পরিবেশের দোহাই || নোমান আলী খান

 


পরিবেশের দোহাই || নোমান আলী খান

আল্লাহ আমাদেরকে এই ধর্ম এজন্য দেননি যে আমরা পরিবেশ থেকে লুকিয়ে থাকবো। আল্লাহ আমাদেরকে এই ধর্ম দিয়েছেন পরিবেশকে পরিবর্তন করার জন্য। এজন্যই আসলে তিনি এই ধর্ম প্রদান করেছেন। এই ধর্ম ফিতনা থেকে পালিয়ে যায় না, বরং ফিতনাকে নির্মূল করে দেয়। এই ধর্মটির ভূমিকা এটাই। এজন্যই আল্লাহ এটাকে বলেছেন, আমাদের পিতা ইবরাহিম (আ)-এর মিল্লাহ, দ্বিন বা ধর্ম। ইবরাহিম (আ)-এর চারপাশ শিরকে পরিপূর্ণ ছিলো। আর তিনি প্রতিনিয়ত এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করেছিলেন, আর এটাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আমরা ইবরাহিম (আ)-এর ধর্মকে ধারণ করতে পারবো না, যদি আমাদর অভ্যন্তরে এমন কিছু না থাকে যা আমাদের ইমানকে পরিচালিত করে। আমার সাথে সাথে শুধু এই বিষয়টি চিন্তা করুন। সেই মানুষেরা যারা সর্বপ্রথম কুরআন শুনেছিলেন, আমরা এই বিষয়ে সাধারণত চিন্তা করি না যে, যখন কুরআন নাযিল হোচ্ছিলো, অধিকাংশ মানুষ যারা কুরআন শ্রবণ করেছে, তারা মুসলিম ছিলো না। যখন কুরআন প্রথমে নাযিল হচ্ছিলো, আর রাসূল (স) কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন, বেশীরভাগ কান, যেগুলোতে কুরআন প্রবেশ করছিলো, সেগুলো মুসলিমদের কান ছিলো না। এর আগে তারা কয়েকশো বছর ধরে অমুসলিম থেকেছে। কুরআনের প্রতিটি আয়াত তাদের সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটা তাদের পরিবারপ্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এটা তাদের পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এটা তাদের জীবনপদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এটা তাদের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এটা সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেনো তারা পরিবার ত্যাগ করবে, সংস্কৃতি ত্যাগ করবে, স্বাধীনতা ত্যাগ করবে, সবকিছু ত্যাগ করে এই বাণী কেন গ্রহণ করবে। এটা আসলে কি ? আল্লাহর বাণীটিতে শক্তিশালী কিছু ব্যাপার রয়েছে। আল্লাহর বাণীতে অতিপ্রাকৃতিক, অলৌকিক কিছু ব্যাপার রয়েছে। কল্পনা করুন, ইসলামের আগমণের পূর্বে তারা যা ইচ্ছা খেতে পারতো। তারা যা খুশি তা করতে পারতো। তারা যাকে ইচ্ছা হত্যা করতে পারতো। তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করতো। তারা যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারতো। এরপর ইসলাম আসলো, এবং সীমাবদ্ধতা আরোপ করলো - তারা কী খেতে পারবে, কাকে তারা বিবাহ করতে পারবে, তাদের আচরণ কেমন হবে, কিভাবে তারা ব্যবসা করবে। “কেনো আমি এই সকল সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিচ্ছি ? আমি তো এর আগে স্বাধীন ছিলাম। কেনো আমি এর অনুসরণ করছি ? এটা অতিরিক্ত কঠোর।” প্রসঙ্গক্রমে, আপনি এখন মুসলিম তরুণদের কাছ থেকে এই প্রশ্ন শুনবেন। মুসলিমরা বলে ইসলাম অনেক বেশী কঠোর। এটা অনেক বেশী সীমাবদ্ধকারী। আর আমি বলি, আপনার এই প্রশ্ন নতুন না। প্রকৃতপক্ষে মুশরিকরা এই প্রশ্নটি কয়েক হাজার বছর আগে তুলেছিলো। ১৫০০ বছর আগে যখন কুরআন প্রথম নাযিল হয়। “কেনো আমি এই ধর্মটি গ্রহণ করবো যা আমার উপর সীমাবদ্ধতা চাপিয়ে দেয়, যেখানে এটা ছাড়া আমি মুক্ত থাকতে পারি। শিরক অনেক বেশী সহজ। মুশরিক হওয়াটা অনেক বেশী উদারপন্থি, যেখানে ইসলাম অনেক বেশী রক্ষণশীল।” তাই না ? প্রশ্ন হোলো, কেনো তাঁরা এটা গ্রহণ করলেন ? তাঁরা শুধু এটা গ্রহণই করলো না, বরং এর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলো। তাঁদেরকে নির্যাতন করা হয়েছিলো, প্রহার করা হয়েছিলো, কিন্তু তাঁদেরকে ইসলাম-মুক্ত করা যায়নি। তাঁদেরকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হয়েছিলো, কিন্তু তাঁরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ত্যাগ করেননি। কি ঘটে যাচ্ছে এখানে ! এমনকি তাদের পরিবার তাদের কাছে এসে বলেছে, “আমরা তোমাকে ভালোবাসতাম, كُنْتَ فِينَا مَرْجُوًّا - কুনতা ফিনা মারজুওয়া - আমরা তোমাকে ভালোবাসতাম, তোমার প্রতি আমাদের আশা-ভরসা ছিলো। কেনো তুমি এরকম হয়ে গিয়েছো ? তোমার ভেতরে কোন জিনিসটা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে ?” কোনো একটা জ্ঞান তাঁদের কাছে এসেছিলো যার দ্বারা তাঁরা বাইরের মিথ্যাগুলো দেখতে পেরেছিলেন। এরপর এখন তারা সত্যের প্রতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটা শুধু তখনই ঘটবে, যখন কারো ভিতরে بَصِيْرَةْ - বাছিরাহ থাকে। তারা নিজেরাই দেখতে পারে যে, এটা আল্লাহর বাণী। তারা নিজেরাই অনুভব করতে পারে যে, এটা আল্লাহর বাণী। পৃথিবীতে অনেক মুসলিম রয়েছে, কোটি কোটি মুসলিম রয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। যদি আমাদের বেশিরভাগ মানুষই শুধুমাত্র এজন্যই মুসলিম হই, কারণ আমাদের পিতা-মাতা মুসলিম, কারণ আমাদের আশে-পাশের পরিবেশ মুসলিম, তাহলে আমাদের ইসলাম সংকটের মধ্যে রয়েছে। আমাদের ইসলাম সংকটের মধ্যে রয়েছে, কারণ আশে-পাশের পরিবেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। আর যখন আশে-পাশের পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তখন ইসলামও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। যেই জিনিসটি আমাদের ইসলামকে অব্যাহত রাখবে, আশে-পাশের পরিবেশ পরিবর্তিত হোক বা না হোক, কোনো কিছু এটাকে প্রভাবিত করবে না, যদি ইসলাম ভেতর থেকে আসে, বাইরে থেকে না। এটা ভেতর থেকে আসতে হবে। কখনো কখনো তরুণ ছেলেরা এসে আমাকে বলে, “ওস্তাদ, আমেরিকায় মুসলিম হিসেবে বসবাস করা আসলেই কঠিন।” আর আমি বলি, আমার জীবনে এরচেয়ে অদ্ভুত কথা আর শুনিনি। আমেরিকায় মুসলিম হিসেবে বসবাস করা খুবই কঠিন। যখন দুই যোগ দুই, সমান চার হয়, এটা ত্রিনিদাদে মেনে নেয়া কঠিন না যে দুই যোগ দুই, সমান চার। আর কানাডায় এটা মেনে নেয়া অধিকতর কঠিন না। অন্য কোনো স্থানেও এটা অধিকতর কঠিন না। আগুন উত্তপ্ত। “আমেরিকাতে আগুনে হাত দেয়া আসলেই অনেক কঠিন।” না, না, না, আগুন উত্তপ্ত, তা যেখানেই থাকুক না কেনো। সত্য তো সত্যই। ‘আশে-পাশের পরিবেশ আমার ইমানকে দুর্বল করে দিবে’ - জানেন এই ধারণাটির মানে কি ? আপনার ইমান শুধুই আশে-পাশের পরিবেশ থেকে আসছে। সেজন্যই এটা দুর্বল। আপনার ইমান ভেতর থেকে আসেনি। ইমানকে আমাদের ভেতরে লালন করতে হবে। আমাদের ভিতরে তা তৈরী করতে হবে। একমাত্র সেভাবে তা আসবে, যেভাবে এটা প্রথমবার এসেছিলো। প্রথমবার এটা এসেছিলো - যখন মানুষ আল্লাহর বাণী নিয়ে চিন্তা করেছিলো। রাসূল (স) কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন। মানুষ চিন্তা করছিলো যে, এই কথাগুলো আসলে কি, তিনি কী বলছেন। আর যতো বেশী তাঁরা এটা নিয়ে চিন্তা করছিলেন, পৃথিবীকে ততো নতুনভাবে আবিষ্কার করছিলেন। এরপর আপনি আশে-পাশের পরিবেশকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলতে পারেন, তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করবেন না। আপনি পরিবেশকে নির্যাতনময় করে তুলতে পারেন, তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করবেন না। আপনি তাদেরকে গৃহহীন করে দিতে পারেন, তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করবেন না। আপনি তাঁদের প্রিয়জনকে ঘৃণিতজনে পরিণতে করে দিতে পারেন, তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করবেন না। কোনো কিছুই তাঁদেরকে ইসলাম ত্যাগ করাতে পারবে না। -- নোমান আলী খান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে