যায়িদ (রা.) ছিলেন কোরআনের সংকলক

 


রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, হজরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর বয়স তখন ১১ বছর। সেই বালক বয়সে তিনি ১৭টি সুরা মুখস্থ বলতে পারতেন। লোকেরা তাঁকে রাসুল (সা.)-এর কাছে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম পরিচয়ের দিন তিনি রাসুল (সা.)-কে সুরা কাফ তিলাওয়াত করে শোনান। রাসুল (সা.) তিলাওয়াত শুনে অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন।

রাসুল (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি যায়িদ (রা.) মদিনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের সদস্য ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কোরআন পড়তে শুরু করেন। মানুষ তাঁকে খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত। মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি।

বদর যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর। রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তিনি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যুদ্ধ করার মতো বয়স না হওয়ায় রাসুল (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে ফেরত পাঠান। ওহুদ যুদ্ধেও বয়স কম হওয়ার কারণে তিনি যাওয়ার অনুমতি পাননি। খন্দকের যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

যায়িদ (রা.)-এর পুরো জীবন ব্যয় হয়েছিল ভালো কাজে। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সচিব ও ওহি লেখক। তাই তাঁকে ‘কাতিবুল ওহি’ বা ওহি লেখক বলা হয়।ওহি নাজিল হওয়ার পর যায়িদ (রা.) কলম, দোয়াত, কাগজ, খেজুরের পাতা, চওড়া ও পাতলা হাড়, পাথর ইত্যাদি নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর পাশে বসে যেতেন। রাসুল (সা.) বলে যেতেন আর তিনি লিখতেন। সঙ্গে সঙ্গে সেসব মুখস্থ করে ফেলতেন। এভাবে রাসুল (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায় পুরো কোরআন তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়।

যায়িদ (রা.) অধিকাংশ সময় রাসুল (সা.)-এর পাশে বসে থাকতেন। রাসুল (সা.) কখনো কখনো নিজের হাঁটু যায়িদের ঊরুর ওপর রেখে দিতেন। একদিন সে অবস্থায় ওহি নাজিল হয়। যায়িদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর হাঁটু সে সময় এত ভারী ছিল যে আমার মনে হচ্ছিল, আমার হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু বেয়াদবি হবে এই ভয়ে আমি টুঁ–শব্দটিও করিনি।’ (মুসনাদ: ৫/১৮২)

যায়িদ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় চিঠিপত্র লিখতেন এবং যেসব চিঠি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসত, সেগুলো পড়ে শোনাতেন।

রাসুল (সা.) মদিনায় আসার পর পাশের বিভিন্ন দেশ ও এলাকার রাজা-বাদশা, আমির ও গোত্রপ্রধানদের চিঠি আসত। সেসবের বেশির ভাগ থাকত সুরইয়ানি ও ইবরানি (হিব্রু) ভাষায়। এ কারণে এ ভাষা দুটি জানা মুসলিমদের জন্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

রাসুল (সা.) এ প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করলেন। তিনি যায়িদ (রা.)-এর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে এ কাজের জন্য নির্বাচন করলেন।যায়িদ (রা.) কোরআনের সংগ্রাহক ও সংকলক। রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের সময় ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০ জন হাফেজে কোরআন শহীদ হন। তখন আশঙ্কা দেখা দেয়, এভাবে হাফেজে কোরআন শহীদ হতে থাকলে কোরআনের বড় একটি অংশ হারিয়ে যেতে পারে। সে আশঙ্কা থেকে সিদ্ধান্ত হয়, পুরো কোরআন এক জায়গায় সংকলন করা হবে। আবু বকর (রা.) যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.)-কে ডেকে বললেন, তুমি মেধাবী যুবক। তোমার প্রতি সবার বিশ্বাস আছে। তুমি রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় ওহি লিখেছিলে। কাজটা তুমিই করো।

যায়িদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি দল কোরআন সংগ্রহ করার কাজ হাতে নিল। তাঁরা খেজুরের পাতা, পাতলা পাথর ও হাড়ের ওপরে লেখা কোরআনের সব অংশ সংগ্রহ করে হাফেজদের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে থাকেন। আয়াতের সত্যতা ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিটি আয়াতের ব্যাপারে তিনি কমপক্ষে দুজন ব্যক্তির সাক্ষ্য নিতেন।

কঠোর পরিশ্রম করে যায়িদ (রা.) গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শেষ করেন। সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ কোরআনের সেই কপি খলিফা আবু বকর (রা.) নিজের হেফাজতে রাখেন। তাঁর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর হাত হয়ে তা রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী হাফসা (রা.)-এর কাছে সংরক্ষিত হয়।

হজরত আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)–এর আমলে তিনি তাঁদের মজলিশে শুরার বা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।

খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে আলাদা করে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যায়িদ (রা.)-কে মদিনার বিচারক নিযুক্ত করেন। রাজধানী মদিনা এবং এর আশপাশের মামলাগুলো যায়িদ (রা.)–এর আদালতে উপস্থাপিত হতো। যায়িদ (রা.)-এর ওপর উমর (রা.)-এর আস্থা এত বেশি ছিল যে মদিনার বাইরে সফরে গেলে তিনি তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। খলিফা উসমান (রা.) তা–ই করতেন। উমর (রা.)-এর খিলাফতের সময় যায়িদ (রা.) এভাবে মোট তিনবার খলিফার সম্মানজনক পদের দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জন করেন।

রাসুল (সা.)-এর সময়কালে গনিমতের যে সম্পদ আসত, তা বেশির ভাগ যায়িদ (রা.) বণ্টন করতেন। ফিকাহ শাস্ত্রের ‘ফারায়েজ’ বা ‘মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তি’ বিষয়ে যায়িদ (রা.)-এর ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। অঙ্কে তাঁর এত পারদর্শিতা ছিল যে ফারায়েজ শাস্ত্রের খুব জটিল ও সূক্ষ্ম মাসয়ালাগুলো তিনি অঙ্কের মাধ্যমে অনায়াসে সমাধান করতেন। যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.) হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক ছিলেন। তাঁর বর্ণনা করা হাদিসের সংখ্যা ৯২।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট