উম্মাহর বর্তমান অবস্থা এবং সূরা কাহাফ


 উম্মাহর বর্তমান অবস্থা এবং সূরা কাহাফ

------------------------------------------------- সূরা কাহাফের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-- قَيِّمًۭا لِّيُنذِرَ بَأْسًۭا شَدِيدًۭا مِّن لَّدُنْهُ وَيُبَشِّرَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًۭا - অর্থগুলো ভেঙে ভেঙে বলছি। قَیِّمًا একে (অর্থাৎ কুরআনকে) করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, কুরআনের বিধানগুলোতে কোনো পরিবর্তন নেই। দুনিয়া পরিবর্তন হয়ে গেলেও এতে কোনো পরিবর্তন হবে না। لِّيُنذِرَ بَأْسًۭا شَدِيدًۭا مِّن لَّدُنْهُ তাঁর পক্ষ থেকে কঠিন এক যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য। وَيُبَشِّرَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ এবং সেই মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য যারা সৎকর্ম করে। أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًۭا নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান। আয়াতের দ্বিতীয় অংশের بَأْسًۭا শব্দটির অর্থ যুদ্ধ লিখেছি। কারণ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত মানাজির আহসান গিলানির মতে, কুরআনে যেখানেই بَأْسًۭ বা'স শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা ব্যবহার করা হয়েছে শুধু দুনিয়ার জন্য। যেমন, সূরা বনী ইসরাইলের পঞ্চম আয়াতে এসেছে-- بَعَثۡنَا عَلَیۡکُمۡ عِبَادًا لَّنَاۤ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ - "তখন আমি তোমাদের উপর আমার কিছু বান্দা পাঠালাম, যারা কঠোর যুদ্ধবাজ।" তাই, এখানেও শব্দটি দুনিয়ার জন্যই এসেছে। এরপর আল্লাহ বলেছেন-- مِّن لَّدُنْهُ বিশেষভাবে তাঁর পক্ষ থেকে। মানে-- এ যুদ্ধটা হবে এমন এক যুদ্ধ দুনিয়াতে যার অন্য কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কঠোর এক যুদ্ধ যা শুধু আল্লাহর বিশেষ অনুমতিক্রমে ঘটবে। খ্রিস্টানরা যাকে বলে আর্মাগেডন। হাদিসে যাকে বলা হয় আল-মালহামা। এখন, আমি মানাজির আহসান গিলানির মাথানষ্ট করা বিস্ময়কর কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করবো। রেডি আপনারা? মানাজির রাহিমাহুল্লাহ? উহ! এই মানুষটার চিন্তাধারা ছিল অন্য লেভেলের। আল্লাহ তার জন্য চিন্তার দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। শুনুন তাহলে এ সূরা নিয়ে উনার চিন্তাধারা। খুবই এপিক! তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন এই উম্মাহ কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করবে। প্রথম স্টেজটা হলো- খিলাফা আলা মিনহাজিন নবুওয়্যাহ। এ সময়টা ছিল প্রথম পাঁচ খলিফার সময়কাল। (আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলীর খিলাফতকাল। এবং হাসান (রা) এর সংক্ষিপ্ত সময়কাল।) এটা ছিল শান্তির সময়, সমৃদ্ধির সময় ও সম্প্রসারণের সময়। এরপর আসবে রাজতন্ত্র। এটা হবে কিছুটা কঠোর শাসনকাল। এ সময়টা ছিল উমাইয়া, আব্বাসীয়, অটোমান ইত্যাদি শাসনকাল। এরপর কিছুকাল অন্যরা আমাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এ সময়টাও আমরা প্রায় পার করে এসেছি। যখন ইউরোপীয়রা আমাদেরকে ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ করে রেখেছিলো। বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশরা। কিন্তু এরপর আবার ইসলাম ফিরে আসবে। তো এগুলো হলো উম্মাহর স্টেজ। এখন, অবশ্যই সকল যুদ্ধ বিগ্রহ তো মুসলমানদের নির্যাতিত অবস্থা থেকে নেতৃত্বের আসনে উঠে আসার মধ্যেই ঘটবে। অর্থাৎ, শেষ দুই স্টেজে। তাই তো? তো মানাজির আহসান বলেন, তিনি এটা একশো বছর আগে বলেছিলেন, আমি আমাদের অবস্থানকে রাখবো এমন এক সময়ে যখন অন্যরা আমাদের উপর থেকে তাদের শাসন কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে। আর আমরা ধীরে ধীরে জেগে উঠছি। যদিও তারা তাদের দূষিত শিক্ষা ব্যবস্থা রেখে গেছে এবং আরো রেখে গেছে জাতীয়তাবাদের বিষফোঁড়। তাই, আমরা এখন এক উম্মাহ হিসেবে নিজেদের দেখি না। আমরা নিজেদের দেখি বাংলাদেশি, আফগানী, ইরাকি, আলজেরিয়ান হিসেবে। তো, উপনিবেশিকরা আমাদেরকে জাতীয়তাবাদ দিয়ে নিজেরা পালালো। এখন, আমরা বিভিন্ন ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে আছি এবং তাদের পুতুল সরকারগুলো আমাদের রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতায়। তবু, আমাদের এখন কিছুটা স্বাধীনতা আছে যা আগে ছিল না। তিনি যুক্তি দেখান, আল্লাহ আমাদেরকে এই সূরার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ভয়ংকর যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। ঠিক যেভাবে তিনি আগের সূরায় অর্থাৎ সূরা ইসরায় আমাদেরকে বনি ইসরাইলের ইতিহাস জানিয়েছেন। মানে-- বনি ইসরাইলের ইতিহাস হলো আগের মুসলিমদের ইতিহাস। আর এই সূরায় বর্ণনা করা হয়েছে বর্তমান মুসলিমদের ভবিষ্যত। এখন শুনুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন? তিনি বলেছেন- অবশ্যই আমার উম্মতের উপরেও তা আপতিত হবে যা আপতিত হয়েছিল বনী ইসরাইলের উপর, ঠিক একটা জুতা যেমন আরেকটার মত। তো তিনি বলছেন মুসলমানদের ইতিহাস অনেকটা বনি ইসরাইলের ইতিহাসের মতো হবে। সূরা কাহাফে কতগুলো ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে? চারটি। এখন, উনার বিস্ময়কর চিন্তাভাবনাটা শুনুন। সূরা কাহাফের প্রথম ঘটনা হলো যুবকগুলোর গর্তে লুকিয়ে পড়ার ঘটনা। মুসলমানরা উপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে গেলো। নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ তাদের ছিল না। তাই, উম্মাহর আলেমেরা ইসলাম রক্ষা করতে মসজিদ মাদ্রাসার মাঝে সীমিত হয়ে গেলেন। অনেকটা গর্তে ঢুকে পড়ার মত। তারা কয়েকশ বছর যাবৎ গর্তে পড়ে থাকলেন। অবশেষে মুসলমানরা উপনিবেশিকদের সাথে লড়াই করে মুক্ত হলো। আর স্কলাররা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলেন। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার পরে মানুষ কি উনাদেরকে একই সময়ের মানুষ মনে করছেন? নাকি মনে করছেন উনারা ভিন্ন শতাব্দীতে বাস করেন? মানুষ মনে করে উনারা ভিন্ন শতাব্দীতে বাস করেন। তো, উনি বলেন, উলামারা যখন ইসলামের ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে মসজিদ মাদ্রাসায় ঢুকে পড়েছিলেন, সে সময়ে উম্মাহর বাকি অংশ বস্তুবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অন্য কথায়, উম্মাহ হয়ে গেছে ম্যাটিরিয়ালিস্টক। দুনিয়াদার। মুসলিমরা হয়ে গেছে পুরাপুরি দুনিয়াদার। পরকালের কথা ভুলে গেলো। সূরার দ্বিতীয় ঘটনা হলো কোনো বাগানের এমন এক মালিককে নিয়ে যে পুরাপুরি দুনিয়াদার। ঠিক বর্তমান দুনিয়ার অবশিষ্ট মুসলমানদের মত। যারা দুনিয়ার ভোগ বিলাস ছাড়া আর কিছু বুঝে না। আল্লাহ ঐ মুসলিমটাকে কিভাবে শিক্ষা দিলেন? তিনি তার দুনিয়াবী সম্পদ ধ্বংস করে দিলেন। তারপর সে তাওবা করে ঠিক হয়ে গেলো। ঠিক একইভাবে সম্ভবত মুসলিমরাও ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক হবে না যতক্ষণ না তাদের ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। সূরা কাহাফের তৃতীয় ঘটনা কী নিয়ে? মুসা এবং খিজির (আ) এর ঘটনা নিয়ে। যেখানে খিজির (আ) অনেকগুলো অযৌক্তিক ঘটনা ঘটিয়ে চলছিলেন আর মুসা (আ) তার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আচ্ছা, তো মুসলিমরাও চারদিকে তাকিয়ে বলবে, আমাদের দেশগুলো এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কেন? মানুষের জীবন জীবীকার উপর এভাবে আঘাত আসছে কেন? মুসলিমদের কেন এভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে? নির্দোষ মানুষগুলো এভাবে মারা যাচ্ছে কেন? বাচ্চাগুলোকে এভাবে হত্যা করা হচ্ছে কেন? মুসা (আ) এর ঘটনায় কি বাচ্চা মারা গিয়েছিল? হ্যাঁ। এরকম অসুস্থ সমাজে ইসলামী স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কী অর্থ আছে? খিজির (আ) কি এমন এক সমাজে দেওয়াল তৈরি করেছিলেন যেটা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত? একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে দেয়াল তৈরি করা আর দাজ্জালের সময়ে গাছ রোপণ করা একই ব্যাপার। কারণ, আপনি কোনো পয়েন্ট খুঁজে পান না। তো, মুসলমানরা তাদের চারপাশের বাস্তবতা দেখে এভাবে প্রশ্ন করতে থাকবে। আমরা কি এখন সে সময়ে বাস করছি না? হ্যাঁ, বাস করছি। তো, তৃতীয় ঘটনার মূলকথা হলো, ব্যাপারগুলো আমরা বুঝতে পারি বা না পারি, এখানে বড় ধরণের পরিকল্পনা আছে। আমাদেরকে ধৈর্য প্রদর্শন করতে হবে। আমাদেরকে একজন ধৈর্যশীল ছাত্রের মত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। পরিশেষে সুরাতুল কাহাফের শেষ ঘটনা কী নিয়ে? যুলকারনাইনের ঘটনা। তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করছেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্য সর্বত্র। মুসলিম উম্মাহর ফাইনাল স্টেজটা কী হবে? ইসলাম প্রাচ্য পাশ্চাত্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। যেখানে যাবেন সেখানেই ইসলাম। কিন্তু সেটা ঘটার পূর্বে প্রচুর ফিতনা ঘটবে। তাই, মানাজির আহসান গিলানি বলছেন, সূরা কাহাফের চারটি ঘটনা সরাসরি দজ্জালের ঘটনার সাথে জড়িত। কারণ, এ ঘটনাগুলো বলছে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে আমরা এখন আছি। এই চারটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমাদের জানাচ্ছেন আমরা কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই, আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত। ইনি হলেন মানাজির আহসান গিলানি। আমি পড়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম! আংকেল আপনি যদি জীবিত থাকতেন আমি আপনার সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কারণ, কি বিস্ময়কর অন্তর্দৃষ্টি! কি বিস্ময়কর উপলব্ধি! তাই, আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। শুধু একটি কথা বলব, আমরা জানি আল্লাহর কাছে বড় পরিকল্পনা আছে। আমাদেরকে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। সবকিছুই আল্লাহর প্ল্যান অনুযায়ী এগোচ্ছে। আয়াতের পরবর্তী অংশটির কথা মনে রাখুন, وَ یُبَشِّرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ اَجۡرًا حَسَنًا - সেই মুমিনদের জন্য সুসংবাদ যারা নেক আমল করে। তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিফল। তো, আমাদের কাজ হলো আমলে সলেহ বা সৎকর্ম করে যাওয়া এবং অন্যদেরও সৎকাজ করতে উৎসাহ দেওয়া। -- নোমান আলী খানের আলোচনা অবলম্বনে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে