অস্থায়ী ধার্মিকতা ফলপ্রদ নয়
অস্থায়ী ধার্মিকতা ফলপ্রদ নয়—ইয়াসির কাদি কুরআন থেকে আজকের শিক্ষাটি হলো সূরা হূদের একটি আয়াত— فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ - ফাসতাক্বিম কামা উমিরতা। “দৃঢ়ভাবে লেগে থাকো এবং দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলো যেভাবে তোমাকে আদেশ করা হয়েছে”। ফাসতাক্বিম। (اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাতের ইসলামী ধারণাটি সংরক্ষিত আছে সূরা ফাতিহায় যা আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে ১৭ বার পাঠ করি, যেখানে আমরা বলি— اهْدِنَا الصِّرٰطَ الْمُسْتَقِيمَ - ইহদিনাস সিরাতাল-মুসতাক্বিম। ফাসতাক্বিম শব্দটিও একই ধারণা প্রকাশ করে—(اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাহ। দৃঢ় থাকা, অটল থাকা, দৃঢ়পদে এগিয়ে চলা, আশা ছেড়ে না দেয়া। আর অবিচল থাকার এই ধারণাটি, ইসতিক্বমাতের এই ধারণাটি, এটি কুরআনের নিরবচ্ছিন্ন একটি থীম। বারবার আলোচিত মৌলিক ধারণাগুলোর একটি। এখানে আমি আপনাদেরকে সূরা হূদ থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে আমি আরো অর্ধডজন আয়াতের উদ্ধৃতি দিতে পারবো। উদাহরণস্বরূপ, মহান আল্লাহ বলেছেন, شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ— হে রসূলাল্লাহ, আমি নির্দেশ দিচ্ছি; আপনি, নূহ, ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা, সকলের জন্য একই নির্দেশ; সেটা কি ? أَقِيمُوا الدِّينَ - আক্বীমুদ-দীন, (اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাহ, দ্বীন পালনে দৃঢ়তা। আর আল্লাহ রসূল (স)-কে নির্দেশ দিয়েছেন যে, فَادْعُ - ফাদ’উ — মহান আল্লাহর দিকে আহ্বান করুন। وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ - ওয়াসতাক্বীম কামা উমিরতা। এখানেও একই বাক্যাংশ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহর দিকে আহ্বান করুন এবং আপনার প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাতে অবিচল থাকুন। ডানে-বামে দোদুল্যমান হবেন না। আর যখন আল্লাহ মুসা (আ)কে ফেরাউনের সামনে যাবার নির্দেশ দিলেন, মুসা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ও আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমার ভাই হারুনকে আমার সহযোগী করুন, যাতে আমরা একত্রে সেখানে যেতে পারি। আল্লাহ বললেন, قَالَ قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا— আমি তোমাদের দোয়া কবুল করেছি। তারপরে কি ? فَاسْتَقِيمَا - ফাসতাক্বীমা — তোমরা উভয়ে হাল ছেড়ে দিয়ো না, অটল থাকো, অবিচল থাকো, লেগে থাকো। আল্লাহ নবীদেরকে বলেছেন, اِسْتَقِمْ - ইসতাক্বীম, اِسْتَقِيْما - ইসতাক্বীমা। আল্লাহ ইবরাহীম, মূসা, ঈসা, নূহ এবং আমাদের রসূল (স)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, فَاسْتَقِمْ - ফাসতাক্বীম, দোদু্ল্যমান অবস্থায় থাকবেন না। আর সেজন্যই যখন ইবলিসকে জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত করা হলো, সে আল্লাহকে কী হুমকি দিয়েছিলো ? সে আল্লাহকে হুমকি দিয়েছিলো যে, ও আল্লাহ, যেহেতু আপনি আমার সাথে এরকম করেছেন, সে কিন্তু আল্লাহকে দোষ দিয়েছিলো, ও আল্লাহ, যেহেতু আপনি আমার সাথে এরকম করেছেন, لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيْمَ - লা-আক্ব’উদান্না লাহুম সিরাতকাল-মুসতাক্বীম, অর্থাৎ আমি তাদেরকে (اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাহ থেকে বিচ্যুত করে দিবো। ইবলিসের কাজই হলো অবিচলতা থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করে দেয়া। ইবলিসের কাজই হলো আমাদের (اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাতকে ধ্বংস করে দেয়া। আমাদেরকে বলা হয়েছে অবিচল থাকার জন্য। আমাদেরকে বলা হয়েছে সরল পথে এগিয়ে চলার জন্য। লেগে থাকার জন্য। আমাদেরকে বলা হয়েছে সিরাতুল মুসতাক্বিমে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আর ইবলিস জানে যে, আমরা যদি সেই সিরাতে অটল থাকি, তাহলে সে ব্যর্থ হবে। তো আল্লাহর প্রতি তার একমাত্র হুমকিটি কী ছিলো ? একমাত্র হুমকিটি ছিলো, لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيْمَ - লা-আক্ব’উদান্না লাহুম সিরাতকাল-মুসতাক্বীম। ثُمَّ لآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَآئِلِهِمْ وَلاَ تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ - ইবলিস বলেছিলো, “আমি তাদেরকে সকল দিক থেকে আক্রমণ করবো। তাদেরকে নেয়ার চেষ্টা করবো, কোথায় ? সিরাত থেকে বিচ্যুত করে দূরে নেয়ার চেষ্টা করবো। এটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাই, তাদের মধ্যে যেনো (اِسْتِقَامَةْ) ইসতিক্বমাহ না থাকে। তো ইসতিক্বমাহ মূলত কী ? এই ধারণাটি আসলে কি, যার জন্য আল্লাহ সকল নবীকে আদেশ করেছেন, যার কথা আল্লাহ বলেছেন ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, যার কথা আল্লাহ বলেছেন হারুন এবং মূসাকে — اِسْتَقِيْمَا - ইসতাক্বীমা; এই ইসতিক্বমাহ আসলে কি ? ইবনুল ক্বাইয়্যিম বলেছেন, ইসতিক্বমাহ হলো, আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে হৃদয়ের অবিচলতা। কারণ হৃদয় যখন অবিচল থাকবে, দেহও তার অনুসরণ করবে। এটাই ইসতিক্বমাহ। অস্থায়ী ধার্মিকতাকে ইসতিক্বমাহ বলে না। রমজান মাসে আমরা কেউ কেউ অস্থায়ী ধার্মিকতা অর্জন করি। অস্থায়ী ধার্মিকতা ইসতিক্বমাহ নয়। আক্ষরিকভাবেই ইসতিক্বমার অর্থ হলো অবিচলতা, ধারাবাহিকতা। এটাই হলো ইসতিক্বমাহ। মৃত্যু পর্যন্ত দীন পালন করে যাওয়া। আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন অবিচলতার, তিনি আদেশ দিয়েছেন, فَاسْتَقِمْ - ফাসতাক্বীম, وَاسْتَقِمْ - ওয়াসতাক্বীম, اِسْتَقِيْمَا - ইসতাক্বীমা, اِسْتَقِيْمُوْا - ইসতাক্বিমু। কুরআনের নিরবচ্ছিন্ন ধারণাই হলো, اهْدِنَا الصِّرٰطَ الْمُسْتَقِيمَ - ইহদিনাস সিরাতাল-মুসতাক্বিম। আমাদেরকে ঈমান সংরক্ষণ করতে হবে, রক্ষা করতে হবে, এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যাতে সর্বোচ্চ পরিমাণে এই ঈমানকে ধরে রাখতে পারি। প্রিয় ভাই, اِسْتَقِمْ - ইসতাক্বিম, অটল থাকুন, অবিচল থাকুন। স্মরণে রাখুন, আমাদের রসূল (স) যা বলেছেন, "আল্লাহর বিবেচনায় সবচেয়ে বরকতময় কাজ এবং আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো সেই কাজ যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।" ধারাবাহিকতা রক্ষা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। ধারাবাহিকতাকে আল্লাহ ভালোবাসেন। ধারাবাহিকতার দ্বারাই ধার্মিকতা নির্ধারিত হয়। ইসতিক্বমার ফলাফল কি হবে ? ইসতিক্বমার উপর অবিচল থাকার পুরষ্কার কি হবে ? আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনে বলেছেন, اِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰٓئِكَةُ اَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَاَبْشِرُوْا بِالْجَـنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ نَحْنُ اَوْلِيٰٓـؤُکُمْ فِى الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَفِى الْاٰخِرَةِ - যারা ইসতিক্বমার সাথে জীবন যাপন করেন, অন্তিম সময়ে তাঁরা ভি.আই.পি. মর্যাদা লাভ করবেন। ফেরেশতাগণ দলে দলে নেমে আসবেন। ফেরেশতাগণ নেমে আসবেন। আমাদের রসূল (স) বলেছেন, তাঁরা হলেন মৃত্যুর ফেরেশতা। তাঁরা নেমে আসবেন পূণ্যবান ব্যক্তির আত্মাকে স্বাগত জানানোর জন্য। তো, اِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا - ইন্না-ল্লাযিনা ক্বলু রব্বুনা-ল্লাহু সুম্মা-সতাক্বমু। লক্ষ করুন, জীবনের শেষেও তাঁরা বলেছেন, আল্লাহ আমাদের রব, আর এর উপর তারা অবিচল ছিলেন। যখন মৃত্যুর ফেরেশতা আসবে, তার সাথে ফেরেশতাদের একটি বহর আসবে, যারা তাঁকে ভি.আই.পি. মর্যাদা প্রদান করবেন। আর তাঁরা বলবেন, “প্রশান্তিতে থাকো, রিলাক্স। আমরা এখানে রয়েছি। আমরা তোমার দেখাশোনা করবো। আমরা এই পৃথিবীতে তোমার দেখাশোনা করেছি। আখিরাতেও আমরাই তোমার দেখাশোনা করবো। نَحْنُ اَوْلِيٰٓـؤُکُمْ فِى الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَفِى الْاٰخِرَةِ - নাহনু আউলিয়াউকুম ফিল-হায়াতিদ-দুনইয়া ওয়া-ফিল-আখিরাহ। প্রিয় ভাইয়েরা, কুরআন প্রদত্ত ইস্তিক্বমার এই মূলনীতিটি স্মরণে রাখবেন। অস্থায়ী ধার্মিকতা ফলপ্রদ নয়। এটা আল্লাহ প্রত্যাশা করেন না। বরং উপকারী হলো—অটল থাকা, অবিচল থাকা, ধারাবাহিকতা। আল্লাহর ইবাদাতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন এবং অটল ও অবিচল থাকুন। এর ফলে, ইনশা আল্লাহ, যখন মৃত্যু আমাদের দরজায় কড়া নাড়বে, তখন সেই একই ফেরেশতাগণ আমাদেরকেও অভিবাদন জানাবেন, যাদের কথা আল্লাহ বলেছেন। যেহেতু আমরাও ইসতিক্বমার অধিকারী ছিলাম, আমরাও এই বাক্যটি শ্রবণ করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি যে, لَا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا -"ভয় পেয়ো না এবং দুঃখ করো না।" আল্লাহ আমাদেরকে ইসতিক্বমার অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং সিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথনির্দেশ দান করুন। আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া-রহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন