন হিফয করলেন, আরবি ভাষায় প্রচণ্ড দক্ষ হয়ে গেলেন। কবিতাতেও দক্ষ হলেন। আরবি খুৎবায় বাগ্নী হয়ে উঠলেন। এরপর ফিকহ শিখে ফকিহ হলেন। তখন সেখানে ছিল হানাফি ফিকহ। এরপর বাগদাদে ভ্রমণ করলেন, সেখানকার রাজপরিবারের সাথে মেলামেশা করলেন। তারা তাকে কাযী হিসেবে দামেস্কে নিয়োগ দিয়ে দিলেন। এমনকি এই গল্পটিও বেশ আশ্চর্যজনক। তো তিনি আফগানিস্তানে জন্মগ্রহন করে, এরপর দামেস্কের প্রধান কাযী হয়ে গেলেন। এখন আমাদের ঘটনায় আসি চলুন। ১০৯৯ এর জুলাই। আকসাতে গণহত্যা চলছে। মানুষজন জান বাঁচাতে পালাচ্ছে ওখান থেকে। তাদের একদল মসজিদুল আকসা থেকে সবচাইতে প্রাচীন মুসহাফটা নিয়ে গেলো। বলা হয়ে থাকে যে এই মুসহাফটি হলো উসমান রাদিআল্লাহু আনহু হতে বরাদ্ধকৃত সেই চারটি প্রধান মুসহাফের একটি। সেটা আকসার গোপন এক স্থানে রাখা ছিল। তো কিছু মুসলিম সেটাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে সেই কুরআন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে কাছের সবচাইতে বড় শহরে উঠলেন। দামেস্ক। শহরে ঢুকেই সর্বপ্রথম তারা উমাউই মসজিদে ছুটে গেলেন। আমাদের যাইনুল ইসলাম আল-হারাউই তখন দামেস্কের সেই গ্র্যান্ড মসজিদে হালাকা দিচ্ছিলেন। এমন সময়ে সবাই দেখতে পেলো একদন ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত উদ্বাস্তু মানুষ মসজিদে ঢুকে চিৎকার করছে। ভিড় জমে গেলো তাদের চারপাশে। এসবই মসজিদের ভেতরেই হচ্ছে কিন্তু। কি হলো? সমস্যা কি? তারা বলল, “আফ্রাঞ্জ অর্থাৎ ফ্রেঞ্চরা আকসা আক্রমণ করেছে। আমরা কয়েকজন মাত্র বাঁচতে পেরেছি। এইযে আমাদের হাতে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুসহাফ।” তারা সবাইকে তাদের নিজের চোখে দেখা সমস্ত ঘটনা বর্ননা করা শুরু করলো। কীভাবে ওরা হাজার হাজার নারী, শিশু হত্যা করেছে নির্দয়ভাবে। জেরুজালেমের রাস্তাঘাট কীভাবে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে। এসব শুনে যাইনুল ইসলাম আল হারাউই ভাবলেন, কিছু একটা করতেই হবে। একটা বিষয় খেয়াল করুন, ফিতনার সময়, যুদ্ধের সময়, দুঃখ-দুর্দশা সংগ্রামের সময়ে কিছু আলেম দরস তাদরিসের মধ্যেই ডুবে থাকতে চান। আমি তাদের দোষ দিচ্ছিনা। তবে তারা শুধু বলেন, এগুলো আমাদের বিষয় না। আমি তাদের সমালোচনা করছি না, তবে অন্যেরা কিন্তু ঠিকই তাদের দায়িত্ব বুঝে ফেলে। তারা বোঝে, শাসক যদি কিছু না করে তবে জনগনকে জাগ্রত করা উলামাদেরই দায়িত্ব। তো হারাউই ঠিক করলেন যে তিনি বাগদাদে ফিরে যেয়ে খলিফাকে দিয়ে মসজিদুল আকসা উদ্ধারের জন্য সর্বাত্বক চেষ্টা করবেন। সব কিন্তু একই সপ্তাহে হচ্ছে। সেই একই সপ্তাহেরই ঘটনা এসব। তো তিনি নিজের হাতের কিতাব বন্ধ করে দিলেন। আর দারস চলবে না। এখন দারস তাদরিসের সময় না। মসজিদুল আকসা পুড়ছে। তাই তিনি মকতব বন্ধ করে দামেস্ক থেকে বাগদাদ যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। বাগদাদ আব্বাসি খেলাফতের রাজধানী। খলিফাকে বোঝাতেই হবে। তিনি সেই লোকদের কয়েকজনকেও নিয়ে গেলেন তার সাথে। তাদের নিয়েই তিনি আব্বাসি খলিফার সামনে সমস্ত আবেদন দাখিল করবেন। তো তিনি বাগদাদ গেলেন। খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খলিফার কর্মচারীরা দিচ্ছে না। “আপনার সাথে দেখা করবার সময় নেই খলিফার। ওনার হাতে সময় নেই এখন।” এভাবে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। দেখুন, তিনি হলেন পুরো মুসলিম বিশ্বের খলিফা। যখন তখন তো দেখা পাওয়া যম্ভব না। খলিফার সাথে দেখা করাটা ঝক্কি ঝামেলার বিষয়। তো তিনি চেষ্টা করছেন তো করছেন। কিছুই হচ্ছে না। তাই এক শুক্রবার। বাগদাদের সবচাইতে বড় মসজিদে জুম্মার খুৎবা চলছে। সাম্রাজ্যের রাজধানী এটা। পুরো উম্মাহর কান এই মসজিদের দিকে। সবাই খুৎবা শুনছে। এমন সময়ে তিনি মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়লেন। আরেকটা বিষয় হলো, এই মসজিদে সামনের ডানদিকে একটি ব্যক্তিগত চেম্বার বানানো আছে শুধুমাত্র খলিফার জন্যে। তিনি প্রাসাদ থেকে গোপন এক সুরঙ্গের মাধ্যমে এটাতে জুম্মার নামায পড়ে আবার প্রাসাদে ফিরে যান। মানুষের সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ কিছুই হয় না। আবু বকর, ওমরের যুগ আর নেই। খলিফারা জনমানুশের সাথে সাক্ষাৎ করেন না আর। মিস্টার ভিভিআইপি, তাই না? তো তিনি প্রাসাদ থেকে সেই চেম্বারে ঢুকেন, আবার সেদিকেই ফিরে চলে যান। প্রাসাদে গিয়ে দেখা না করলে কেউই খলিফাকে দেখতে পারে না। এমন সময়েই আমাদের যাইনুল ইসলাম আল হারাউই মসজিদে ঢুকে সোজা সবার সামনে চলে এলেন। ওটা রমযান মাস ছিল। সবার সামনে একটি রুটি নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলেন! এখন আপনারাই বলুন, মুসলিম কোন সমাজে রমযানের দিনের বেলা প্রকাশ্যে কেউ খেলে কি অবস্থা হবে? কি করবে সবাই? হইচই শুরু হয়ে গেলো! সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। আপনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কতো বড় সাহস! আসতাগফিরুল্লাহ! রমযানের দিনে আপনি মসজিদে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন! আপনার মাথা ঠিক আছে?!?! তখন তিনি সবাইকে বললেন, “রমযানে শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি খাবার দোষে তোমরা আমার উপর এতো ক্ষিপ্ত! কিন্তু যখন আকসাতে আগুন লেগে গেলো, তখন তোমাদের এই আবেগ কোথায় ছিল? কোথায় গেলো সেই ক্রোধ? কোথায় সেই রাগ? রমযানের দিনের বেলা একজন মুসলিম একটু খেয়েছে বলে তোমাদের এতো হইচই, অথচ দেড় লক্ষ মুসলিম মরেই গেলো, আর তোমাদের টু শব্দ নেই!” সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। সুবহানআল্লাহ! তিনি এখানে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ব্যাপারটা। তিনি বললেন, “এইযে আমি এই রেফিউজিদের নিয়ে এসেছি—তাদের দেখিয়ে বললেন—তারা নিজের চোখে দেখেছে। আমি হলাম ফুলান ইবনে ফুলান। দামেস্কের প্রধান কাযী। আমি নিজে এসেছি।” কারণ তখন তো কোন ইন্টারনেট ছিল না যে সবাই চিনবে। নিজের পরিচয় তো দিতেই হবে। “আমি এখানে এসেছিলাম খলিফার সাথে দেখা করে তার সাহায্য চাইতে। অথচ তিনি আমাদের সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি!” তিনি এই কৌশল কাজে লাগাচ্ছিলেন, কোনটা? গণসংযোগ, PR. কাদের সাথে এই গণসংযোগ করছেন? মুসলিমদের সাথেই। সুবহানআল্লাহ। কারণ নইলে বিষয়টা তো সবাই বুঝবে না! আর তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব হইচই জনমত তৈরির কারণে তিনি খলিফার সাথে দেখা করার অনুমতি পেলেন। সুবহানআল্লাহ! এসবের কারণেই খলিফার সাথে সাক্ষাৎ তাঁর হয়েছিল অবশেষে, খলিফার প্রাসাদে, তারই অফিসে! ইশ! যদি তাঁর বক্তৃতা রেকর্ড করা থাকতো! ওয়াল্লাহি! যদি তাঁর এই ঘটনার ভিডিও কেউ করতো তাঁর মোবাইল ফোনে। ইশ! যদি দেখতে পেতাম যাইনুল ইসলাম আল হারাউইর এই কথাগুলো! তাঁর জীবনী যারা লিখেছেন সবাই বলেছেন যে তাকে জিহ্বার নেয়ামত দেয়া হয়েছিল। তাঁর গলার স্বর ছিল গুরুগম্ভির, ভাষা ছিল কারুকার্যপূর্ণ। অর্থাৎ তাঁর মাঝে ইলমের ভারত্ত্ব ছিল, উলামাদের হাইবা ছিল। এটা কিন্তু আপনারা সহজেই ধারণা করতে পারবেন। আমি বুঝতে পারছি। কারণ আমাদের আফগানিস্তানের ভাইদের দেখুন। মাশাআল্লাহ। বেশ লম্বা চওড়া মানুষজন তারা। কল্পনা করাটা কঠিন না, তাই না? চিন্তা করুন। আফগানিস্তানের একজন মানুষ, কোথা থেকে সে খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করছেন! একটু ভেবে দেখুন তো বিষয়টা। আমরা আসলে খলিফার দরবারে তাঁর পূর্ণ আলোচনাটি জানিনা। কিন্তু সেটার প্রভাব বুঝতে পারি। ইতিহাসবিদগন বলেন যে, তাঁর ভাষণ শুনে দরবারের সকলে চুপ হয়ে গেলো। কেউ কেউ কাঁদছিল। এমনকি খোদ খলিফা পর্যন্ত মাথা নিচু করে ছিল লজ্জায়। তাঁর দুয়েকটি কথা শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় এসেছে। তিনি খলিফাকে বলছেন, “এখানে আপনি প্রাসাদে বসে বসে বিলাসী জীবন উপভোগ করছেন”, আঙ্গুল তাক করে খলিফার বিলাসী জিনিস দেখাচ্ছিলেন তিনি, “আর ওদিকে আকসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাণ্ডব চালানো হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে। অথচ আপনার একটি আঙ্গুলও এতে নড়েনি!” তিনি এমন এক ভাষণ দিয়েছিলেন যা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে ভয় করে এমন আলীমই দিতে পারে। কারণ তাঁর এই শক্ত বক্তব্য যদি কোন বদ শাসকের উপর হয়, তাহলে বুঝতেই পারছেন তার কি অবস্থা হতে পারে। রাজনীতির বাস্তবতা তো আপনারা জানেনই। বেশী কিছু বলতে চাই না। এখনো মুসলিম দেশগুলোর জেলে প্রচুর আলেম... তো যাই হোক। আমি বেশী বলতে চাচ্ছি না, আপনারা তো বুঝতে পারছে কি বলতে চাচ্ছি। তো আপনারা দেখলেন যে তিনি খলিফার সাথে কথা বলছেন। এমনকি খলিফাকে পর্যন্ত লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন তিনি! একজন অনারব হিসেবে আমাকে এটা আলাদা করে বলতে হচ্ছে। আমিও কিন্তু এই ব্যাপারটার ভার বুঝতে পারছি। মাশাআল্লাহ! কোত্থেকে কোথায়! তাহলে দেখুন, খলিফা পর্যন্ত লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। কিছুই বলতে পারলো না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, “কিছু একটা করবো ইনশাআল্লাহ।“ কিন্তু দেখুন, এখানেই কিন্তু এক করুন বাস্তবতা। যেসব মানুষ ইতিহাস ঠিকমত পড়ে না, তারাই অতীতকে সিনেমার মতো মনে করে। সেই সময়ে খলিফার আসলে কোন ক্ষমতাই নেই, সে কেউ না। পুতুল শুধুমাত্র। ইংল্যান্ডের কুইন-এঁর মতো। আসে যায়, মরে যায়, কেউ পাত্তা দেয় না। অথবা ইংল্যান্ডের কিং এর মতো। একটি রাবার স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছুই না। খলিফার সেই সময়ে কোন সেনাবাহিনীও ছিল না। কারণ সেই সময়ে খলিফা শুধুমাত্র দেখানোর জন্যেই খলিফা।
২য় অংশঃ আমাদের ইতিহাসের বেশীরভাগ সময়ে, আব্বাসি খিলাফতের বেশীরভাগ সময়ে, এমনকি অটোমান খিলাফতেরও বড় সময় ধরে, আসল ক্ষমতা কখনোই খলিফার হাতে ছিল না। ওটা শুধুমাত্র একটি পদবি, একটি অফিসের নাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বরং ক্ষমতা তো ছিল পর্দার আড়ালের লোকেদের হাতে। উজিরগন, অথবা খলিফার চোখের নীচেই যেসব বংশ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। বুয়াইহিদ রাজবংস ছিল এর আগে। আর তখন ছিল সেলজুকরা। তাই না? সেই সময়ের ক্ষমতাশালীরা ছিল মূলত সেলজুক বংশ। তাদের হাতেই সব ক্ষমতা, খলিফার হাতে কিছুই নেই। সেনাবাহিনীও নেই। এমনকি বাগদাদের কর্তৃত্বও নেই তার। তিনি তো শুধুমাত্র অনেক সম্পদ ওয়ালা একজন প্রতিনিধি মাত্র। তার হাতে কোন ক্ষমতাই নেই। তবুও তিনি মিনমিন করে বললেন আর কি, যে কিছু করবেন। কিন্তু এতে কিছুই যায় আসে না। যাই হোক, পরের সপ্তাহে হারাউইকে খুৎবা দিতে দেয়া হলো। চিন্তা করুন, সেই হইচই করবার পর তাকে খুতবাহ দিতে দেয়া হলো! তিনি খুৎবা দিলেন। আর এমনই খুৎবা দিলেন যে বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় কান্না রোল পড়ে গেলো। মানুষের মধ্যে আবেগ বেড়ে গেলো, কিছু একটা তো করতেই হবে। তিনি মানুষের আবেগ জাগিয়ে তুললেন। সুবহানআল্লাহ! এদিকে অল্প কিছু বছরের মধ্যেই ক্রুসেডাররা তো তাদের দৃষ্টিতে আকসা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলই। সাথে আবার আরও কয়েকটি ছোট রাজবংশও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল তারা। চার পাঁচটি রাজবংশ। আবার এই ইতিহাসও আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে ক্রুসেডাররাও কখনোই একতাবদ্ধ ছিল না। تَحْسَبُهُمْ جَمِيعًۭا وَقُلُوبُهُمْ شَتَّىٰ বাস্তবতা হলো, খোদ ক্রুসেডাররাই বহু দলে বিভক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ইটালিয়ান ছিল, ফ্রেঞ্চরা ছিল। আরও ছিল ব্রিটিশ। সব স্থানে বিভিন্ন দল ছিল ওদের। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেক দল ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের উপর রাজত্ব ক্রছে। তাই অল্প কয়েক বছরের মাঝেই উপকুল অঞ্চলগুলোতে ক্রুসেডারদেরই চার পাঁচ ছয় ধরণের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রধান প্রধান কিছু শহরগুলো হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যেমন ধরুন হালাব বা এলেপ্পো। সেটাও এখন হুমকির মুখে। তাই আবারও সমস্ত উলামা মিলে খলিফার কাছে আবেদন করবার চেষ্টা করলেন। আচ্ছা আরেকটি বিষয়, আপনাদের জানা উচিত। এমন ভাববেন না যে আগেরযুগের শাসকরা আজকের তুলনায় ভালো ছিল। যেমন ধরুন, সেই সময়ে আলেপ্পো মানে হালেবের শাসক, তাকে কেউ ভালো হিসেবে জানতো না। ইতিহাসে তাকে কেউই প্রশংসা করেনি। তার নাম রুদওয়ান অথবা রিদওয়ান। দুঃখের বিষয় এই যে, যখন ইউরোপিয়ান, ফ্রেঞ্চ আর্মি অর্থাৎ ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন আক্রম করতে আসছিল তখন এই রিদওয়ান নিজের ভাইয়ের সাথে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। কে কুরসিতে বসবে তা নিয়ে! এদিকে ক্রুসেডাররা আসছে। বাড়াবাড়ি করে বলছি না। তারা তাদের চোখের সামনে দিয়েই যেন চলে গেলো। একদম তাদের থেকে একটু দূরত্বে, অথচ এদের কোন খবর নেই!

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট