ইবাদতে তিনটি আবেগ
ইবাদতে তিনটি আবেগ : ভালোবাসা, ভয় ও আশা আগেকার যুগের বহু আলেমেরা বলতেন, আল্লাহ্ তাআলার ইবাদত করা হয় মূলত তিনটি আবেগের উপর ভিত্তি করে: [১] আল-হুব (ভালোবাসা) [২] খাউফ (ভয়) এবং [৩] রজা (আশা) আমরা আল্লাহর ইবাদত করি, কারণ আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি। আমরা আল্লাহর ইবাদত করি, কারণ আমরা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করি। আমরা আল্লাহর ইবাদত করি, কারণ আমরা আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর দয়ার প্রতি আশাবাদী। এই আশা ধরে রাখার কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এক—আমাদের ভালো কাজের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার আশা করা। আমরা যদি দান করি, আমাদের আশা আছে যে আল্লাহ এই দান কবুল করে আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। যদি মানুষের সাথে ভালো আচরণ করি, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, অর্থাৎ যেকোনো ভালো কাজই করি না কেন—আমাদের আশা আছে আল্লাহ আমাদেরকে এই সমস্ত কাজের জন্য পুরস্কার দিবেন। এই ভালো কাজের সর্বোচ্চ আশার পর্যায় হলো আল্লাহর জান্নাতের প্রত্যাশা রাখা। এই আশা করা যে আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। দুই—এই আশা করা যে আল্লাহ আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। হ্যাঁ, প্রত্যেক ঈমানদারের আল্লাহর দয়ার প্রতি আশা থাকা উচিত। আল্লাহ যে ক্ষমা করে দিবেন—আল্লাহর এই দয়ার প্রতি কখনো আশা ছেড়ে দিবেন না। তিন—আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাতের আশা করা। রাসূল ﷺ বলেছেন, مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ أَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ ❝যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ ভালোবাসে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ ভালোবাসেন।❞ [সহীহ বুখারী : ৬৫০৭, সহীহ মুসলিম : ৬৯৯৮] কুরআন আমাদের বলে, يَرْجُوا۟لِقَآءَرَبِّهِ ﴾তারা তাদের রবের সাক্ষাৎ আশা করে। ﴿ [সূরা কাহাফ : ১১০] তারা আল্লাহর সাথে দেখা করার জন্য উদ্দীপ্ত। এই ধরণের রজা (আশা) পোষণ করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধার্মিক মানুষেরা—মুহসিন, মুত্তাকী মানুষেরা। তারা এমন এক পর্যায়ের ঈমানে পৌঁছেছে যে তারা আত্মবিশ্বাসী, একইসাথে তাঁরা অবশ্য আল্লাহর শাস্তির ভয়ও করে। তাঁরা আত্মবিশ্বাসী যে আমরা জান্নাতের আশা করছি। আমি আল্লাহ তাআলাকে দেখতে চাই। এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের রজা (আশা)। চার—যখন এই দুনিয়াতে কোনোকিছু পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করবেন, তখন এই আশা করা যে, আল্লাহ আমাকে এটা দান করবেন। আমাদের রাসূল ﷺ বলেন, ❝আল্লাহর কাছে যা চেয়ে দুআ করছো আল্লাহ তোমাকে তা দিবেন—অন্তরে এই নিশ্চয়তা পোষণ করা ছাড়া কখনো দুআ করো না।❞ [জামে তিরমিযী : ৩৪৭৯; মুসনাদে আহমাদ : ৬৬৫৫] অন্তরে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, আমি জানি আল্লাহ আমার দুআর জবাব দিবেন। এটাও উচ্চতম একটি পর্যায়। আপনার এই মনোভাব আছে যে, কীভাবে আস-সামি (যিনি সবকিছু শুনেন) আমার দুআ না শুনে থাকবেন, কীভাবে আর-রহমান আমার প্রয়োজন না দেখে থাকবেন। আর কীভাবে আল-কারীম (সুমহান দাতা)-র কাছে চাইলে আমাকে না দিয়ে থাকবেন। পাঁচ—এই আশা করা যে, আমাদের কষ্টকর পরিস্থিতিগুলো আল্লাহ তাআলা সহজ করে দিবেন। চাকরি হোক, পরিবার হোক, মুসলিম উম্মাহর কোনো সমস্যা হোক, যাই হোক না কেন—যে পরিস্থিতিতে আমি এখন আছি, যে সমস্যার মোকাবেলা করছেন, যে সংকট আপনার জন্য ঝামেলা তৈরি করছে ইনশাআল্লাহু তাআলা খুব দ্রুত এর একটা পরিবর্তন ঘটাবেন। আজ না হলে কাল, কাল না হলে পরশু—এর সমাধান হবেই। আপনার সার্বক্ষণিক রজা (আশা) আছে যে, আমার সমস্যাপূর্ণ দিকটি একসময় আমার জন্য কল্যাণকর দিকে রূপান্তরিত হবে। আমার হতাশার কারণটি প্রত্যাশার কারণে রূপান্তরিত হবে। আমার দুঃখ একসময় সুখের কারণে পরিণত হবে। একজন বিশ্বাসীর অন্তর অফুরন্ত আশার উৎস। মুমিনের হৃদয় থেকে সর্বদা আশার আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কেন? কারণ, একজন বিশ্বাসীর প্রত্যাশা আসে আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান থেকে। আর অবশ্যই এই আশাবাদী মনোভাবের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। এটা আমাদেরকে এক ধরণের ইতিবাচক শক্তি দান করে। আমাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এটা আমাদেরকে সওয়াবের কাজ করার অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার নিকট দু'আ করার অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়। আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করার অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়। সর্বোপরি, এটা আপনাকে আরও উত্তম মানুষে পরিণত করে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে। আপনার ইবাদতে, অন্যদের সাথে ভালো আচরণ করার ক্ষেত্রে, আল্লাহ তাআলার প্রতি আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে, দুনিয়ার চাপ মোকাবেলার ক্ষেত্রে। 'রজা' বা আশাবাদী মনোভাব জীবনের সকল ক্ষেত্রে শুধু কল্যাণই নিয়ে আসে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রজা (আশা) আল্লাহ তাআলার জন্য আমাদের অন্তরে ভালোবাসা নিয়ে আসে, তাওয়াক্কুল নিয়ে আসে এবং সর্বদা আল্লাহর নিকট বিভিন্ন জিনিস চাওয়ার প্রেরণা নিয়ে আসে। —শাইখ ড. ইয়াসির কাদি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন