মক্কায় অবরুদ্ধ তিন বছর

 

মক্কায় অবরুদ্ধ তিন বছর

হাবশায় হিজরতকারী মুসলিমদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থতা এবং ওমর ও হামজা (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় মক্কার মুশরিকরা বড় ধাক্কা খায়। ফলে তারা ইসলামের অভ্যুত্থান ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারই অংশ হিসেবে মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আল্লাহ মুশরিকদের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলেন, ‘তারা কি কোনো ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? বরং আমিই তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৭৯)

অন্যদিকে মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে চাচা আবু তালিব বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিবের সহযোগিতা কামনা করেন। তারা আবু তালিবের ডাকে সাড়া দেয়। ফলে মক্কায় রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই সংঘাত থেকে বাঁচতে মুশরিকরা বনু হাশিমের কাছে দাবি জানায়, তারা যেন মুহাম্মদ (সা.)-কে স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দেয়। বনু হাশিম তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে মুশরিকরা সর্বাত্মক বয়কটের আহ্বান জানায়। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১২৭)

ঐতিহাসিদের মতে, নবুয়তের অষ্টম বছর মহররম মাসে বয়কট শুরু হয়। তবে সপ্তম বছর বলেও মত রয়েছে। ইমাম জুহরি (রহ.) লেখেন, ‘মুশরিকরা তাদের স্বভাবমতো মুসলিমদের ওপর কঠোর হলো। ফলে মুসলিম কষ্টে পড়ে গেল এবং তাদের সংকট বৃদ্ধি পেল। কুরাইশ মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রকাশ্যে হত্যার ষড়যন্ত্রে একমত হলো। আবু তালিব পরিস্থিতি দেখে বনু মুত্তালিব ও বনু হাশিমকে একত্র করলেন। তাদের নির্দেশ দিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে তাদের উপত্যকায় প্রবেশ করতে এবং যারা তাঁকে হত্যা করতে চায় তাদের প্রতিহত করতে। ...তাদের মুসলিম ও অমুসলিম সবাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রক্ষার ব্যাপারে একমত হলো। মুসলিমরা তা করেছে ঈমান ও বিশ্বাসের অংশ হিসেবে এবং অমুসলিমরা তা করেছে গোত্রীয় সম্প্রীতির অংশ হিসেবে। কুরাইশ যখন জানতে পারল মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশ তাঁকে রক্ষা করতে একতাবদ্ধ হয়েছে, তখন তারাও এ কথার ওপর ঐক্যবদ্ধ হলো যে মুহাম্মদ (সা.)-কে তাদের হাতে অর্পণ না করা পর্যন্ত তারা বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক, আর্থিক লেনদেন এবং তারা তাদের ঘরে প্রবেশ করবে না।’ (খাতামুন-নাবিয়্যিন, পৃষ্ঠা ৩৭৬)

মুশরিকদের অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল, ‘তারা তাদের কোনো কন্যা বিয়ে করবে না এবং তাদের কাছে বিয়ে দেবেও না, কোনো বেচাকেনা করবে না, জীবন-জীবিকার কোনো কিছু পৌঁছাতে দেবে না, কোনো আপস প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না, কোনো ধরনের নম্রতা প্রদর্শন করা হবে না, পরস্পর মেলামেশা-বৈঠক-কথাবার্তা পরিহার করা হবে, তাদের ঘরে প্রবেশ করবে না।’ (ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ১৮২)

বনু হাশিমের মধ্যে শুধু আবু লাহাব মুশরিকদের পক্ষাবলম্বন করে। মক্কার মুশরিকদের পক্ষে অঙ্গীকারনামা লেখে বোগাইজ ইবনে আমের। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বদদোয়ায় তার আঙুল অবশ হয়ে যায়। লেখার পর অঙ্গীকারনামা কাবা প্রাঙ্গণে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১২৮)

কুরাইশের সম্মিলিত ও সর্বাত্মক অবরোধের কারণে পাহাড়ের উপত্যকায় অমানবিক জীবন কাটাতে বাধ্য হয় বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিব। ক্ষুধার যন্ত্রণায় শিশুদের চিৎকার রাতের বেলা মরুভূমিতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। মানুষ গাছের পাতা খেয়ে দিন যাপন করত। নিষিদ্ধ মাস ও হজের মৌসুম ছাড়া অবরুদ্ধ লোকেরা উপত্যকা ছেড়ে বের হতো না। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে সবার সঙ্গে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেন এবং এর মধ্যেই দ্বিনের প্রচার চালিয়ে যান; হজ মৌসুমে তিনি সবার সঙ্গে বের হতেন এবং হাজিদের দিনের দাওয়াত দিতেন। অবরুদ্ধ সময়ে মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তার চিন্তায় হামজা (রা.) দেহরক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং রাতের সবাই ঘুমিয়ে গেলে আবু তালিব তাঁর বিছানা পরিবর্তন করে দিতেন, যেন কোনো আততায়ী মহানবী (সা.)-কে হত্যার সুযোগ না পায়। তিন বছর বা তার চেয়ে কিছু কম সময় সম্মিলিত এই অবরোধ চলতে থাকে। এ সময় আবু তালিব ও খাদিজা (রা.) তাঁদের সহায়-সম্পদ জনকল্যাণে বিলিয়ে দেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৫০-৩৫৩; আর-রাসুল, পৃষ্ঠা ৯০)

 

গ্রন্থনা : আতাউর রহমান খসরু

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট