এক মহান নারীর কাছ থেকে পাওয়া ছয়টি অমূল্য শিক্ষা
গাজায় ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া এক মহান নারীর কাছ থেকে পাওয়া ছয়টি অমূল্য শিক্ষা ---------------------------------------------- ----------------- ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর, গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছিল— আকিদাহ বা বিশ্বাস; সাবাত বা দৃঢ়তা, অটলতা, সহনশীলতা, নিপীড়নের মুখে প্রতিরোধ এবং আল্লাহর উপর ভরসার এক জীবন-পরিবর্তনকারী পাঠ। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই পাঠটি বড় কোনো শায়েখ দেননি, কোনো মঞ্চ থেকেও আসেনি, কোনো ইসলামী চিন্তাবিদের রচিত বইয়ের গভীর থেকেও নয়। শিক্ষাটি প্রদান করেছেন একজন সাধারণ মধ্যবয়সী নারী, যার নাম মেই। গাজায় বোমাবর্ষণে ঘরবাড়ি-ধ্বংসপ্রাপ্ত অসংখ্য নারীর মধ্যে তিনি একজন। মাত্র ৬০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও–ব্যস, এটুকুই। এটি ভাইরাল হয়ে যায়। সেই মুহূর্তটি, যখন তাঁকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এবং তরুণ উদ্ধারকারীদের সাথে তাঁর কথোপকথন, যারা তাকে বাঁচিয়েছিল। সেই ৬০ সেকেন্ডে যখন মেই কথা বলেছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন ফেরেশতারা তাঁকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, যথোপযুক্ত এবং সৌর্দর্যমন্ডিত কথার দ্বারা। ১। প্রথম বার্তা— --------------------- মেই আমাদের শিখিয়েছেন হায়া—মুসলিম নর-নারীর জীবনে সুস্থ লজ্জাশীলতার মূল্য। আপনি লক্ষ্য করবেন, যখন তাঁকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হচ্ছিল, মেই তাঁর পূর্ণ ইসলামিক হিজাব পরিহিত ছিলেন, যেন তিনি নামাজে দাঁড়িয়েছেন। আমি ভাবছিলাম, একজন নারী তার নিজ বাসায় হিজাব পরে থাকার পেছনে শুধুমাত্র দুটি কারণ থাকতে পারে, যেখানে সাধারণত তার হিজাবের প্রয়োজন নেই। হয় তিনি নামাজে ছিলেন–নামাজরত অবস্থায় বোমাগুলো তার চারপাশে পড়ছিল, তিনি নামাজে ছিলেন; অথবা গাজার অন্যান্য নারীদের মতোই তিনি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন যে তাঁর ঘরটি ধ্বসে পড়তে পারে। তাই যখন অচেনা পুরুষেরা উদ্ধার করতে আসবে, তিনি চেয়েছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির পন্থায় তাদের দৃষ্টিগোচর হতে। এমন এক সময়ে যখন আমাদের অনেক বোন, মা, কন্যা, সৎকর্মশী নারীরা হয়তো হিজাব নিয়ে পুনরায় চিন্তা করছেন, হিজাব নিয়ে পুনর্বিবেচনা করছেন — সামাজিক মাধ্যমের চাপ, বন্ধুদের প্রভাব, কর্মক্ষেত্রের প্রত্যাশা কিংবা সমাজের অবক্ষয়িত মূল্যবোধের কারণে হয়তো হিজাব ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন–তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না সমাজ তাদের কাছ থেকে কী চায়। মেইও চরম চাপের মধ্যে ছিলেন–কংক্রিটের স্ল্যাবের চাপ। যখন তাঁর ঘর ধ্বংস হয়েছিল, মেই নিজের মেঝে এবং ছাদের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন; কতক্ষণ ? টানা পাঁচ দিন। না খাবার, না পানি, নড়াচড়ার জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও নেই—পাঁচ দিন। অলৌকিকভাবে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তবুও সেখানে, ৪০ সেন্টিমিটার কংক্রিটের স্ল্যাবের নিচে তাঁর নাজুক, ভঙ্গুর নারীদেহ–আর তিনি তাঁর পূর্ণ হিজাব পরিহিত। এই চাপের কথা বিবেচনা করুন। এই জন্যই আমাদের প্রিয় নবী (সা.) একটি হাদিসে বলেছেন, আমাদের মাঝে মাঝে এটি স্মরণ করা উচিত, কারণ এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। তিনি বলেন, দুটি শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামে যাবে, যদিও আমি তাদের কখনো বাস্তবে দেখিনি। প্রথমটি হলো এমন লোক যারা গরুর লেজের মতো চাবুক নিয়ে মানুষকে অত্যাচার করবে—আমরা কি এটি দেখিনি ? দ্বিতীয় শ্রেণী হলো, সেই নারীরা যারা পোশাক পরিহিত হয়েও উলঙ্গ। তারা চলাফেরায় বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং অন্যদের হৃদয়ও বিপথে নিয়ে যায়। তাদের মাথা যেন উটের কুঁজের মতো দুলতে থাকবে। তারা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি এর সুগন্ধিও পাবে না, যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ বহুদূর থেকে অনুভূত হয়। সেই মেই আমাদের লজ্জাশীলতার পাঠ দিলেন। চরম দুঃসহ পরিস্থিতিতেও তিনি তাঁর হিজাবের সাথে আপস করেননি, তার ভঙ্গুর দেহে কংক্রিটের ভয়াবহ চাপ সত্ত্বেও। যদি এটি আপনাকে বিস্মিত করে, তবে বিস্ময়কর আরো অনেক কিছু বাকী আছে। যখন তাঁরা তাঁকে তাঁর বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করছিলেন, আপনি দেখবেন মেই তাঁর সহজ-সরল ফিলিস্তিনি আরবিতে তাঁদেরকে বলছেন, "أَقْلِبْ حَالِيْ أَحْسَنْ"। সে বলল, "দয়া করে আমাকে কি উল্টো করে বের করতে পারবেন ? আমি মুখ নিচু অবস্থায় বের হতে চাই না। এটা যথাযথ নয়। দয়া করে আমাকে কি উল্টো করে মুখ উপরে রেখে বের করতে পারবেন, যাতে আমার মুখ আপনাদের সামনে থাকে, শরীরের অন্য কোনো অংশ নয়।" আল্লাহু আকবার ! এমন পরিস্থিতিতে কে এসব ভাবনা মনে আনতে পারে ? কেবল সত্যিকারের হায়া বা সুস্থ লজ্জাশীলতা সম্পন্ন নারী বা পুরুষরাই। মেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, "প্রতিটি ধর্মের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিটি ধর্মের একটি সিগনেচার ট্রেইট রয়েছে”। তিনি বলেছেন, “মুসলিম হিসেবে আমাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হলো হায়া—সুস্থ লজ্জাশীলতা।" এক সাহাবি বর্ণনা করেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে একটি আসরে বসে ছিলাম। কেউ প্রশ্ন করল, "ইয়া রাসূলুল্লাহ ! হায়া কি দ্বীন এর অংশ ?" তিনি বললেন, "সমগ্র দ্বীনই হোলো হায়া বা সুস্থ লজ্জাশীলতা।" আপনি হয়তো বলবেন, কীভাবে সমগ্র দ্বীন এই একটি গুণে আবদ্ধ ? আমি বলব, কারণ আপনার ও আমার মধ্যে যদি মহান আল্লাহর প্রতি লজ্জাশীলতা থাকে, তাহলে আমরা নামাজ আদায় করব। নামাজ ছেড়ে দেয়ার আগে তাঁর সামনে লজ্জিত হবার ভয় করব। যদি হায়া থাকে, আমরা পূর্ণ ইসলামিক হিজাব পরিধান করব। যদি হায়া থাকে, আমরা দৃষ্টি অবনত রাখব, নিষিদ্ধ কামনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করব, অপরিচিতদের প্রেম নিবেদন করা বন্ধ করব, সুদ থেকে দূরে থাকব, ধূমপান বা শীশা খাওয়া বন্ধ করব—এসবকিছু এবং আরও অনেক কিছু আমরা করব যদি হায়া থাকে। তাই তিনি বলেছেন, "হায়াই সমগ্র দ্বীন।" রাসূল (সা.) বলেছেন, "হায়া বা সুস্থ লজ্জাশীলতা ঈমানের অংশ, আর ইমানের স্থান জান্নাতে।" ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আমাদেরকে শেখানো মেইয়ের প্রথম বার্তা এটি। ২। দ্বিতীয় বার্তা— ---------------------- মেই আমাদের শিখিয়েছেন হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা করার গুরুত্ব, পরিস্থিতি যাই হোক— ভালো অথবা খারাপ। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, "আপনি ঠিক আছেন ? আহত হয়েছেন ?" তিনি উত্তর দিলেন, "لَا، اَلْحَمْدُ لِلَّهِ، جُرُوْحْ بَسِيْطَةْ"। তিনি বললেন, "না, আলহামদুলিল্লাহ, আমি আহত হইনি। সকল প্রশংসা আল্লাহর, শুধু সামান্য কয়েকটা ক্ষত।" "لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَى وَالْآخِرَةِ"। আল্লাহ বলেছেন, "প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত, সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁর জন্যই।" এই কঠিন মুহূর্তেও আল্লাহর প্রশংসা ! কারণ তিনি এমন একজন নারী, যিনি সুস্থ অবস্থায়ও আল্লাহর প্রশংসা করতেন। তাই আল্লাহ অন্ধকার মুহূর্তেও তাঁকে প্রশংসা করার তাওফিক দিলেন। আল্লাহ যেমন চান আমরা সুস্থ, সামর্থবান, সুখী অবস্থায় তাঁর প্রশংসা করি, তেমনি তিনি চান আপনি তাঁর প্রশংসা করুন অসুস্থ, দুঃখী, দুর্বল, দারিদ্র্য অবস্থায় কিংবা সম্পর্কের সংকটে থাকলেও। আলহামদুলিল্লাহ ! সকল অবস্থায়। মেই আমাদেরকে এই দ্বিতীয় বার্তাটি দিলেন — আপনার সময় যতই অন্ধকারাচ্ছন্ন হোক, হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা কখনোই থামানো যাবে না। ৩। বার্তাটি হল— ------------------ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার গুরুত্ব। অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় মেই কী বলেছিলেন ? খেয়াল করলে শুনতে পাবেন তিনি বলছেন, "اَلله يُكَثِّرُ مِنْ أَمْثَالِكُمْ"। তিনি চারপাশের উদ্ধারকারী তরুণদের বললেন, "আল্লাহ আপনাদের মতো সৎ মানুষদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিন। আপনাদের সাথে কারোই তুলনা হয় না।" ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত, আহত দেহ নিয়েও তিনি উপলব্ধি করলেন, যারা তাকে বাঁচাতে এসেছেন, তারা দিনরাত কাজ করছে—কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ভারী যন্ত্রপাতি ছাড়াই লোহার ফ্রেম, কংক্রিটের স্তূপ সরাচ্ছেন খালি হাতে, বিনা পারিশ্রমিকে। তিনি বললেন, "আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করুন। আপনাদের মতো মানুষ যেন আরও বৃদ্ধি পায়। আপনাদের সাথে কারোই তুলনা হয় না।" তিনি রাসূল (সা.)-এর হাদিসটি শুনেছিলেন — "যে মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানায় না, সে আল্লাহকেও কৃতজ্ঞতা জানায় না।" আপনার বাবা-মা রয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। এই অহংকারে ভুগবেন না যে আপনি তাদের চেয়ে "বড়" হয়ে গেছেন। কথায়, উপহারে, ফোনে-মেসেজ-সাক্ষাতে, হাসিতে, সেবায়, ধৈর্যে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। ক্ষমা চেয়ে, চোখের জল ফেলে, চুমু খেয়ে কৃতজ্ঞতা দেখান। আপনার জীবনসঙ্গী—তার ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞ হোন। মনে হতে পারে সে হয়তো আরও উত্তম হতে পারত, তবু কৃতজ্ঞতা জানান। তাহলে আল্লাহ তাকে আরো উত্তম হওয়ার প্রেরণা প্রদান করবেন। আপনার শিক্ষক—যিনি আপনাকে এমন কিছু শিখিয়েছেন যা আপনি জানতেন না, যিনি আপনাকে জীবনের পথ দেখিয়েছেন—তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। এই অহংকার করবেন না যে আপনি এখন তাঁর চেয়ে এগিয়ে গেছেন। আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে আপনার সেই শিক্ষকের কাছে ঋণী মনে করবেন। জীবনের কোনো পর্যায়ে যারা আপনাকে সাহায্য করেছেন, সংকট থেকে উদ্ধার করেছেন—আল্লাহর মুখোমুখি হওয়ার দিন পর্যন্ত নিজেকে তাঁদের কাছে ঋণী মনে করবেন। মেই আমাদের শিখিয়েছেন যে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও কৃতজ্ঞতা জানানো সম্ভব। তৃতীয় এই বার্তাটি মেই বিশ্ববাসীকে দিলেন মাত্র ৬০ সেকেন্ডের ভিডিওতে। কে তাকে শিখালেন ? আল্লাহু আকবার !
চতুর্থ যে বার্তা মেই আমাদের শিখিয়েছেন তা হলো, আল্লাহ্ সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রে মার্জিত মনোভাবের মূল্য এবং গুরুত্ব। কখনো কখনো, আমরা যখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাই, তখন এ বিষয়ে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আমরা হয়তো বলে ফেলতে পারি, "কোথায় পরাক্রমশালী আল্লাহ ?" মেইকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "বাড়িতে আপনার সাথে কে ছিল ?" তিনি বললেন, "আমার মা।" তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, "তিনি কি জীবিত?" মেই উত্তর দিল, "না। তিনি আমার পাশে ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন।" তারা বললেন, "يَعْنِيْ شَهِيْدَةْ - তাহলে তো তিনি শাহিদ ? মেই কি উত্তর দিয়েছিলেন ? একটি শব্দ। তিনি বলেছিলেন, "ইন শা আল্লাহ্ - আল্লাহ যদি চান। আমি জানি না তিনি শাহিদ কিনা; যদি আল্লাহ চান। আমি আশা করি।"
কখনও কখনও আমরা আমাদের শাহিদদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলি, "অমুক শাহিদ হয়েছে" ! "فُلَان اَلشَّهِيْدْ" - অমুক ব্যক্তি শাহিদ হয়েছে, "فُلَان اَلْمَغْفُوْرُ لَهُ" - অমুক ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা জানি না। নিদর্শনগুলো বিদ্যমান। আমরা আশা করি তারা শাহিদ, আশা করি আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করেছেন। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে দাবি করতে পারি না। মেই বললেন, "ইন শা আল্লাহ্, আমার মা শাহিদ হয়েছেন।" এজন্যই বর্ণিত আছে: "وَيْلٌ لِلْمُتأَلِّينَ عَلَى اللهِ" - ধ্বংস তাদের জন্য যারা আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে ধারণা করে, "يَقُولُونَ فُلَانٌ فِي الْجَنَّةِ، وَفُلَانٌ فِي النَّارِ" - যারা নির্দ্বিধায় বলে বেড়ায়, অমুক জান্নাতে, আর অমুক জাহান্নামে। মেই তার চতুর্থ বার্তায় আমাদের শিখিয়েছেন—মহান আল্লাহ্ সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রে পরিশীলিত মনোভাব পোষন করা।
পঞ্চম বার্তাটি হলো, মেই আমাদের শিখিয়েছেন যে, জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্তে মহান আল্লাহ আপনাকে সহায়তা ও সুসংবাদ দেবেন। মেইকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনি ধ্বংসস্তূপের নিচে কতদিন আটকে ছিলেন ?" তিনি বললেন, "পাঁচ দিন।" তারা রসিকতা করে বললেন, “তার মানে আপনি দিন-রাতগুলো একটানা দেখেছেন?” মেই বললেন, তাঁর কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন, …. তিনি বললেন, "না, না। ফেরেশতারা আমার পাশে এসেছিলেন এবং তাঁরা জায়গাটি আলোকিত করে রেখেছিলেন।" ভিডিওটি দেখুন ! মেই বলেছেন, "ফেরেশতারা এসেছিলেন। তাঁরা আমার জন্য স্থানটি আলোকিত করে রেখেছিলেন।"
বার্তাটি হলো—আপনার জীবনের অন্ধকারতম সময়ে আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করবেন এবং সুসংবাদ প্রদান করবেন। আর উম্মতের অন্ধকারতম সময়ে, আমাদের যখন মনে হবে এর চেয়ে খারাপ আর হওয়ার কিছু নেই, যেমন ফিলিস্তিনের অবস্থা—কেউ কেউ হয়তো এটাকে ‘আশাহীন চেষ্টা’ বলে বর্ণনা করেছে—ঠিক তখনই ১১ দিনের মধ্যে সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ল এবং শাসন ক্ষমতা সিরিয়ার জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তন করলো। আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: "أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ" -জেনে রাখো, আল্লাহর বন্ধুদের, মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।
তারা কারা ? "الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ" - যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং এবং তাঁকে ভয় করেছে। শুনুন, শুনুন ! "لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ" - তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সুসংবাদ। ইয়া রব্বি, আমাদেরকেও সুসংবাদ দিন ! যদি আপনার জীবনে মুহূর্তটি কঠিন হয়, ধৈর্য ধরুন, মহান আল্লাহর উপর আশা রাখুন, সবর করুন। এই পরীক্ষা যেন আপনার ঈমানকে ম্লান না করে। আল্লাহ্ আপনার কাছে সুসংবাদ প্রেরণ করবেন। এজন্যই নবীজি (সা.) বলেছেন: জেনে রাখো, ধৈর্যের সাথেই বিজয় রয়েছে, وَأَنَّ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ - কাঠিন্যের পরেই স্বস্তি আসে। وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ وُسْرََا - কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি আসে। পঞ্চম বার্তা — মেই আমাদের শিখিয়েছেন, আপনার অন্ধকারতম সময়ে মহান আল্লাহ্ আপনার কাছে সুসংবাদ প্রেরণ করবেন।
ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত বার্তা যা আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, মেই আমাদের শিখিয়েছেন حُسْنُ الظَّنِّ بِاللهِ - এর মূল্য— সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বোত্তম আশা রাখা এবং সবচেয়ে সুন্দর ধারণা পোষন করা। ভিডিওতে তিনি নিজের চারপাশের উদ্ধারকারীদের বলেছিলেন... তিনি বলেছিলেন, "আল্লাহর শপথ, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আপনারা আসবেন এবং আমাকে খুঁজে পাবেন, আর আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আপনাদের কেউই ব্যর্থ হবেন না।" কীভাবে তিনি সেই ইয়াকীন, সেই নিশ্চয়তা অর্জন করলেন ? তাঁর চারপাশের সবকিছুই যখন তাঁর প্রতিকূলে ছিল, কীভাবে তিনি আল্লাহর প্রতি এই অটল বিশ্বাস ধারণ করলেন ? কারণ তিনি আল্লাহর প্রতি সর্বোত্তম আশা পোষণ করতেন, তিনি তাঁর সম্পর্কে কখনও খারাপ ধারণা করতেন না। একজন কবি যেমনটা বলেছেন, "হে আমার রব, আমি আপনার প্রতি সুন্দর ও অফুরান একটি আশা রাখি। এক আশা যা আমার প্রতিটি পদক্ষেপে সঙ্গী হয়। হে রব, বৃষ্টি কামনাকারী সকলকে আপনি ভারী বর্ষনে সিক্ত করেছেন। এ জন্য ব্যাপারটা অসম্ভব যে আপনি আমার ভূমিকে শুষ্ক রেখে দিবেন।"
কুরআন জিজ্ঞাসা করছে, فَمَا ظَنُّكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ বিশ্বজগতের রব আল্লাহর প্রতি আপনার আশা কেমন ? মেই বলছেন, "আমি নিশ্চিত ছিলাম।" ফিলিস্তিন, গাজা ও মসজিদুল আকসা সম্পর্কে কথা বলার সময় সর্বশেষ আপনি কখন বলেছেন যে, "আমি নিশ্চিত" ? তাদের যা ইচ্ছা করুক, আমি নিশ্চিত। সুদানের ক্ষেত্রে — আমি নিশ্চিত; উইঘুরের ক্ষেত্রে — আমি নিশ্চিত; সিরিয়ার ক্ষেত্রে — আমি নিশ্চিত। নবী ইয়াকুব (আ.)-এর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি হয়ে, যিনি তাঁর সন্তানদের বলেছিলেন, أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ — হে আমার সন্তানেরা, আমি কি তোমাদের বলিনি যে আমি আল্লাহর সম্পর্কে এমন বিষয় জানি যা তোমরা জান না ?
আর নবীজী যখন মক্কার প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাদের নবী (স.) বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে তিনি ভেতরে প্রবেশ করবেন। দাওয়াহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর মক্কার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু গোপনে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি মক্কায় ফিরবেন ? তিনি তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছেন, চাচাকে হারিয়েছেন, ক্রমাগত তাঁর সাহাবীদের হারাচ্ছেন, নিজে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যায়েদ (রা.) নবী (স.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, "কিভাবে আপনি মক্কায় ফিরে যাবেন ? কি করবো আমরা ?
আমাদের তো মক্কা ত্যাগ করার কথা ছিলো না।" রসূল (স.) বললেন — আমি চাই এই কথাগুলো আজকে আপনারা বিশেষভাবে হৃদয়ে ধারণ করবেন — তিনি বললেন, "হে যায়েদ, যেই সঙ্কট তুমি দেখতে পাচ্ছ, আল্লাহ এই সংকট থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবেন। তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নবীকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবেন। কীভাবে — তা জানতে চেয়ো না, কিন্তু আমি সুনিশ্চিত।"
মেইও বলেছিলেন, "আমি নিশ্চিত ছিলাম।" আল্লাহর প্রতি সর্বোত্তম আশা লালন করুন। সামাজিক মাধ্যমে দেখা নিষ্ঠুরতা, ঠান্ডায় জমে যাওয়া শিশু ও বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখেও আল্লাহর প্রতি সন্দেহ বা খারাপ ধারণা করা থেকে সতর্ক থাকুন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সম্পর্কে সর্বোত্তম ছাড়া কিছু ভাববেন না। আমাদের উম্মাহ সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট প্রিয়, এবং আমাদের উম্মাহই বিশ্বের জন্য আদর্শ। আমাদেরই নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা ছাড়া কেউ নেতৃত্ব দেবে না— একটি ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্ব, এই অসুস্থ ও বিপর্যস্ত পৃথিবীতে। এটাই আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের প্রতি আল্লাহর প্রত্যাশা।
তাই আমাদের জীবনচুল্লিতে ফেলা হবে, এরপর লোহার আঘাত দেওয়া হবে, এরপর বের করে আনা হবে, আবার চুল্লিতে ঠেলে দেওয়া হবে, আঘাত দেওয়া হবে, আবার বের করা হবে। স্বীকার করতেই হবে, এই ভয়াবহ প্রক্রিয়ায় আমাদের কেউ কেউ ভেঙে পড়বে। কিন্তু অন্যরা পরিশোধিত, উজ্জ্বল, পরিচ্ছন্ন, দৃঢ়তর হয়ে উদ্ভুত হবে — আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য, এবং আল্লাহর নির্ধারিত নেতৃত্বের অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রস্তুত।
সুতরাং, উম্মতের ভোগান্তিকে আল্লাহর রহমতের প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে ব্যাখ্যা করা থেকে সতর্ক থাকুন। এজন্যই নবী (স.) বলেছেন, আমার এই উম্মতের প্রতি আল্লাহ রহমত প্রদর্শন করবেন। আখিরাতে তারা ভোগান্তির শিকার হবে না। সকল ভোগান্তি তাদের জন্য ত্বরান্বিত করা হবে এই দুনিয়ার জীবনে — পরীক্ষা, ভূমিকম্প এবং হত্যার শিকার হওয়ার মাধ্যমে। তাই যে কোন রক্তপাতকে ভুল বোঝা বা ভুল ব্যাখ্যা করা থেকে সতর্ক থাকুন, বরং এটা হলো আল্লাহর করুণার বহিঃপ্রকাশ এবং আমাদেরকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া।
এটাই আমাদের তাকদীর। আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য এটাই নির্ধারণ করেছেন। আজ এই সন্ধ্যায় আমরা ঘোষণা করছি — হে আল্লাহ, যদি আমাদের ভোগান্তির অর্থ এই হয় যে আপনি আমাদের পাপ মোচন করবেন, এবং আমাদের মুনাফিকদের পৃথক করে দিবেন, এবং আমাদের আচরণকে পরিশুদ্ধ করে দিবেন, এবং আমাদেরকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করবেন, এবং আমাদের ভূমি ফিরিয়ে দিবেন, এবং আখিরাতে আমাদের ভোগান্তি দিবেন না এবং সর্বোপরি আপনার সন্তুষ্টি প্রদান করবেন, তাহলে যা কিছুই আসুক না কেন, হে আল্লাহ, আমরা আপনার ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট।
(সমাপ্ত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন