নবী ইবরাহিম (আ.) ও চারটি পাখি
অনেক সময় এমন হয়, আমরা একটা বিষয় বিশ্বাস করি, তারপর সেই বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করতে অনেক পড়াশোনা করি, নিজ চোখে দেখার চেষ্টা করি, ক্ষেত্রবিশেষ পরীক্ষা–নিরীক্ষাও করে থাকি।
বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আমরা যত বেশি আলোচনা করি, বিশ্বাস তত শক্তিশালী হয়। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তুমি আলোচনা করতে থাকো, কারণ এ আলোচনা ইমানদারদের উপকারে আসবে।’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত: ৫৫)
বিজ্ঞানীরা অনেক সময় পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত কোনো বিষয়কে সত্য প্রমাণ করেন। মুসলমান হিসেবে তো আমরা বিজ্ঞানীদের প্রমাণ ছাড়া পবিত্র কোরআনের প্রতিটি হরফ বিশ্বাস করি, তবু তাঁদের তত্ত্ব আমাদের মনকে প্রশান্ত করে, বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
এ কারণে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করা ভালো, এতে এলেম বৃদ্ধি পায় এবং ইমানে নতুনত্ব আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার এমন একটি ঘটনা এনেছেন:একদিন হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর কাছে আরজ করেন, ‘হে আমার রব, আপনি কীভাবে মৃতদের জীবিত করেন?’
আল্লাহ বললেন, ‘তুমি কি বিশ্বাস করোনি?’
হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘অবশ্যই বিশ্বাস করি। কিন্তু আমার মনের প্রশান্তির জন্য দেখতে চাই।’
আল্লাহ বললেন, ‘তাহলে তুমি চারটি পাখি নাও। তারপর সেগুলোকে পোষ মানাও। এরপর (পাখিগুলো জবাই করে অনেকগুলো টুকরা বানিয়ে) প্রতিটি পাহাড়ে তার টুকরা রেখে আসো। তারপর সেগুলোকে ডাক দাও, সেগুলো তোমার কাছে দৌড়ে আসবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬০)
ইবরাহিম (আ.) ঠিক তা–ই করলেন এবং তিনি স্বচক্ষে মৃতকে জীবিত হতে দেখলেন।পবিত্র কোরআনের এ কাহিনি থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই:
১. পবিত্র কোরআন আমাদের ‘অন্ধের মতো বিশ্বাস’ করতে বলে না। হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর ক্ষমতায় পূর্ণ বিশ্বাস রাখার পরেও প্রশ্ন করেছেন, স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর বিশ্বাস ‘চাক্ষুষ’ হয়ে উঠেছে।
পবিত্র কোরআনের আরেক জায়গায় হজরত ইউসুফ (আ.)–এর কাহিনি বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেন,‘ বলো, এটাই আমার পথ। আমি জেনে–বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে, তারাও (একইভাবে দাওয়াত দেয়)। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৮)২. বিশ্বাস করাটাই শেষ কথা নয়; বরং বিশ্বাসকে পাকাপোক্তকরণে সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে লোক সব, আমি তোমাদের প্রতি এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যার মধ্যে তোমাদেরই কথা আছে, তারপরও কি তোমরা বুদ্ধির প্রয়োগ করবে না?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০)
এরই সূত্র ধরে আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘ধর্ম চায়, তাৎক্ষণিক বিশ্বাস। আর দর্শন চায়, সত্যকে উপলব্ধির জন্য তাকে আলাদা আলাদা ভাগ করে ধীরে–সুস্থে পর্যবেক্ষণ করতে। দুটি বিষয়ই প্রতিনিয়ত নতুন শক্তির প্রয়োজনে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।’ (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, প্রকাশনী: প্রথমা, পৃ. ২২)
এর মানে জাগতিক জ্ঞান অর্থাৎ দর্শন, শিল্পসাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমেও আমরা আমাদের ইমান মজবুত করতে পারি।৩. ইমান হলো বিশ্বাস, কিন্তু হৃদয়ের প্রশান্তি এর চেয়ে আলাদা। ইমান যদি হৃদয়ে প্রশান্তি না আনে, তবে তা দোদুল্যমান থাকে, মজবুত হয় না। তাই ইমানদার ব্যক্তির উচিত তার বিশ্বাস কীভাবে প্রশান্তিদায়ক হয়, তা নিয়ে চিন্তা–ফিকির করা।
এর মানে, পবিত্র কোরআনের প্রতিটি বাণী নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, গবেষণা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে না?’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৮২)
৪. শিক্ষার জন্য সময় লাগে, ধাপে ধাপে সামনে এগোতে হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)–কে আল্লাহ প্রথমে পাখিকে পোষ মানাতে বলেন, বন্ধুত্ব করতে বলেন, এরপর জবাই করে টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন পাহাড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আসতে বলেন।
প্রতিটি কাজই পরিশ্রম ও সময়সাপেক্ষ। ইবরাহিম (আ.) এত সব মেহনত করার পর যখন পাখিদের ডাক দেন, তখন তাঁর কাঙ্ক্ষিত ফল পান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন