মহানবী (সা.) তিনজন অমুসলিমের প্রশংসা করেছিলেন

 


মহানবী (সা.) এসেছেন সত্যের বার্তাবহ হয়ে, অমুসলিমদের ইসলামের ছায়াতলে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। যারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি, তাদের সঙ্গেও তিনি ন্যায়সংগত আচরণ করেছেন। তাঁর সময়ে তিনজন অমুসলিমের প্রশংসা করেছেন তিনি। কী ছিল এমন তাঁদের মধ্যে, যা নবীজির কাছে প্রশংসনীয় মনে হয়েছিল? আসুন, পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

১. কুরাইশ নেতা মুত’ইম ইবনে আদি

তায়েফ থেকে নবীজি (সা.) ফিরে আসছিলেন আহত ও অপমানিত হয়ে। চাচা আবু তালিব সম্প্রতি মারা গেছেন, ফলে মক্কায় তিনি পুরোপুরি সহায়হীন। এমন পরিস্থিতিতে মক্কায় প্রবেশ করা ছিল আত্মঘাতী। তাই তিনি মক্কার বিভিন্ন নেতৃস্থানীয়দের কাছে বার্তা পাঠালেন নিরাপত্তা চেয়ে। একমাত্র কুরাইশ নেতা মুত’ইম ইবনে আদি ছাড়া কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি।

মুত’ইম ছিলেন তাঁদের একজন, যাঁরা কুরাইশের বয়কট ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিলেন। বয়কটে মহানবী (সা.) সমগোত্রীয় সবার সঙ্গে তিন বছর অনাহারে কষ্ট পেয়েছিলেন। যখন তিনি শুনলেন যে নবীজি (সা.) তাঁর কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন, তিনি তাৎক্ষণিক ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। নিজেদের ছেলেদের ডেকে আদেশ দিলেন, ‘বর্ম পরে কাবার প্রতিটি কোণে অবস্থান নাও, কারণ আমি মুহাম্মদকে ‘নিরাপত্তা’ দেব বলে নিশ্চয়তা দিয়েছি।’

মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করলে মুত’ইম ও তাঁর ছেলেরা চারপাশে সশস্ত্র অবস্থায় তাঁর সঙ্গী হন। তাঁরা সোজা কাবার দিকে গেলেন এবং মুত’ইম তাঁর ঘোড়ায় বসেই ঘোষণা করলেন, ‘কুরাইশের লোকেরা, আমি মুহাম্মদকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছি, তাই কেউ যেন তাঁকে আঘাত করতে না আসে।’

নবীজি (সা.) সেখানে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন এবং মুত’ইম ও তাঁর সন্তানেরা তাঁকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। (সাঈদ ইবনে আলি আল–কাহতানি, রহমাতুল্লিল আলামিন, দারুস সালাম পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা: ১৪৪)

বছরখানেক পরে বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা কুরাইশদের অনেক যোদ্ধাকে বন্দী করলে মুত’ইমকে স্মরণ করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ‘যদি মুত’ইম ইবনে আদি জীবিত থাকতেন এবং এই অপবিত্র মানুষদের জন্য আমার কাছে সুপারিশ করতেন, তবে আমি তাঁর কারণে তাদের ক্ষমা করতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪, ০২৩)

২. ইহুদি রাব্বি মুখায়রিক

হিজরতের তৃতীয় বছর মুসলিমরা খবর পেলেন যে কুরাইশের একটি বড় সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণ করতে আসছে। ওহুদ পাহাড়ে গিয়ে শত্রুদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুসলমানদের সংখ্যা তখন খুবই কম। অন্তত তিন গুণ কম ছিল শত্রুদের তুলনায়। মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের একটা চুক্তি ছিল যে মদিনা যদি আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে সবাই মিলে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু একমাত্র মুখায়রিক ছাড়া কেউ সেই চুক্তি রক্ষা করতে চাননি।

ইবনে ইসহাকের বরাতে ইমাম জাহাবি মুখায়রিকের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘প্রথমে মুখায়রিক তাঁর গোত্রের লোকদের নবীকে সাহায্য করতে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের চুক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইহুদি সম্প্রদায়, তোমরা জানো যে, মুহাম্মদকে জয়ী করা তোমাদের দায়িত্ব।’ তারা বলল, ‘আজ তো শনিবার।’ তিনি বললেন, ‘না, আজ কোনো শনিবার নেই!’ তারপর তিনি তাঁর তরবারি ও যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে বের হন এবং বলেন, ‘যদি আমি মারা যাই, তবে আমার সব সম্পত্তি মুহাম্মদের কাছে চলে যাবে এবং তিনি তাঁর খুশিমতো ব্যবহার করতে পারবেন।’ তিনি ওহুদ যুদ্ধে গিয়ে লড়াই করেন এবং নিহত হন। নবীজি (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘মুখায়রিক ছিলেন ইহুদিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’ (ইমাম জাহাবি, সিয়ারু আলাম আন–নুবালা, ২/৪২)

মুখায়রিক ছিলেন বনু সালাবা ইবনে ফিতয়োন গোত্রের অধিবাসী। মুখায়রিকের মৃত্যুর আগে তাঁর বাগান ও অন্যান্য সম্পত্তি নবীজির জন্য ওয়াক্‌ফ করে যান, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। (ইবনে কাসির, আল–বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/২৯০)

৩. খ্রিষ্টান রাজা নাজ্জাশি

মক্কায় কুরাইশদের অত্যাচার বাড়তে থাকলে একসময় নবীজি (সা.) কিছু মুসলিমকে ইথিওপিয়ায় (আবিসিনিয়া) পালানোর অনুমতি দিলেন। নাজ্জাশি ছিলেন তখন ইথিওপিয়ার রাজা। তাঁর আসল নাম আশহামা। ‘নবী (সা.) জানতেন যে আশহামা একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক, যিনি তাঁর প্রজাদের প্রতি অন্যায় করবেন না, তাই তিনি তাঁর সাহাবিদের একটি দলকে ইথিওপিয়ায় আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।’ (সফিউর রহমান মুবারকপুরি, আর–রাহিকুল মাখতুম, ৭৮)

পরে ৮৩ জন পুরুষ ও ১৯ জন নারীর বড় একটি দল ইথিওপিয়ায় গিয়েছিল। রাজা তাদের সবাইকে উদারচিত্তে স্বাগত জানান। কুরাইশরা তখন তাদের ফিরিয়ে আনতে নাজ্জাশির কাছে দামি উপহার নিয়ে প্রতিনিধি পাঠায়। কিন্তু তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ রাজার মতোই মুসলিমদের আদালতে ডাকেন এবং তাদের বক্তব্য শুনতে চান। নাজ্জাশি যখন ইসলামের সৌন্দর্য দেখলেন এবং ঈসা ও মরিয়াম (আ.) সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য জানলেন, তখন তিনি কুরাইশ প্রতিনিধিদের উপহার ফিরিয়ে দেন এবং তাদের স্পষ্ট ভাষায় বললেন যে, তিনি তাঁর সম্মানিত অতিথিদের বিতাড়িত করতে রাজি নন।’ (সাঈদ ইবনে আলি আল–কাহতানি, রহমাতুল্লিল আলামিন, দারুস সালাম পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা: ১৪০)

জানা যায়, নাজ্জাশি পরবর্তী সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এমনকি নাজ্জাশি মারা গেলে মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা তাঁর জন্য গায়েবি জানাজার নামাজ আদায় করেন। নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আজ একজন ধার্মিক ব্যক্তি আবিসিনিয়া থেকে চলে গেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩২০)

‘ডিসকভারিং ইসলাম’ আর্কাইভ থেকে


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে