আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব
আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। কুরআন থেকে প্রাপ্ত আজকের শিক্ষাটি হলো সূরা রা’দের আয়াত নাম্বার ২৮। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব। আমরা সকলেই এই আয়াতটি আগে শুনেছি। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা কুরআনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা এবং মূলনীতি। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব। ‘আলা’ শব্দটি কুরআনে খুব কমই ব্যবহৃত হয়েছে। আর এটার অনন্য একটি ভূমিকা রয়েছে। বাংলায় এর সমতূল্য কোনো শব্দ নেই। ‘আলা’ হলো তিনটি বর্ণ সংবলিত একটি শব্দ। যার কাজ হলো বাক্যের পরবর্তী অংশটির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা। এটাকে বলা হয় হারফুত তানবীহ (حَرْفُ التَّنبيهِ)। এর দ্বারা আপনি মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ইংরেজিতে যেমন বলা হয়, “হেই ইও (hey yo) ! আমার কথা শুনো।” ‘আলা’ শব্দটিও একই ধরণের অর্থ প্রকাশ করে। ‘হেই ইও’ (hey yo) বলার পর বাচ্চাদের অনেকেই আমার দিকে তাকিয়েছে; তাই না ? তো ‘আলা’ মূলত এটাই। ‘আলা’ শব্দটি কুরআনে খুবই কম ব্যবহৃত হয়েছে। হয়তো পাঁচ-ছয় বার বা তারও কম সংখ্যক বার কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এর উদ্দেশ্য হলো, মনোযোগ দাও, খেয়াল করো। এর অর্থ আল্লাহ কোনো বিষয়ে জোর দিয়ে বলতে চেয়েছেন; তিনি আমাদেরকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলছেন। এখানে আল্লাহ আমাদেরকে কী মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলছেন ? بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব, অর্থাৎ আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে হৃদয়সমূহ প্রশান্তি খুঁজে পায়। এখানে কৌতুহল জাগ্রতকারী আরেকটি ব্যাকরণগত বিষয় হলো, আরবি ভাষায় যখনই বিধেয়টি ক্রিয়াপদের আগে স্থাপন করা হয়, তখন এটা ‘শুধুমাত্র’ বা ‘একমাত্র’ অর্থ প্রদান করে। আমি আপনাদেরকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। إِيَّاكَ نَعْبُدُ - ইয়্যাকানা’বুদু। আপনি এটাকে এভাবেও বলতে পারেন نَعْبُدُكَ - না’বুদুকা - আমরা আপনার ইবাদাত করি। কিন্তু যখন আপনি বিধেয়টিকে ক্রিয়াপদের আগে নিয়ে আসেন, এর দ্বারা আপনি ‘শুধুমাত্র’ বা ‘কেবলমাত্র’ অর্থটি বুঝাচ্ছেন। যদি আপনি স্বাভাবিকভাবে نَعْبُدُكَ - না’বুদুকা বলেন, এর দ্বারা ‘কেবলমাত্র’ বা ‘শুধুমাত্র’ অর্থটি বুঝাবে না। نَعْبُدُكَ - না’বুদুকা অর্থ, হে আল্লাহ, আমরা আপনার ইবাদাত করি। إِيَّاكَ نَعْبُدُ - ইয়্যাকানা’বুদু অর্থ কী ? হে আল্লাহ, আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদাত করি। আরবি ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা। সেজন্যই আপনি যদি ব্যাকরণ না জেনে থাকেন বা না শিখে থাকেন, কখনোই আপনি কুরআন এবং সুন্নাহর চমৎকারিত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারবেন না। পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা নেই যা আরবির মতো এতোটা চমৎকার, সূক্ষ্ম অর্থবহ এবং দার্শনিক ভাবধারা সমৃদ্ধ। উপরের উদাহরণটি সরল একটি উদাহরণ। তো আল্লাহ যখন বলেছেন, أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব। এর দ্বারা কোন বার্তাটি প্রদান করা হচ্ছে ? শুধুমাত্র আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে আপনার হৃদয় প্রশান্তি খুঁজে পাবে। শুধুমাত্র এর মাধ্যমে। ও মুসলিম, আপনি অন্য কোনো কিছুতেই প্রশান্তি খুঁজে পাবেন না। আপনি স্বস্তি পাবেন না, আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি পাওয়া যাবে না আল্লাহর যিকির ছাড়া। এই গোটা পৃথিবী এবং এর ভিতরের কোনো কিছুই আপনাকে প্রশান্তি প্রদান করবে না। সকল কামনা-বাসনা, সকল শাহাওয়াত, এই পৃথিবীর সকল পানাহার এবং ইন্দ্রিয়-সুখ কখনোই কখনোই আপনাকে অন্তর্নিহিত প্রশান্তি প্রদান করতে পারবে না। সেই প্রশান্তি শুধুমাত্র একটি উপায়েই অর্জিত হতে পারে। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব। আর এজন্যই যিকির নিয়ে কুরআনের এতো বেশী সংখ্যক আয়াত রয়েছে এবং হাদীস গ্রন্থগুলোও যিকিরের তাৎপর্য দিয়ে পরিপূর্ণ। সময় সীমিত, কিন্তু সংক্ষেপে আমরা নিজেদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এখন আমরা ২৫তম রাত্রিতে রয়েছি, আর রমজান মাস সমাপ্তির পথে। আর প্রিয় ভাইয়েরা, কথাটি বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে; দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাঁচ দিন পরেই এই মসজিদের উপস্থিতি অর্ধেক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার নিজের প্রতি এবং আপনাদের সকলের প্রতি আমার উপদেশ হলো, আল্লাহর যিকির একারণে বন্ধ করে দিবেন না যে, রমজান মাস শেষ হয়ে গেছে। ইবাদাত এবং তেলাওয়াত বন্ধ করে দিবেন না এজন্য যে, এই মাসটি শেষ হয়ে গেছে। কারণ এই মূলনীতি, বিধান এবং এই রত্নগুলো এই মাসের পরেও প্রযোজ্য হবে ঠিক যেভাবে এগুলো এখন প্রযোজ্য। আর এজন্যই আল্লাহ কুরআনে আমাদেরকে আদেশ করেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ - ইয়া আইয়্যুহাল্লাযিনা আমানু উযকুরুল্লাহা। (হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জিকির করো)। কী পরিমান ? ذِكْرًا كَثِيرًا - যিকরান কাসিরা। কুরআনে কোনো আদেশ এরকমভাবে কমই এসেছে। اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا - উযকুরুল্লাহা যিকরান কাসিরা। سَبِّحُوْهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا - সাব্বিহুহু বুকরাতান ওয়া আছিলা। (আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর কর।) এমন আদেশ কমই এসেছে যা এই ধরণের ইবাদাতকে উৎসাহিত করেছে - সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা, সকাল বিকাল তাঁর প্রশংসা করা। আর বিখ্যাত সেই দীর্ঘ আয়াতটিতে, إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ - ইন্নাল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাতি ওয়াল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাতি; ১৫ টি বিশেষণ এবং বৈশিষ্ট্য সেখানে রয়েছে; যারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন তাঁদের সেই গুণাবলীর সর্বশেষটি হলো, وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ - ওয়ায যাকিরিনাল্লাহা কাসিরান ওয়ায যাকিরাতি, অর্থাৎ সেইসকল পুরুষ এবং নারী যারা সর্বদা আল্লাহর যিকির করে। আর সেজন্যই যারা যিকির করে, আল্লাহ তাঁদেরকে বিচক্ষণ মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যিকির করাটা বিচক্ষণতার লক্ষণ। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ - ইন্না ফি খলক্বিসসামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফিল্লাইলি ওয়ান্নাহারি লাআয়াতিল লিউলিল আলবাব। অর্থাৎ বিচক্ষণ মানুষদের জন্য নিদর্শন রয়েছে সৃষ্টিজগতের মাঝে। সেই বিচক্ষণ মানুষরা কারা ? তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, اَلَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللَّهَ قِيَـٰمًۭا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوْبِهِمْ - আল্লাযিনা ইয়াযকুরুনাল্লাহা ক্বিয়ামাও ওয়াক্বু’উদাও ওয়া’আলা জুনুবিহিম। অর্থাৎ তারা সার্বক্ষণিক যিকিরে রত থাকে - যখন তারা দন্ডায়মান থাকে, যখন বসে থাকে, যখন শুয়ে থাকে। তারা যেখানেই থাকুক, তারা কোনো মিটিংয়ের অপেক্ষায় থাকতে পারে, গাড়ি চালনারত অবস্থায় থাকতে পারে, ইন্টারনেটে কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও কলে যুক্তে থাকতে পারে, যেই অবস্থাতেই তারা থাকুক, জিহ্বাটিকে সর্বদা যিকিরে ব্যস্ত রাখে। এভাবেই আল্লাহ বিচক্ষণ মানুষদের বর্ণনা দিচ্ছেন। আর সেজন্যই কুরআনে আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, শয়তানের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষাগুলোর একটি হলো, আমাদেরকে যিকির থেকে বিরত রাখা। এটা শয়তানের শক্তিশালী কৌশলগুলোর একটা। আর প্রসঙ্গক্রমে, সেই কৌশল বাস্তবায়নে সোশ্যাল মিডিয়া আর টেলিভিশনের চেয়ে বড় উপকরণ আর কি হতে পারে ? এগুলোই যিকির থেকে বিরত রাখার উপকরণ। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন যে, হে ইমানদারগণ, إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ - ইন্নামা ইউরিদুশ শাইতনু আই ইউক্বি’য়া বাইনাকুমুল ‘আদাওয়াতা ওয়াল বাগদআ ফিল খমরি ওয়াল মাইসিরি ওয়া ইয়াছুদ্দাকুম ‘আন যিকরিল্লাহি ওয়া ‘আনিছছলাত। অর্থাৎ শয়তান তোমাদেরকে প্রলুব্ধ করবে মদ্যপানের দিকে, আর সে তোমাদেরকে প্রলুব্ধ করবে জুয়ার দিকে। কিন্তু তার প্রকৃত লক্ষ্য মদ্যপান আর জুয়া নয়। তার প্রকৃত লক্ষ্য হলো তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে বিরত রাখা। খেয়াল করুন, আল্লাহ বলছেন, এটা ঠিক আছে যে, মদ্যপান এবং জুয়া খারাপ। কিন্তু এর পেছনে আরো মারাত্মক লক্ষ্য রয়েছে। আর সেই মারাত্মক লক্ষ্যটি কি ? يَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ - ইয়াছুদ্দাকুম ‘আন যিকরিল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর যিকির থেকে তোমাদের বিরত রাখা। فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ - ফাহাল আনতুম মুনতাহুন ? সুতরাং এখনো কি তোমরা নিবৃত্ত হবেনা ? আল্লাহ কুরআনে প্রশ্ন করছেন - তোমরা কি উপলব্ধি করবে না যে, এটা শয়তানের লক্ষ্য ? [sura 5, ayat 91] আর সেজন্যই আল্লাহ ইমানদারদের বর্ণনা দিয়েছেন এই বলে যে, যাদেরকে কোনো কিছুই আল্লাহর যিকির থেকে বিরত রাখতে পারে না। এমনকি তাদের জীবিকাও না, কোনো কিছুই না। لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ - লা তুলহিহিম তিজারাতুন ওয়ালা বাই’উন ‘আন যিকরিল্লাহি ওয়াইক্বামিছছলাত। অর্থাৎ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেন-দেন কখনোই তাঁদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে বিরত করতে পারে না। সারাদিনব্যাপী, এমনকি তারা যখন কেনা-বেচায় রত থাকে, কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে, প্রতিনিয়ত তারা আল্লাহর যিকিরে রত থাকে। আল্লাহ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, যিকিরের মাধ্যমেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারি। এমনকি সবচেয়ে কঠিন সময় অর্থাৎ যুদ্ধ এবং ক্বিতালের সময়ও। আল্লাহ বলেছেন, হে ইমানদারগণ, যখন তোমরা কোনো শত্রুর সম্মুখীন হও, فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا للَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ - ফাসবুতু ওয়াযকুরুল্লাহা কাসিরান, লা’আল্লাকুম তুফলিহুন, অর্থাৎ যখন তোমরা কোনো শত্রুর সম্মুখীন হও, যুদ্ধে অটল থাকো, আর অটল থাকা অবস্থায় অতিমাত্রায় আল্লাহ যিকির করতে থাকো যদি বিজয়ী হতে চাও। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে যখন তরবারীগুলো চলমান থাকে, তখনও যিকির করতে থাকো যদি বিজয়ী হতে চাও। যদি যিকির আপনাকে যুদ্ধের ময়দানেও সাহায্য করে, তাহলে আপনার দৈনন্দিন জীবনে এটা কতোটা প্রয়োজনীয়, আপনার বিবাহের ক্ষেত্রে এটা কতোটা প্রয়োজনীয়, আপনার লেনদেনের ক্ষেত্রে এটা কতোটা প্রয়োজনীয়, আপনার ঘরের বারাকার জন্য এটা কতোটা প্রয়োজনীয় ! আল্লাহ বলছেন, যিকির তোমাকে যুদ্ধের ময়দানে সাহায্য করবে। এটা প্রকৃত যুদ্ধ, রূপক যুদ্ধ নয়। তাহলে রূপক যুদ্ধের জন্য এটা কতো প্রয়োজনীয়। সেই যুদ্ধগুলোর জন্য এটা কতোটা প্রয়োজনীয় যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে করে থাকি ! যিকির আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সাহায্য করবে।
আর সেজন্যই আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর যিকির থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সেই ব্যক্তি শোচনীয় একটা জীবন যাপন করবে। আপনি কখনোই সুখী হতে পারবেন না। وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ - ওয়ামান আ’রদা ‘আন যিকরি ফাইন্না লাহু মা’ইশাতান দনকা, ওয়ানাহশুরুহু ইয়াওমাল ক্বিয়ামাতি আ’মা, অর্থাৎ, আমার যিকির থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে মর্মান্তিক একটা জীবন যাপন করবে। এটা কুরআনেই রয়েছে। مَعِيشَةً ضَنكًا - মা’ইশাতান দনকা, অর্থাৎ এটা হবে অন্ধকার, শোচনীয় একটা জীবন। আল্লাহর যিকির ছাড়া আপনি সুখী হতে পারবেন না এবং আল্লাহ আপনাকে বিচার দিবসে অন্ধ করে উঠাবেন। আর এই কারণেই, যে নিয়মিত আল্লাহর যিকির করে, সেই ব্যক্তিই চূড়ান্ত সুখ এবং চূড়ান্ত প্রশান্তি লাভ করবে।
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ - ওয়ালা যিকরুল্লাহি আকবার। ওয়ালা যিকরুল্লাহি আকবার। ওয়ালা যিকরুল্লাহি আকবার। এটা দিয়ে কী বুঝাচ্ছে ? আল্লাহর যিকিরের থেকে উত্তম এবং বড় আর কিছু নেই। অন্য যা কিছুই আপনি চিন্তা করেন, অন্য যা কিছুই আপনি কল্পনা করেন, وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ - ওয়ালা যিকরুল্লাহি আকবার। আল্লাহর যিকির হলো উত্তম এবং বড়, অন্য যে- -কোনো জিনিসের তুলনায়।
আর সেজন্যই, যখন আমরা আল্লাহর যিকির করবো, আল্লাহও আমাদেরকে স্মরণে রাখবেন এমনভাবে, যা আমাদেরকে রক্ষা করবে, যা আমাদেরকে পথপ্রদর্শণ করবে, যা আমাদেরকে আশীর্বাদপুষ্ট করবে। فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ - ফাযকুরুনি আযকুরকুম। ফাযকুরুনি আযকুরকুম। অর্থাৎ, তোমরা আমার যিকির করো, আর আমিও সর্বদা তোমাদের স্মরণে রাখবো, যিকির করবো। অবশ্যই এখানে আল্লাহ যিকির করবেন বলতে এটা বুঝায় না যে, আমরা আল্লাহর কাছে অপরিচিত। এর অর্থ, আল্লাহ মনোযোগ দিবেন এবং তত্বাবধান করবেন। আল্লাহর রহমাহ, আল্লাহর বারাকাহ, আল্লাহর প্রশান্তি নেমে আসবে। যখন আমরা আল্লাহর যিকির করবো, তখন সকল আশির্বাদ আমাদের উপর বর্ষিত হবে।
আর শুধুমাত্র সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকরার বলে জিহ্বার নড়া-চড়া করানোই যিকির না। এটি যিকিরের একটি ধরণ। আর এটি যিকিরের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধরণ। কিন্তু কুরআনও একটি যিকির। وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ - ওয়া আনযালনা ইলাইকায যিকরা। কুরআন হলো চূড়ান্ত যিকির। কুরআন অধ্যয়ন, কুরআন শ্রবণ, কুরআন মুখস্ত করাও যিকির। নামাজও একটি যিকির। وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكْرِيْ - ওয়া আক্বিমিস ছলাতা লিযিকরি। নামাজও একটি চূড়ান্ত যিকির। হজ্বও একটি যিকির। وَاذْكُرُواْ اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ - ওয়াযকুরুল্লাহ ফি আইয়্যামিম মা’দুদাত। فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللّهَ - ফাইযা আফাদতুম মিন ‘আরাফাতিন ফাযকুরুল্লাহ। হজ্ব মূলত যিকির ছাড়া আর কিছুই নয়। রোজার ব্যপারে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, যখন তোমরা রোজা সমাপ্ত করো, তারপর, فَاذْكُرُوْا اللهَ كَمَا هَدَاكُمْ - ফাযকুরুল্লাহা কামা হাদাকুম - ঈদের দিনে আল্লাহর যিকির করো, যেভাবে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যেকটি প্রথাই যিকির। আল্লাহর সাথে আমাদের প্রত্যেকটি যোগাযোগই যিকির। দোয়া একটি যিকির। কুরআন একটি যিকির। তাসবীহ পড়ে ঠোঁট নাড়ানোও যিকির। এক কথায় এটা বলা যায় যে, ধর্মপরায়নতাই হলো আল্লাহর যিকির। আসলেই এটা তাই। ধর্ম সম্পর্কিত যে কোনো কিছুই করা হোক, সেটাই আল্লাহর যিকির। সেজন্যই ও মুসলিম, وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ - ওয়ালা যিকরুল্লাহি আকবার। আপনার এবং আমার মাঝে যে ধর্মপরায়নতা রয়েছে, এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এই ধর্মপরায়নতা ছাড়া আপনি প্রশান্তি খুঁজে পাবেন না। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব।
রমজান মাস সমাপ্তির পথে রয়েছে। চার দিন পরে আর কোনো তারাবীহ হবে না এই বছরের জন্য। কিন্তু তারপরও আল্লাহর যিকির জারী থাকতে হবে। ধর্মপরায়নতা অব্যাহত থাকতে হবে। আল্লাহর সাথে এবং ইসলামের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তা অটুট রাখতে হবে, যদি আমরা সুখী হতে চাই। আপনাদের মধ্যে কে আছে যে সুখী হতে চায় না ? আমরা সকলেই কি সুখী হতে চাই না ? সেক্ষেত্রে আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অর্জন করার একটিমাত্র পথই রয়েছে - أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ - আলা বিযিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল ক্বুলুব। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা হোলেন - اَلذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ - আযযাকিরিনাল্লাহা কাসিরান ওয়ায যাকিরাত। আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
--ইয়াসির কাদি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন