সেদিন কেউ কারো কোনো খবর রাখবে না
আপনারা বিচার দিবসের বর্ণনা আগেও শুনেছেন। সেদিন কেউ কারো কোনো খবর রাখবে না। یَوۡمَ تَرَوۡنَهَا تَذۡهَلُ كُلُّ مُرۡضِعَۃٍ عَمَّاۤ اَرۡضَعَتۡ --(সূরা হজ্ব-২২, আয়াত ২) এমনকি মা যিনি তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন, জাস্ট তাকে কোল থেকে ফেলে দিবেন। এতোটা ভয়ংকর বিচার দিনের বর্ণনা। یَفِرُّ الۡمَرۡءُ مِنۡ اَخِیۡهِ - وَ اُمِّهٖ وَ اَبِیۡهِ - وَ صَاحِبَتِهٖ وَ بَنِیۡهِ - (সূরা আবাসা, আয়াত, ৩৪-৩৬) وَ فَصِیۡلَتِهِ الَّتِیۡ تُــٔۡوِیۡهِ -- (সূরা মাআরিজ, আয়াত, ১৩) আপনি আপনার মা থেকে পালাবেন, বাবা থেকে, ভাই থেকে, স্বামী/স্ত্রী থেকে। আপনি আপনার সমগ্র গ্রামবাসি থেকে পালাবেন। পরিচিত সকল মানুষ থেকে। তাদের দেখলেই উল্টো দিকে পালিয়ে যাবেন। কারো ব্যাপারে কোনো পরোয়া করবেন না। বস্তুতঃ لَوۡ یَفۡتَدِیۡ مِنۡ عَذَابِ یَوۡمِئِذٍۭ بِبَنِیۡهِ-- এ আয়াতের কয়েকটি আয়াত পরে আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا ۙ ثُمَّ یُنۡجِیۡهِ - মানুষ সেদিন বলবে, ইয়া আল্লাহ! দরকার হলে অন্য সমস্ত মানুষ! আদম (আ) থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ আছে সবাইকে জাহান্নামে ফেলেন, কিন্তু আমাকে বাঁচান। এটাই সেদিন তারা বলবে। "ওমান ফিল আরদি জামিয়ান, ছুম্মা ইউনজিইহি।" প্রচণ্ড ভয়ের সেই দিনে কিছু মানুষ ডান হাতে তাদের আমলনামা পাবে। এতে তারা যে কতটা খুশি হবে! তারাই একমাত্র গ্রুপ যারা শুধু নিজেদের জন্য খুশি হবে না, তারা ঘুরে ঘুরে নিজের আমলনামা বন্ধুদের দেখাবে, পরিবার-পরিজনকে দেখাবে। আসুন, দেখুন! দেখুন! আমার ভালো ভালো আমলগুলো দেখুন! দেখুন, আল্লাহ আমার সব নেক আমলগুলো লিখে রেখেছেন। প্রশ্ন হলো…জানি, বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছি, শুধু আর অল্প কয়েক মিনিট নিবো--প্রশ্ন হলো, আমার আমলনামা... দোয়া করছি, আমরা যেন আমাদের আমলনামা ডান হাতে পাই, এমনকি যদিও আমরা আমলনামা ডান হাতে পাই, এতে তো শুধু ভালো কাজগুলো লিপিবদ্ধ থাকবে না। আমি তো আর ফেরেশতা না। আমার জীবনে ভুল ত্রুটি আছে। এমনসব কাজ করেছি যা নিয়ে আমি লজ্জিত। ঐ কাজগুলোও তো লিখা আছে। যখন এরকম ভালো এবং খারাপ উভয় ধরণের কাজগুলো লিপিবদ্ধ থাকবে, সমগ্র জীবনের, আমি তো তাহলে নিশ্চিত না, কাউকে কি আমি দেখাতে চাইবো? সে তখন পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বলে উঠবে, আরে! এটা কী! তুমি এ জঘন্য কাজটাও করেছ? তাহলে লোকটা নিজের আমলনামা অন্যদের কেন খুশিমনে দেখাতে চাইবে? যদিও খাতাটাতে নেক আমলগুলো লিখা আছে, কিন্তু আরও আছে? খারাপ কাজগুলোও। ব্যাপারটা আসলে কুরআনে বর্ণিত মাগফিরাতের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। যদিও খারাপ কাজগুলো মুছে দেওয়া হয়নি, খারাপ কাজগুলো আসলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছাদিত করা হয়েছে। আপনি বুঝতে পারবেন, এখানে একটি মন্দ কাজ আছে, কিন্তু এটা ইস্তেগফার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ঐখানে আরেকটা পাপ লিখা আছে, কিন্তু সেটা একটা নেক আমল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা নিকৃষ্ট আমল আছে… আগের দিনে বাচ্চারা কলম দিয়ে কিছু লিখত, লিখাটা ভুল হলে তারা সাদা রং দিয়ে ঢেকে দিতো। এরপর এর উপরে আবার লিখত। লেখাটা দেখে বুঝা যেত এখানে কিছু একটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক এরকম। আপনি বুঝতে পারবেন। আমার কিছু কিছু কর্ম ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আপনি তখন খুশিতে নেচে উঠবেন! আমি যে কত ভুল করেছি! আর আল্লাহ আমার অগণিত ভুলগুলো সাদা রং দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। আর ভালো ভালো আমল দিয়ে তা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। দেখুন! আল্লাহ আমাকে কতটা মায়া করেন! দেখুন! আল্লাহ আমাকে কত শত বার ক্ষমা করে দিয়েছেন! দেখুন! আল্লাহ কতটা দয়াবান! আবার এমন কিছু আমল থাকবে, কাজটা আপনার কাছে খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল। খুবই সামান্য সদাকা। নগণ্য কাজ, একজনকে সামান্য সাহায্য করেছিলেন। কারো দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। রাস্তায় কারো প্রতি দয়া দেখিয়েছিলেন। কারো সাথে শুধু সুন্দর করে কথা বলেছিলেন। সামান্য কিছু। আপনি এ নিয়ে আর চিন্তাও করেননি। নিজের আমলনামা খুলে দেখেন ছোট্ট কাজটা বিশাল এক অধ্যায়ে পরিণত হয়ে গেছে। অসামান্য মূল্য! পর্বত সমান মূল্য! এটার পর্বতসম মূল্য! ইয়া আল্লাহ! কীভাবে এটাকে এতো গুণে বৃদ্ধি করে দিলেন! কীভাবে ছোট্ট আমলটাকে প্রকাণ্ড আমলে পরিণত করে দিলেন! নিজের খাতাটা দেখে আপনার তখন খুশির শেষ নেই। আপনি তখন চারদিকে ঘুরে ঘুরে...কুরআনের অন্যত্র যেমন এসেছে, وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا - "সে তার স্বজনদের কাছে সানন্দে ফিরে যাবে।" (৮৪:৯) এটাই বিচার দিনের একটি চিত্র! এটাই هَآؤُمُ اقۡرَءُوۡا كِتٰبِیَهۡ - اِنِّیۡ ظَنَنۡتُ اَنِّیۡ مُلٰقٍ حِسَابِیَهۡ فَهُوَ فِیۡ عِیۡشَۃٍ رَّاضِیَۃٍ – আল হাক্কাহ, আয়াত- ১৯-২১। আমি জানি সময় শেষ হয়ে গেছে। অন্তত এই অংশটা, ডান পাশের মানুষেরা, উনাদের নিয়ে আমি দ্রুত কয়েকটি কথা শেয়ার করতে চাই। সে বলবে, আমি নিশ্চিত জানতাম যে, আমাকে আমার হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে।’ হিসাব শব্দটি... হিসাবিয়ার অনুবাদ হলো অডিট। অডিট মানে, প্রতিটি আইটেম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা কি? এখানে কী করেছ তুমি? এখানে রাত ২ টায় কী করছিলে? অমুক দিনে কী করেছ? শুক্রবার রাতে কী করেছ? এখানে কী হচ্ছে? প্রতিটি আইটেম! আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম! আল্লাহ আমাকে প্রতিটি বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবেন। এখন যেহেতু আমি আমার খাতাটা দেখতে পাচ্ছি, আমি দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ আমার প্রতি সদয় আচরণ করেছেন। আল্লাহ আমার হিসাব সহজ করেছেন। তো, এখন সে বলছে, খাতাটা হাতে পাওয়ার পর, সে দেখতে পাচ্ছে আল্লাহ কতটা সহজ করেছেন! আল্লাহ যার বর্ণনা দিয়েছেন— فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا – আল্লাহ অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করবেন। এখন, সে আল্লাহর দিকে ফিরে বলছে, আমি যে কতটা আতঙ্কিত ছিলাম! এই ভয়ে যে, আমি অতিশয় কঠিন এক হিসেবের সম্মুখীন হবো। فَهُوَ فِیۡ عِیۡشَۃٍ رَّاضِیَۃٍ – এরপর আল্লাহ বলেন, সে এমন এক জীবন অতিবাহিত করবে যেখানে প্রত্যেকটি জিনিস, একদম সবকিছু তাকে আনন্দিত করবে। সবকিছু এমন হবে। জানেন তো? অনেক সময় ছুটি কাটাতে সবচেয়ে সেরা কোথাও গেলেন। সেখানেও কিছু একটাতে সমস্যা থাকবে। সবেচেয় সেরা জামাটা পরলেন, সর্বোত্তম খাবার আহার করলেন, সুন্দরতম হোটেল, সুন্দর দৃশ্য, হোটেলের সেরা রুমটা পেলেন সবকিছু পারফেক্ট। তবু ভেতরে কিছুটা হতাশা অনুভব করছেন। কোনো চিন্তা, কোনো সমস্যা, কোনো একটা বাজে স্মৃতি, কিছু একটা আপনার মাথায়...খাবারটা আসলে অতোটা সুস্বাদু লাগছে না। কারণ কিছু একটা এখনো অনুপস্থিত। কারণ সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হওয়া, পুরোপুরি সুখী হওয়া...এটাকে প্রায় অসম্ভব মনে হয়। মানুষের জন্য। সম্পূর্ণরূপে, পুরোপুরি, সকল দিক থেকে সুখী হওয়া অসম্ভব। সবসময় কিছু না কিছু থাকবেই যা এই সুখটাকে হ্রাস করে দিবে অল্প পরিমাণে, কিছুটা ক্ষুদ্রাকারে। "লাকাদ খালাকনাল ইনছানা ফিই কাবাদ"। আল্লাহ জান্নাতের জীবনটাকে যে কতটা মুবালাগা সহকারে বর্ণনা করেছেন, কতটা অতিরঞ্জন সহকারে বর্ণনা করেছেন…তিনি বলেনেনি মানুষটা সুখী হবে। তিনি বলেছেন--জীবনটা নিজেই তৃপ্তিকর হবে। তিনি বলেননি, ফাহুয়া রা-দিন ফিই 'ইইশাতিল জান্নাহ, সে জান্নাতের জীবনে পরিতৃপ্ত হবে। তিনি বলেছেন, ফাহুয়া ফিই ইইশাতিন রাদিয়া। যা খুবই অদ্ভুত ধরণের ইস্তেয়ারা। যা ইঙ্গিত করছে জান্নাতের প্রতিটি অংশ, জান্নাতের প্রতিটি অভিজ্ঞতা আপনাকে একেবারে সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করে দিবে। সম্পূর্ণরূপে সুখী করে দিবে। প্রতিবার শতভাগ তৃপ্তি এনে দিবে। —নোমান আলী খান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন