এতিম নারীদের বিবাহ, মহর এবং মীরাস সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা
এতিম নারীদের বিবাহ, মহর এবং মীরাস সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা
Abul Monsur Ahamed
সাহাবায়ে কেরামগণের অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা ছিল এতিম নারীদের বিবাহ এবং মীরাস-সংক্রান্ত ব্যাপারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর লোকেরা তোমার নিকট নারীদের বিষয়ে ব্যবস্থা জানতে চায়। বল, আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা জানাচ্ছেন এবং এতিম নারীদের সম্পর্কে যাদের প্রাপ্য তোমরা প্রদান কর না, অথচ তোমরা তাদেরকে বিবাহ করতে চাও, এবং অসহায় শিশুদের সম্বন্ধে ও এতিমদের সঙ্গে তোমাদের ন্যায়বিচার সম্পর্কে যা কিতাবে তোমাদেরকে শোনানো হয়, তাও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন। আর তোমরা যে-কোন সৎকাজ কর, আল্লাহ তো তা সবিশেষ অবহিত। [সূরা নিসা : আয়াত ১২৭]
উপরিউক্ত জিজ্ঞাসার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে যে-কথা বলা একান্ত আবশ্যক মনে করছি, তা হল এতিম-সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে সূরা বাকারার আয়াত নং ২২০-এর অনুকূলে করা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব বিধানাবলি নারী এতিমদের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। তবে আলোচ্য আয়াতের আলোচনা কেবল তাদের বিবাহ এবং মীরাস-সংক্রান্ত ব্যাপারেই সীমিত থাকবে।
জিজ্ঞাসাকারী সাহাবী কে বা কারা ছিলেন তা অজ্ঞাত থাকলেও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বরাত দিয়ে তাফসীরে রুহুল মাআনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আয়াতটি উম্মে কুহাতের কন্যাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। জাহেলী যুগ এমনকি ইসলামের প্রাথমিক যুগেও এমন প্রচলন ছিল যে, যদি কোন অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে এতিম নারী প্রতিপালিত হত, আর সে এতিম যদি সম্পদশালী ও রূপলাবণ্যের অধিকারী হত, তাহলে অভিভাবক নিজেই তার সম্পদ ও রূপ-সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খুব সামান্য মহরানার বিনিময়ে বিবাহ করতে ইচ্ছুক হত। হযরত আয়েশা রা. বলেছেন, এমনি প্রেক্ষাপটে এ ব্যাপারে লোকেরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফতোয়া জানতে চাইলে তখন আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
জিজ্ঞাসার জবাবে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, ‘বল, আল্লাহ তাদের ব্যাপারে তোমাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছেন, আর কিতাবে যা তোমাদের নিকট পাঠ করা হয়, তা ঐ সব পিতৃহীনা নারীদের বিধান যাদেরকে তোমরা নির্ধারিত অধিকার প্রদান কর না অথচ বিবাহ করার বাসনা রাখ। আর অক্ষম শিশুদের বিধান এই যে, এতিমদের জন্য ইনসাফের উপর কায়েম থাক। তোমরা যা ভাল কাজ করবে, আল্লাহ তা অবশ্যই অবগত আছেন।’ [সূরা নিসা : আয়াত ১২৭]
এই হল আল্লাহ তাআলার জবাব। জবাবের বিস্তারিত আলোচনার আগে এতিমের পরিচয় এবং তার প্রতি কুরআন-হাদিসে আরোপিত গুরুত্ব সম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনা করতে চাই। সাধারণত পিতৃহীন নাবালেগ বালক-বালিকাকেই এতিম বলা হয়। মানবজাতির বেলায় পিতৃহীন শিশু এবং জীব-জানোয়ারের বেলায় মাতৃহীন প্রাণীকে এতিম বলা হয়। পিতৃহারা সন্তানকে নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্বের জন্যই এতিম বলা হয়। এতিমত্বের সীমারেখা সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বালেগ হওয়ার পর আর কেউ এতিম থাকে না।
কুরআন-হাদিসে এতিম-অনাথদের প্রতি সদাচরণ এবং তাদের অধিকার প্রদান করতে বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে। এতিমের প্রতি সদাচারী জান্নাতী এবং অসদাচারী জাহান্নামী বলে হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এতিমের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ এবং তার সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ করার উপরও সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ গ্রাস করাকে আগুন ভক্ষণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যারা এতিমের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুন ভর্তি করছে। এবং অতিসত্বর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [সূরা নিসা : আয়াত ১০]
তৎকালে এতিমদের প্রতি খুব-একটা সুবিচার করা হত না। তারা ছিল সর্বত্রই অবহেলিত, অধিকার-বঞ্চিত। কখনো তাদেরকে তাদের সম্পদ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হত, আবার কখনো তাদের সম্পদ ফিরিয়ে দিলেও উৎকৃষ্ট সম্পদের বদলে নিকৃষ্ট সম্পদ প্রদান করা হত। আবার কখনো পুরোপুরি সম্পদ না দিয়ে আংশিক সম্পদ প্রদান করত। অনেক সময় এতিম বড় হয়ে নিজের সম্পদ বুঝে নেবে এমন আশঙ্কায় অভিভাবকগণ তাড়াহুড়া করেই এতিমের সম্পদ খরচ করে ফেলত। এই জাতীয় অপকৌশলের অন্তরালে অভিভাবকদের মূল দুরভিসন্ধি থাকত একটাই : এতিমকে স্বীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত এবং তার অধিকার ক্ষুণœ করা। পরবর্তীকালে কঠোর বিধি-বিধান আরোপ করে এতিমের অধিকার সংরক্ষণ এবং তার সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়। যেন কেউ কোনদিন কোনভাবে এতিমের অধিকার হরণ এবং তার সম্পদ গ্রাস করতে সাহস না পায়।
এবার ফিরে আসি জবাব-সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক আলোচনায়। জবাবে তৎকালীন নারী এতিমদের বৈবাহিক চিত্র খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। অভিভাবকগণ তাদেরকে বিবাহ করত। কিন্তু তাদের প্রতি সুবিচার করত না। অধিকার – এমনকি অনেক সময় বিবাহের মহর থেকেও বঞ্চিত করা হত। সেজন্য জবাবের শেষাংশে এতিমদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ প্রদান করে তৎপ্রতি অভিভাবকগণের সুদৃষ্টি কামনা করা হয়েছে। এছাড়া জবাবে আরেকটি বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে, ‘এতিম নারীদের ব্যাপারে কিতাবে তোমাদের নিকট যা তেলাওয়াত করা হয়’—কী সেই বিধান। এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা রা. বলেছেন, কিতাবে তোমাদের নিকট তেলাওয়াত করা হয় বলে ‘যদি তোমরা এতিমদের প্রতি সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করতে পারবে না বলে আশঙ্কা কর’—আয়াতটিকে বোঝানো হয়েছে। জবাবে আরো পরের দিকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাদেরকে বিবাহ করতে আগ্রহী হও।’ এ-কথা বলে এতিম নারীর ধন-সম্পদ ও রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ আগ্রহী অভিভাবক বোঝানো হয়েছে। যেমন : কোন কোন অভিভাবক এমন আগ্রহ এতিম কন্যার প্রতি পোষণ করত। আর যার সম্পদ কম কিংবা সে যদি কুৎসিত বা কদাকার হত, তাহলে তেমন আগ্রহী হত না। আল্লাহ এখানে প্রথমত অভিভাবকগণকে এভাবে এতিম নারীদেরকে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর বলেছেন, যদি তাদেরকে বিবাহ করতেই হয়, তাহলে তা সুবিচার এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গেই করতে হবে। অন্যথায় তাদেরকে অন্য নারীদের বিবাহ করতে বলা হয়েছে।
ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস বলেছেন, হযরত আয়েশা রা. ‘যদি তোমরা এতিমদের প্রতি সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করতে পারবে না বলে আশঙ্কা কর’— আয়াতাংশের যে-ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকেও অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। কেননা তারা দু-জনই বলেছেন, এ আয়াত এতিম মেয়ে সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যে তার অভিভাবকের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়। পরে সে অভিভাবক নিজেই এতিম মেয়ের ধন-সম্পদ রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে বিবাহ করতে ইচ্ছুক হয়। কিন্তু তাকে মহরানা প্রদানের ক্ষেত্রে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করতে পারে না। তাই তাদেরকে এরূপ এতিম নারী বিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও যদি তাকে বিবাহ করতেই হয়, তাহলে তাকে মহরানা প্রদানে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করতে হবে আবশ্যিকভাবে। আয়াতের ব্যাখ্যা যখন দুজনের নিকট একই, তাহলে তাদের দুজনের মতানুযায়ী অভিভাবকের জন্য লালিত-পালিত কন্যা বিবাহ করা জায়েযই প্রমাণিত। আগের কালের কোন মনীষী তা করতে নিষেধ করেছেন বলে আমাদের জানা নাই।
বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় অনুরূপ একটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। জনৈক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে একজন এতিম মেয়ে ছিল। সে ব্যক্তির একটি বাগান ছিল। যাতে বালিকাটিরও অংশ ছিল। সে ব্যক্তি মেয়েটিকে বিবাহ করে নিল। কিন্তু নিজের পক্ষ থেকে দেনমোহর তো আদায় করলই না উপরন্তু বাগানে মেয়েটির যে-অংশ ছিল তাও সে আত্মসাৎ করে নিল। এছাড়া আরো এক ধরনের জঘন্য কাজ তারা করত যা চরম অন্যায়, অমানবিক এবং চরম পাপ। তা হল নিজ তত্ত্বাবধানে রক্ষিত এতিম নারী যদি সুন্দরী কিংবা খুব সম্পদশালী না হত, তাহলে একে তো তারা নিজেরা তাকে বিবাহ করত না, সম্পদ অন্যের হাতে চলে যাবে এই আশংকায় অন্যত্র বিবাহও দিত না। এতিম মেয়েটিকে আজীবন এভাবেই সমাজের আপাংক্তেয় হয়ে দুর্বিষহ অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হত। এভাবে এতিমগণ বিশেষ করে নারী এতিমগণের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণœ করা হত। স্বীয় ধন-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হত। তারা জুলুম নির্যাতনের শিকার হত। সম্পূর্ণ বে-ইনসাফিতে জীবন যাপন করত। এমনি প্রেক্ষাপটে এতিম নারীদের সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফতোয়া জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে আল্লাহ তাআলা এতিম নারীদের প্রতি যুলুম-নির্যাতনের অবসান, অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণের প্রতি বিশেষ তাকিদ দিয়েই জিজ্ঞাসার জবাব প্রদান করেছেন। বিশেষ করে এতিম নারীদের বৈবাহিক জীবনের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সাধারণ আইন-কানুনের মত তা শুধু প্রশাসনের উপর ন্যাস্ত করার পরিবর্তে জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহর ভয়ভীতির অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে। তাই বলা হয়েছে, যদি ইনসাফ করতে পারবে না বলে মনে কর, তাহলে এতিম মেয়েদেরকে বিবাহ করবে না। সে ক্ষেত্রে অন্য মেয়েদেরকেই বিবাহ করে নেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অন্যের অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে যা সাধারণত দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় পড়ে এবং তা আইন প্রয়োগ করে আদায় করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, শ্রমের মজুরি, প্রভৃতি এ জাতীয় অধিকারের আওতায় পড়ে। এ সকল অধিকার যদি কোন এক পক্ষ আদায়ে ব্যর্থ হয় অথবা কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, তাহলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তার সুরাহা করা যায়। কিন্তু সন্তান-সন্ততি, নিজ বংশের অনাথ-এতিম ছেলে-মেয়ে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক অধিকার আদায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বস্তুত তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং আন্তরিকতার উপর। সুতরাং পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে একে অন্যের অধিকার আদায়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এক্ষেত্রে উঁচু-নিচু ইতর-ভদ্র আশরাফ-আতরাফ প্রভৃতি পার্থক্যের দেয়াল তৈরি করা সম্পূর্ণ অনুচিত।
এতিম নারীদের বিবাহের বিধান
এতিম নারীগণ আজীবনই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, কখনো অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে, আবার কখনো বিবাহের পর স্বামীর নিয়ন্ত্রণে থেকে তারা বঞ্চনা-লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। অভিভাবক কর্তৃক কিভাবে অধিকার ক্ষুণœ করা হত তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বিবাহোত্তর জীবনে স্বামীর নিয়ন্ত্রণে থেকে কিভাবে তাদের অধিকার ক্ষুণœ করা হত সেসম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনা করা হবে।
এতিম নারীদেরকে বিবাহ করা অভিভাবকের জন্য বৈধ। এতে কারো দ্বিমত নেই। তবে শর্ত হচ্ছে অভিভাবক অবশ্যই মুহরিম নয়, গায়রে মুহরিম হতে হবে। প্রাক-ইসলামি যুগে এতিম নারীদেরকে অধিকাংশ সময় তাদের অভিভাবকরাই বিবাহ করত। রূপ-লাবণ্য আর বিত্তবৈভব এ দুটি বিষয়ই এতিম নারী বিবাহে অভিভাবকগণকে আগ্রহান্বিত করে তুলত। নামমাত্র মহরানা দিয়ে বা না-দিয়েই বিবাহ করত। কিন্তু বিবাহিতার প্রতি খুব একটা আগ্রহ থাকত না। না তাকে ঠিকমত ভরণপোষণ দিত, আর না মহরানা আদায় করত। মীরাস থেকেও বঞ্চিত করা হত। এ সকল নারীর অসহায়ত্ব আর অক্ষমতার সুযোগ নিয়েই তাদের অধিকার ক্ষুণœ করা হত। তারা জানত যে, এ সকল মেয়ের অধিকার নিয়ে কথা বলার মত কেউ নেই। সেজন্য তারা এদের সঙ্গে যথেচ্ছা ব্যবহার করত। বিভিন্ন সহীহ হাদিস থেকে এরূপই বোঝা যায়।
ইসলাম-পূর্ব যুগে এমনকি ইসলামের প্রাথমিক যুগেও মানুষ জাগতিক বিত্ত-বৈভবের লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে কোন প্রতিবন্ধক ছাড়াই একাধিক বিবাহ করত। এ-ব্যাপারে কোন সীমা বা সংখ্যা নির্ধারণ করা ছিল না। যে যার খুশিমত যত ইচ্ছা বিবাহ করতে পারত। ধরা-বাধা কোন নিয়ম ছিল না। আর বিবাহিতার প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার অন্ত থাকত না। দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত না। অধিকাংশ সময় তাদেরকে দাসী-বাঁদীর মত করে রাখা হত, যথেচ্ছা ব্যবহার করা হত। সুবিচার কিংবা ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার কখনো তাদের প্রতি করা হত না। এরূপ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কে চরম বৈষম্য বিরাজ করত। অনেক সময় পছন্দমতই দু-একজনের প্রতি লক্ষ রেখে বাকিদের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করা হত। ইসলাম এ ধরনের সামাজিক অত্যাচার-যুলুম-নির্যাতন প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এতিম মেয়েদের বৈবাহিক জীবনের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। সাধারণ আইন-কানুনের মত কেবল প্রশাসনের উপর ন্যাস্ত করার পরিবর্তে জনসাধারণের মনে আল্লাহভীতি, দায়িত্বানুভূতি এবং বিবেকানুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে, যেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাদের অধিকার রক্ষায় এবং ইনসাফপূর্ণ ব্যবহারে ব্রতী হতে পারে।
এতিম নারীদের বিবাহের মূলনীতি ঘোষণা করে আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘যদি তোমাদের এমন আশঙ্কা হয় যে, এতিম মেয়েদের হক যথাযথ আদায় করতে পারবে না, তাহলে অন্য নারীদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দসই দুই জন, তিন জন, চার জন বিবাহ করতে পার। যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, এদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারবে না, তবে এক জনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।’ [সূরা নিসা : আয়াত ৩]
উল্লিখিত আয়াত দ্বারাই একাধিক বিবাহ বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারজন পর্যন্ত বিবাহ করা যাবে। একাধিক বিবাহ তখনই বৈধ হতে পারে যদি শরীয়ত মোতাবেক সকলের সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ আচরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সকলের অধিকার সমানভাবে রক্ষিত হবে। উপরিউক্ত শর্তসাপেক্ষেই কেবল একাধিক বিবাহ বৈধ। অন্যথায় একজন স্ত্রী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীতেই নির্ভর করতে বলা হয়েছে। এটাই ইসলামের নির্দেশ। হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক স্ত্রীর বেলায় সমতা ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশেষভাবে তাকিদ করেছেন। যারা এর বরখেলাপ করবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির সংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া তিনি নিজেও ব্যবহারিক জীবনে এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
সুতরাং যাদের পক্ষে সমতা-বিধান কিংবা ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হবে না, তাদের পক্ষে একাধিক বিবাহ না করাই উত্তম। আর আয়াত দ্বারা একথা বোঝার সুযোগ নেই যে, এতিম নারীদের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে ব্যর্থ হলে অন্য নারী যাদেরকে পছন্দ হয় তাদের মধ্য থেকে দুই জন, তিন জন, চার জন পর্যন্ত বিবাহের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। আর সেক্ষেত্রে সুবিচার এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণের প্রয়োজন নেই। যদি ব্যাপারটি তেমন হত তাহলে আয়াতের পরবর্তী অংশ, ‘যদি আশংকা কর যে স্ত্রীদের মাঝে সমতা ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না, তাহলে একজন স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাক’—কথাটি বলা হত না। সুতরাং বোঝা গেল সমতা ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ এতিম নারীদের বেলায় যেমন শর্ত, তেমনি একাধিক স্ত্রীর বেলায়ও শর্ত।
আল্লাহর বাণী—দুই দুই, তিন তিন, চার চার, অর্থাৎ দুইজনকে, তিনজনকে, চারজনকে একসঙ্গে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে পার। এ সংখ্যক স্ত্রী একসঙ্গে যে গ্রহণ করতে চাইবে তাকে অবশ্যই সুবিচার এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণ রক্ষা করতে হবে। যদি সুবিচার এবং ন্যায়পরায়ণতার বিধান মানা সম্ভব না হয় তাহলে চারজনের কম তিন জন। এতেও ভয় হলে দুই জন। তাদেরও একসঙ্গে রাখার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার বিধান মানা সম্ভব না হলে একজনেই সীমিত রাখতে হবে। তাই বলা হয় আয়াতে ‘ওয়াও’ হরফটি ‘আও’ বা অথবা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তখন অর্থ হয় দুই জন, না হয় তিন জন, আর না হয় চার জন। উপরন্তু ‘মাছনা’ (দুই) ‘ছুলাছা’ (তিন)-এর মধ্যে এবং ‘ছুলাছা’ (তিন) ‘রুবাআ’ (চার)-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ফলে আয়াতে তাদের সংখ্যা দাঁড়াল মাত্র চারজনে। ফলে এমন অর্থ হতে পারবে না যে প্রত্যেকের জন্য এ সংখ্যার সমষ্টি সংখ্যক স্ত্রী একত্র করা জায়েজ। তাহলে স্ত্রীদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় নয় জনে। এটা জায়েজ নয়। এটাই হানাফী মাযহাবের ফিকহবিদ এবং সাওরী, লাইস এবং ইমাম শাফেয়ীর অভিমত।
হাদিস শরিফে একথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হযেছে যে, সুস্থ, সবল, স্বাধীন, এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য অনূর্ধ্ব চারজন স্ত্রী এবং ক্রীতদাসের জন্য একসঙ্গে দুইজন বিবাহের অনুমতি রয়েছে। এ ব্যাপারে সমস্ত ফিকহবিদ একমত। সমগ্র উম্মতের জন্য একটাই ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা। এর ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।
যদি বলা হয় সমতা এবং ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের শর্তেই একাধিক বিবাহ বৈধ, যা সরাসরি কুরআনের আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত; কিন্তু আল্লাহ তো নিজেই অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা যতই আকাক্সক্ষা কর যে, স্ত্রীদের মাঝে সমতা রক্ষা করবে, তা কখনই পারবে না। তবে কোন একদিকে একেবারেই ঝুঁকে পড়বে না। [সূরা নিসা : আয়াত ১২৯] সুতরাং বোঝা গেল, একাধিক স্ত্রীর বেলায় সমতাবিধান এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণ খুব জরুরি নয় এবং এর ব্যতিক্রম করা দোষণীয় নয়।
এর জবাবে বলা যায়, সুবিচার এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণের শর্তেই একাধিক বিবাহ বৈধ। ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে না পারলে একজনকেই বিবাহ করতে হবে। এ মর্মে কঠোর নির্দেশ রয়েছে। এ ব্যাপারে সমস্ত তাফসিরবিদ, ফিকহবিদ আলেম-ওলামা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। একাধিক স্ত্রীর বেলায় সমতা ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ দুই ভাগে বিভক্ত হতে পারে। এক. সাধ্যায়াত্ত বিষয়, দুই. সাধ্যাতীত বিষয়। খাদ্য, পানাহার, ভরণপোষণ, মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার। এমনকি রাত্রি-যাপনের বেলায়ও পালাক্রম নির্ধারণ করে সমতা বিধান করা ওয়াজিব। এতে কোন পার্থক্য করা হলে কেয়ামতের দিন অর্ধাঙ্গ অবস্থায় উঠতে হবে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বেইনসাফি মহাপাপ। অপরদিকে প্রেম-ভালবাসা, হৃদয়ের আকর্ষণ, প্রভৃতি মানুষের সাধ্যাতীত ব্যপার। এগুলোতে পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে কোন একজনের প্রতি তার হৃদয়ের আকর্ষণ বেশি হতে পারে; এটা সাধারণত স্ত্রীর আচার-আচরণ, মর্জি-মেজাজ, স্বামী-ভক্তির উপর নির্ভর করে হয়। যা স্বাভাবিক। এটা দোষণীয় নয়। পবিত্র কুরআনের ‘তোমরা যতই আকাক্সক্ষা কর যে, স্ত্রীদের মাঝে সমতা রক্ষা করবে, তা কখনই পারবে না।…’ আয়াতটি সম্ভবত সেদিকে লক্ষ করে বলা হয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল এই সাধ্যাতীত বিষয়ে চেষ্টা করলেও সমতা বিধান সম্ভব হবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আন্তরিক আকর্ষণ, প্রেম-ভালবাসা একজনের প্রতি বেশি হলেও অপর জনকে অবজ্ঞা করা কিংবা তার প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করা জায়েয; এমন আচরণ কোনোক্রমেই জায়েয নয়। বস্তুত সাধ্যাতীত ব্যাপারেও সমতা বিধান করতে হবে এটাই সার্বিকভাবে প্রমাণিত। তারপরও পার্থক্য হবে জেনেই আল্লাহ আয়াতের শেষাংশে বলে দিয়েছেন, কোন একজনের প্রতি একেবারেই ঝুঁকে পড়বে না। এমন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যারা সাধ্যাতীত ব্যাপারে সীমালংঘন করবে তারাও পক্ষপাতদোষে দুষ্ট এবং পাপী বলে সাব্যস্ত হবে। যার ফলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। অতঃপর সাধ্যায়ত্ত ব্যাপারে সমতা বিধান লংঘনের পরিণাম যে কত ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়।
মোটকথা দুটি আয়াত দুই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রথমটি সাধ্যায়ত্ত ব্যপারে, যাতে সমতা বিধান ওয়াজিব। আর দ্বিতীয়টি সাধ্যাতীত ব্যাপারে যাতে সমতা বিধান একান্ত আবশ্যক বলে বিবেচিত হলেও তাতে কমবেশি হতে পারে বলে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সমতা বিধানের চেষ্টা করতে হবে। সুতরাং দুটি আয়াতের মর্মে কোনরূপ বৈপরীত্য নেই।
বিবাহের অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মহর। যা একান্তভাবেই স্ত্রীর অধিকার। তাই স্বামীর প্রতি নির্দেশ হল স্বচ্ছন্দ-চিত্তে মহর আদায় করা। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মহরানা স্বচ্ছন্দ-চিত্তে সাগ্রহে আদায় করে দাও। তারা যদি খুশি মনে তা থেকে তোমাদেরকে কিছু মাফ করে দেয় তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করতে পার।’ [সূরা নিসা : আয়াত ৪]
পবিত্র কুরআনের—ঐ সব পিতৃহীনা নারীদের বিধান যাদেরকে তোমরা নির্ধারিত অধিকার প্রদান কর না অথচ বিবাহ করার বাসনা রাখ—আয়াতে ‘নির্ধারিত অধিকার’ দ্বারা নারীদের মহর বোঝানো হয়েছে। বিবাহে মহর প্রদান করা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। বিবাহ কালে বর-কনে উভয়পক্ষ মিলে তার পরিমাণ নির্ধারণ করবে মাত্র। তৎকালীন যুগে এই মহর প্রশ্নেই নারীগণ সবচেয়ে বেশি জুলুম-অবিচারের শিকার হত। প্রথমত অভিভাবকগণই তা আদায় করে নিজেই আত্মসাৎ করত। নারীর প্রাপ্য এই মহর কখনই তার হতে পৌঁছাত না। দ্বিতীয়ত স্বামীরাও যথাযথভাবে মহর পরিশোধ করত না। একে জরিমানা মনে করত। তৃতীয়ত স্ত্রীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনেক স্বামী নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে মহর মাফ করিয়ে নিত। অথচ জোর-জবরদস্তিতে মাফ করলে তা প্রকৃতপক্ষে মাফ করা হয় না। এ ধরনের আরও অনেক নির্যাতন-যুলুম-পীড়নমূলক প্রথা প্রচলিত ছিল। পবিত্র কুরআন এসব জুলুম নির্যাতনমূলক প্রথা-পদ্ধতির উচ্ছেদ কল্পে স্বামীদেরকে স্ত্রীর মহরানা স্বচ্ছন্দ-চিত্তে প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। তারা মহর মাফ করুক বা না করুক। বস্তুত এটা স্বামীর উপর পরিশোধ্য ফরজ। কাতাদা ইবনে জুরাইয থেকে বর্ণিত আছে, ‘তাদের মহরানা স্বচ্ছন্দ-চিত্তে সাগ্রহে আদায় করে দাও’—এর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, ফরজ মনে করে মহরানা আদায় করে দাও। তারা ‘নিহলাহ’ শব্দের অর্থ যা বলেছেন আসলে তার অর্থ তা-ই, অর্থাৎ তা ফরজ।’
আবু উবায়দা, মামার ইবনুল মুসান্না বলেছেন, ‘নিহলাহ’ শব্দের অর্থ সন্তুষ্টচিত্তে। আবার কোন কোন মনীষী বলেছেন মহরানাকে ‘নিহলাহ’ বলা হয়েছে, আর ‘নিহলাহ’-এর অর্থ দান, হিবা।
মহরানাকে নিহলাহ নাম দেয়া হয়েছে এজন্য যে তার বিনিময়ে স্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন কিছু প্রদান করা হয়নি স্বামী যার মালিক হবে। তাই যে-নিহলার কোন বিনিময় নাই, প্রকৃতপক্ষে তা দান বিশেষ।
বস্তুত ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে মহরানা সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করে দাও’—এটা আল্লাহর নির্দেশ। যা পালন করা স্বামীদের জন্য ফরজ। মহর যেমন ফরজ তেমনি বিবাহের পর স্ত্রীর মহরানা আদায় করাও ফরজ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, অন্যান্য ফরজ ঋণ যেভাবে সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করা হয়, সেভাবে সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীর মহরানা আদায় করতে কমই দেখা যায়।
‘স্বামীদের প্রতি স্ত্রীর মহরানা সন্তুষ্টচিত্তে প্রদান কর’—এই নির্দেশের পর পর বলা হয়েছে, যদি তারা সন্তুষ্টচিত্তে কিছু ক্ষমা করে দেয় তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করতে পার। কাতাদা বলেছেন, তার অর্থ কোনরূপ জোর-জবরদস্তি ও ফুসলানো ছাড়াই তাদের সন্তুষ্টচিত্তে ক্ষমা করে দেয়া। আর তা স্বামীর জন্য হালাল। আলকামা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, আমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে কিছুটা ভোগ করার সুযোগ দাও। সুতরাং বোঝা গেল মহরানা স্ত্রীর সম্পদ। সে তা স্বামীর নিকট থেকে পাওয়ার অধিকারী। স্ত্রী সেই মহর স্বামীকে হিবা বা দানও করতে পারে বা তাতে কিছু কমও করতে পারে। এর জন্য মহর হস্তগত হওয়া আবশ্যক নয়। হাতে পেয়েও হিবা করতে পারে। আবার হস্তগত হওয়ার পূর্বেও তা হিবা করতে পারে। কারণ, আল্লাহ তাআলা হাতে পাওয়া বা না পাওয়া এ ব্যাপারে কোনরূপ পার্থক্য করেন নি।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, এসবের বাইরে যারা আছে, তা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তোমরা তা তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে কামনা করবে। [সূরা নিসা : আয়াত ১৪]
এতে এই কথার দলিল রয়েছে যে, বিবাহের মহরানা এমন কিছু হতে হবে, যাকে মাল বা সম্পদ বলা হয়। যা মাল বা সম্পদ বলে বিবেচিত হয় না তা মহর হওয়ার যোগ্য না। মহরের পরিমাণ নিয়ে ফিকহবিদগণ বিভিন্ন রকম মত ব্যক্ত করেছেন। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, দশ দিরহামের কম মহর হয় না। এটাই আবু হানিফা, আবু ইউসুফ, যুফার এবং হাসান বিন যিয়াদ প্রমুখের অভিমত। আবু সাঈদ খুদরী, হাসান, সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব ও আতা রহ. বলেছেন, বিবাহ কম মহরানাতেও হয় বেশি মহরানাতেও হয়। আবদুর রহমান বিন আউফ রা. এক দানা পরিমাণ ওজনের স্বর্ণের মহরানা দিয়ে বিবাহ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, সেই একদানা পরিমাণ স্বর্ণের মূল্য তিন দিরহাম ও এক দিরহামের এক তৃতীয়াংশ ছিল। অন্যরা বলেছেন, একদানা স্বর্ণ দশ কিংবা পাঁচ দিরহামের মূল্য হয়। ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, স্বল্পতম পরিমাণের মহর হচ্ছে এক দিনারের চার ভাগের এক ভাগ। বড় বড় ফিকাহর কিতাবসমূহে মহর-সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সেদিকে আর অগ্রসর হলাম না। ফিরে আসছি মীরাস-সংক্রান্ত আলোচনায়।
আবু বকর রা. বলেছেন, জাহেলিয়্যাতের জামানায় লোকেরা দুটি জিনিসের ভিত্তিতে পরস্পর মীরাস দেয়া-নেয়া করত। একটি হচ্ছে বংশ অপরটি হচ্ছে কারণ। বংশের দিক দিয়ে যে-মীরাস দেয়া-নেয়া হত তাতে ছোটরা এবং মেয়েরা কোন মীরাস পেত না। মীরাস পেত সেসব পুরুষ, যারা অশ্বের পিঠে সওয়ার হয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করত এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লুট করত। অবশেষে এদের মীরাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসূল! লোকেরা আপনার নিকট মেয়েদের ব্যাপারে ফতোয়া চায়। আপনি বলুন, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ফতোয়া দিচ্ছেন…সন্তানদের মধ্যে যারা দুর্বল অক্ষম …। [সূরা নিসা : আয়াত ১২৭] আয়াতটি নাযিল করেন। জাহেলিয়্যাতের সময় তাদের বিবাহ, তালাক, মীরাস প্রভৃতি যে পদ্ধতিতে বণ্ঠন করা হত রাসূল সা.-এর আগমনের পরও সেই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে।
শেষ পর্যন্ত ইসলামী শরীয়তের দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। এ সময় তাদের মীরাস বণ্ঠনের নিয়ম এই ছিল যে, তারা তাদের মধ্যকার যোদ্ধা ধরনের যুবকদেরকে মীরাস দিত। ছোট বয়সের ছেলে-মেয়ে এবং মেয়েদেরকে মীরাসের অংশ দিত না। এই অবস্থায় আল্লাহ মীরাসের আয়াত নাযিল করলেন। নারীদের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়ে বর্ণিত হল, একজন পুরুষ দুজন মেয়ের অংশ প্রাপ্য হবে।
আর তাৎক্ষণিক কারণের দিক দিয়ে দুটি কারণে তারা পরস্পরকে মীরাসের অংশ দিত। একটি হচ্ছে শপথ ও পারস্পরিক চুক্তি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে পালকপুত্র গ্রহণ।
জাহেলিয়্যাতের জামানায় এক ব্যক্তির জন্য আরেক ব্যক্তি শপথ করত। ফলে সে তার অধীন হয়ে যেত। সে যখন মরে যেত, তখন মীরাস তার পরিবারবর্গ ও নিকট আত্মীয়দের জন্য হত। এ-ব্যাপারে আল্লাহ নাযিল করলেন, ‘আর যাদের সঙ্গে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। আল্লাহ তাআলা নিঃসন্দেহে সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন।’ [সূরা নিসা : আয়াত ৩৩] তখন থেকে যাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করা হত তাদের প্রাপ্য দিয়ে দেয়া হতে থাকে।
সে-যুগে এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হত। তখন বলত, আমার রক্ত তোমার রক্ত এবং আমার ধ্বংস তোমার ধ্বংস। তুমি আমার ওয়ারিস হবে, আমি তোমার মীরাস পাব। তুমি আমার জন্য দাবি তুলবে, আমি তোমার জন্য দাবি তুলব। তারা সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ এর জন্য নির্ধারণ করত। পরে আল্লাহ উল্লিখিত বিধানকে রহিত করে দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত যারা আত্মীয় আল্লাহর বিধানমতে তারা পরস্পর বেশি হকদার।’ [সূরা আনফাল : আয়াত ৭৫]
আগের কালের ফিকাহবিদ বলেছেন, শপথকারীর মীরাস ইসলামের ঐতিহ্য অনুযায়ী চালু ছিল। জাহেলিয়্যাতের প্রথা অনুযায়ী তারা যে অঙ্গীকারাবদ্ধ হত সে হিসাবে নয়। আর তা চলছিল মীরাস সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়া পর্যন্ত। পরে তা রহিত করা হয়।
মৌখিক দাবি ও পালকপুত্র গ্রহণের মাধ্যমে মীরাসের অংশ দেয়ার ব্যাপারটি এরূপ ছিল যে, সে-কালে অন্য একজনের পুত্রকে নিজের পুত্র বানাত। জন্মদাতা পিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে পালকপুত্রের বংশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত। নিজেকে সে সেই বংশের অধঃস্তন প্রমাণ করত। আর সেই হতো তার উত্তরাধিকারী। ইসলাম আগমনের পরও তা চালু ছিল। রাসূল সা. উবায়দা বিন হারিসকে পালক নিয়েছিলেন। এজন্য তাকে জায়েদ বিন মুহাম্মদ ডাকা হত। পরে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারোরই পিতা নন।’ [সূরা আহযাব : আয়াত ৪০]
আবু হুযায়ফা ইবনে উতবা সালিমকে পালকপুত্র বানিয়েছিলেন। তাই তাকে ডাকা হত সালিম ইবনে আবু হুযায়ফা। পরে আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘তোমরা তাদেরকে জন্মদাতা পিতার পুত্র হিসেবে ডাক। আল্লাহর নিকট তাই ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতাকে না জান তাহলে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই এবং বন্ধু।’ [সূরা আহযাব : আয়াত ৫]
জুহরি উরওয়া ও হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, এর ফলে পালকপুত্রকে পুত্র ডাকার রীতি বাতিল হয়ে গেল এবং তাকে মীরাস দেয়ার রীতিও বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে ইসলাম আগমনের পর কালের ¯্রােতধারার সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে তারা অনেক কিছুই ত্যাগ করেছে। অনেক কিছু রহিত ও বাতিল ঘোষণা করেছে।
ইসলামে মীরাসী আইন দুটি জিনিস দ্বারা প্রবর্তিত। এক. বংশীয় সম্পর্ক। দুই কারণ। বংশীয় সম্পর্কের দরুন যে মীরাস প্রাপ্য হয় তা-ই আল্লাহ তার কিতাবে বিধিবদ্ধ করেছেন। বংশীয় ভিত্তিতে মীরাস দেয়া হয় তিন প্রকার ব্যক্তিবর্গকে, সুনির্দিষ্ট অংশীদারগণ, আসাবা এবং যাবীল আরহামগণ। আর কারণগত যে মীরাস দেয়া হত তা বিভিন্ন ধরনের ও প্রকারের ছিল। যেমন, শপথভিত্তিক চুক্তি, পালকপুত্র বানানো, ভ্রাতৃত্ব—যে-ভ্রাতৃত্ব রাসূল সা. আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হিজরত, বৈবাহিক সম্পর্ক, মুক্তিদান, চুক্তি, বন্ধুত্বের চুক্তি প্রভৃতি। অবশ্য পরে এগুলো বিভিন্ন কারণে অবস্থার প্রেক্ষিতে ক্রমান্বয়ে রহিত হয়ে যায়।
মীরাস দেয়ার তৎকালীন সনাতন যে-রেওয়াজ ছিল, অর্থাৎ যোদ্ধারা মীরাস পাবে, মেয়েলোক এবং ছোটরা মীরাস পাবে না, তা বাতিল করে নারীর জন্য মীরাসের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা-সম্বলিত আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়। ‘পুরুষদের জন্যও নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে পিতা-মাতা এবং নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পদে এবং মেয়েদের জন্যও নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পদে। [সূরা নিসা : আয়াত ৭]
এই আয়াত দ্বারা নারীদের মীরাস প্রমাণিত হল। মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ইবনে উকায়ল, জারির বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, আনসার বংশের একজন মহিলা তার দুটি কন্যাসন্তানসহ রাসূল সা.-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ দুটি সাবিত ইবনে কায়েসের কন্যা। সাবিত আপনার সঙ্গে উহুদ যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছে। ওদের চাচা ওদের জন্য রক্ষিত সকল সম্পদ নিয়ে গেছে। হে আল্লাহর রাসূল! এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? তখন রাসূল সা. বলেন, আল্লাহই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা দেবেন। অতঃপর নাযিল হয়, ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে ফয়সালা দিচ্ছেন যে, পুত্রসন্তান দুইজন কন্যাসন্তানের সমান অংশ পাবে। [সূরা নিসা : আয়াত ১১]
এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূল সা. মেয়ে-লোকটিকে এবং তার সঙ্গীকে তার নিকটে ডেকে আনতে বললেন। তারা উপস্থিত হলে তিনি মেয়েদর চাচাকে বললেন, এ মেয়ে দুটিকে মোট সম্পদের তিন ভাগের দু ভাগ দিয়ে দাও। আর ওদের মাকে দাও আট ভাগের এক ভাগ। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা তোমার জন্য।
অনুরূপ আরেকটি জিজ্ঞাসা, হযরত জারির রা.-ও রাসূল সা.-কে প্রশ্ন করেছিলেন, সেখানেও তিনি সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে ওহীর অপেক্ষায় মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন। পরে যখন আয়াতটি নাযিল হয় তখন তাতে দুজনেরই জিজ্ঞাসার জবাব বিবৃত হয়। এভাবে ইসলাম জাহেলি যুগের প্রবর্তিত জুলুম-নির্যাতনমূলক প্রথা-পদ্ধতি রহিত করে অধিকার-বঞ্চিত নির্যাতিত নারী ও শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করল। চিরস্থায়ী এসব বিধান কোনক্রমেই লংঘনীয় নয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের ব্যাপার এই যে, বর্তমান যুগে এসেও জাহেলী যুগের প্রেতাত্মারা নারীদের এসব বিধান বদলে দেয়ার পায়তারা করছে। স্পষ্ট ভাষায় ওদের জানিয়ে দিতে চাই আল্লাহর গজব ওদের জন্য অপেক্ষা করছে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়।
লেখক: মাওলানা মুজিবুর রহমান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন