জান্নাতে প্রবেশ করা সর্বশেষ ব্যক্তি

 জান্নাতে প্রবেশ করা সর্বশেষ ব্যক্তি

-----------------------------------------

আমরা চমৎকার একটি হাদিসের কথা জানি। একেবারে সবার শেষে যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাকে নিয়ে। এ হাদিসটি সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে। বর্ণনা করেছেন প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা)। তিনি বলেন— রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, "একদম সবার শেষে এমন এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে হামাগুড়ি দিয়ে জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার গেইটের দিকে এগিয়ে আসবে। সে একবার চলবে, একবার হোঁচট খাবে; আবার চলবে আবার পড়ে যাবে, তবু সে হাঁটতে থাকবে। বার বার আগুন এসে তাকে ঝলসে দেবে। অবশেষ যখন সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে... " তো, তাকে বলা হয়েছে যে, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। একেবারে সর্বশেষ ব্যক্তি। এখন, সে শাস্তির ঐ এলাকা থেকে হেঁটে বের হয়ে আসছে। আর এই হেঁটে আসাটা সহজ হেঁটে আসা নয়। দীর্ঘদিন যাবত শাস্তি ভোগ করার পর এখন তাকে হাঁটার সামর্থ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, শেষ সীমানা অবধি পৌঁছা পর্যন্ত তো তাকে কষ্ট করতে হবে। পরিশেষে, ঐ এলাকা অতিক্রম করে আসার পর সে পেছনে ফিরে বলবে—"তাবারাকাল্লাজি নাজ্জানি মিনকা- কত বরকতময় সে সত্তা! যিনি আমাকে তোমার থেকে নাজাত দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে এমন আশীর্বাদ দান করেছেন যা পূর্বাপর কাউকে দান করেননি।" অর্থাৎ, কী সেই আশীর্বাদ? আমিই শেষ ব্যক্তি! এখন, যারা বাকি আছে খালাছ! তারা চিরকাল এবং চিরতরের জন্য সেখানে অবস্থান করবে। সুতরাং, এই লোকটি ব্যাপারটা জানবে যে সে-ই জাহান্নাম থেকে বের হওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি। তো, সে মাত্র বের হয়ে আসলো। অবশ্যই, জাহান্নামে থাকাবস্থায় তার একমাত্র দুয়া ছিল— "ও আল্লাহ! আমাকে এখান থেকে বের করে নিন। ও আল্লাহ! আমাকে এখান থেকে বের করে নিন। ও আল্লাহ! আমাকে এখান থেকে বের করে নিন।" এখন দুয়া কবুল হলো। সে শেষ ব্যক্তি। দুয়া কবুল হওয়াতে সে এখন জাহান্নামের বাহিরে। অতঃপর সে দূরে একটি গাছ দেখতে পাবে। তখন সে আল্লাহর নিকট আরেকটি দুয়া করবে। সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে ঐ গাছের নিকটবর্তী করুন, যেন আমি বসতে পারি এবং তার ছায়া গ্রহণ করতে পারি ও আশ-পাশ থেকে পানি পান করতে পারি।' আচ্ছা প্রথম দুয়াটি ছিল, আমাকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিন। তাকে বের করা হলো। এখন, সে জান্নাতের বাহিরের কোনো এক জায়গায় একটি গাছ দেখতে পেল। এটা এমন একটা এলাকা যেখান থেকে জান্নাতের দিকে যাওয়া যায়। কিন্তু, তবু জায়গাটা জান্নাত থেকে বহু দূরে। এই মুহূর্তে সে শুধু একটি গাছ দেখতে পাচ্ছে। সে বলল— ও আল্লাহ! আমাকে ঐখানে যেতে দিন। তখন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলবেন— আমি তোমাকে এটা দান করলে যদি তুমি আরও কিছু চাও? লোকটি বলবে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ও আল্লাহ! আমি কথা দিচ্ছি যে আমি শুধু এটাই চাই। রাসূলুল্লাহ (স) হাদিস বলার সময় আমাদের নিকট ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই ওয়াদা ভঙ্গ করার কারণে আল্লাহ তাকে ছাড় দিবেন। সে এটা ভঙ্গ করতে যাচ্ছে। আল্লাহ জানেন। আর আল্লাহ তাকে ছাড় দিবেন। কারণ, আল্লাহ জানেন লোকটির ধৈর্য বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা এমনই। "খুলিকাল ইনছানু দয়িফা- মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।" আমাদের ঐ ধৈর্য নেই। কখনো কোনদিন কস্মিনকালেও এভাবে বলবেন না যে, "হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে শুধু অমুক জিনিস চাই আর কিছু চাই না।” কারণ, প্রতিটি মিলিসেকেন্ডে আমাদের আল্লাহকে দরকার। আল্লাহর কাছ থেকে আমরা কোনদিন প্রয়োজনমুক্ত হয়ে যাব না। আমাদের সব সময় আল্লাহকে দরকার। আল্লাহর নিকট আমাদের প্রয়োজনগুলো চাওয়ার মধ্যেই আমাদের সম্মান নিহিত। আল্লাহর নিকট আমাদের নিঃস্ব অবস্থার মাঝেই আমাদের ঐশ্বর্য নিহিত। কখনোই বলবেন না "ও আল্লাহ আমি শুধু ওই জিনিসটা চাই আর কিছু চাই না।" না। বরং বলুন "ও আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আরো চাই, আরো চাই এবং আরো চাই। আপনি যা কিছু আমাকে দিবেন আমি তার সবকিছু আপনার কাছে চাই। কারণ, আমি হলাম ফকির আর আপনি হলেন ধনী।" কিন্তু, এ লোকটি এসব জানতো না। সে হলো সবার শেষে জাহান্নাম থেকে বের হওয়া ব্যক্তি। দুনিয়াতে থাকাবস্থায় লোকটি হাদিস বা ইসলামী শিক্ষা অর্জনে তো আর সময় ব্যয় করেনি। তার জীবনে সে যাই করেছে...খালাস! সে-ই জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি। তো, সে আল্লাহকে বলবে- ও আল্লাহ! আমি আপনাকে ওয়াদা দিচ্ছি, এটা ছাড়া আর কিছু চাইবো না। অতঃপর, আল্লাহ তাকে অনুমতি দিবেন। তখন সে গাছের দিকে হেঁটে যাওয়ার সামর্থ্য লাভ করবে। এরপর সে গাছের ছায়ায় গিয়ে বসবে। সে তার এ বিশ্রাম উপভোগ করবে, পানি পান করবে এবং ছায়ায় কিছু কাল অবস্থান করবে। সে এখন এই গাছের ছায়া উপভোগ করছে এবং চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। তারপর সে এর চেয়েও সুন্দর আরেকটি গাছ দেখতে পাবে। এটার চেয়ে বড়। তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণে রেখে সে চুপ করে থাকবে, কিছু বলবে না। কিন্তু, কতক্ষণ? কত দশক? কত লক্ষ বছর সে চুপ করে থাকবে? অতঃপর সে বলবে- ও আমার রব! আমাকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে দিন। আল্লাহ তখন বলবেন— ও আদম সন্তান! তুমি কি আমাকে কথা দাওনি যে আমি যদি তোমাকে এই গাছের নিকটবর্তী করি তুমি আর কিছু চাইবে না? লোকটি তখন বলবে— ইয়া রব! আমাকে শুধু ঐ গাছটির কাছে যেতে দিন, আমি কথা দিচ্ছি এরপর আর কিছু চাইবো না। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে যেতে দিবেন। রাসূল (স) বলেছেন আবারো আল্লাহ তাকে ছাড় দিবেন। কারণ, আল্লাহ জানেন চুপ থাকার মত ধৈর্য লোকটির নেই। তো, লোকটি তখন দ্বিতীয় গাছটির নিকটে যাবে। সে গাছটির ছায়ায় বাস করবে। এর ফল আহার করবে এবং পাশ থেকে পানি পান করবে। এরপর সে জান্নাতের সীমানার বাহিরে আরেকটি গাছ দেখতে পাবে এবং জানবে যে ঐ গাছটির পরেই জান্নাত। আর গাছটা এমনকি এটার চেয়েও সুন্দর। প্রসঙ্গত কিছু কিছু বর্ণনায় এরকম দশটি গাছের উল্লেখ আছে। আর কিছু বর্ণনায় তিনটি গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মূল পয়েন্ট হলো— অগ্রসর হতে থাকো, অগ্রসর হতে থাকো এবং অগ্রসর হতে থাকো। অবশেষে সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক সুন্দর একটি গাছ তার দৃষ্টিগোচর হবে। আর ঐ গাছটির পরেই জান্নাতের গেইট দেখা যাবে। সে প্রতিবার আল্লাহকে ওয়াদা দিচ্ছে— আর কিছু চাইবো না, আর কিছু চাইবো না, আর কিছু চাইবো না। অবশেষ সে যখন শেষ গাছটির নিকটে যাবে, সে এখন জান্নাতিদের হাসির শব্দ শুনতে পাবে। জান্নাতের নদীগুলোর কলকল ছলছল শব্দ শুনতে পাবে। জান্নাতের সুঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগবে। আপনাদের কী মনে হয়? কতক্ষণ সে চুপ করে থাকবে? কত সময় শেষ গাছটির ছায়ায় অবস্থান করতে পারবে? একটার পর আরেকটা প্রতিজ্ঞা করার পর। সম্ভবত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট দশটি প্রতিজ্ঞা করার পর। আর প্রতিবার সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট ওয়াদা করছে আর কিছু চাইবে না। কিন্তু এখন সে আক্ষরিক অর্থেই একেবারে জান্নাতের গেইটে। আক্ষরিক অর্থেই এ মানুষটি জান্নাতে প্রবেশ করা সর্বশেষ ব্যক্তি। অতএব, সে আল্লাহর নিকট হাত উত্তোলন করে বলবে—"ও আমার রব! আমাকে শুধু জান্নাতে প্রবেশ করতে দিন।" শুধু ঢুকতে দিন। আদখিলনিইহা। তখন, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলবেন— হে বনি আদম, কীসে আমাকে তোমার থেকে নিষ্কৃতি দিবে? কোন জিনিস তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। তুমি কি সন্তুষ্ট হবে যদি আমি তোমাকে সমগ্র দুনিয়া এবং তার সমান দান করি? তুমি কি সুখী হবে যদি আমি তোমাকে গোটা দুনিয়ার সমস্ত আশীর্বাদ...(ভাবতে পারেন?) সমগ্র পৃথিবীর সকল আশীর্বাদ এবং এর মত আরেকটি পৃথিবীর সমান দিলে তুমি কি খুশি হবে? এটা শুনে লোকটা বিরক্ত হয়ে উঠবে। ও আমার রব! আপনি কি আমার সাথে কৌতুক করছেন? আর আপনি হলেন রব্বুল আলামিন। আপনি কি মজা করছেন? আপনি মজা করছেন! আর আপনি হলেন আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা। আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন যে আপনি আমাকে সমগ্র দুনিয়া দান করবেন? যে সাহাবী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ ইবনে মাসউদ (রা) হাসতে শুরু করলেন। তিনি তার ছাত্রদের বললেন— জানো, কেন আমি হাসছি? তারা বলল— কেন? যখন রাসূল (স) হাদিসটি বর্ণনা করছিলেন তখন তিনিও হেসেছিলেন। সেসময় তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন জানো, কেন আমি হাসছি? তারা বলল— কেন? রাসূল (স) বললেন— কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই লোকটির অধৈর্য দেখে হেসে দিবেন এবং লোকটির নিরাশা দেখে। যখন লোকটি বলবে আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন, আর আপনি হলেন মহাবিশ্বের রব। এরপর আল্লাহ উত্তর দিবেন— আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না। আমি কৌতুক করছি না। আমি যা ইচ্ছা তাই করার সামর্থ্য রাখি। তোমার জন্য এই পৃথিবী এবং এর সমান আরও দশটি পৃথিবীর মত জান্নাত রয়েছে। আর এটা হবে সবার শেষে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে তার পুরস্কার। প্রিয় মুসলিম! ব্যাপারটা নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন। আজকের আলোচনার জন্য এটাই শেষ হাদিস। এটা নিয়ে চিন্তা করুন। আমরা এই জীবনে দুনিয়ার একশ মিনিয়ন ভাগের একভাগ চাই। এটা পেলেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাবো। আমরা যদি সবচেয়ে ক্ষুদ্রমত অংশ পাই। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি কত টাকার মালিক? কয়েক বিলিয়ন ডলারের মালিক। তাদের লাইফ স্টাইলের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ভাবতে পারেন, গোটা দুনিয়া, সমগ্র পৃথিবী এবং সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত ভোগ বিলাস এবং তার সাথে আরও দশগুণ। আমাদের মন এমনকি তা কল্পনাও করতে পারে না। আমাদের চিন্তার গতি স্তব্দ হয়ে যায়। আর আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে প্রবেশকারী এই শেষ ব্যক্তিকে বলবেন— এর সবকিছুই তোমার জন্য। আপনাদের কী মনে হয়? তাহলে যারা উপরের লেভেলের জান্নাতে যাবে তারা কী পাবে? ফিরদাউস কেমন হবে কল্পনা করতে পারবেন? এই লোকটি দুনিয়ার আনন্দের মত জান্নাত পেল। আর আমরা দুনিয়ার আনন্দ বুঝতে পারি। আমরা দুনিয়া দেখি, দুনিয়ার মৌজ-মাস্তি বুঝি। আর এটা চমৎকার! কিন্তু, তার উপরের মানুষেরা যারা উচ্চ লেভেলের জান্নাত পাবে, সেখানে থাকবে- مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ - "যা কোনো চক্ষু কখনো দেখেনি, কোনো কান কোনোদিন শুনেনি এবং কোনো অন্তঃকরণ কখনো কল্পনাও করেনি।” শব্দ দিয়ে সেসব জান্নাতের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সেসব উঁচু পর্যায়ের জান্নাত বর্ণনা করার জন্য কোনো শব্দ আমাদের জানা নেই। তো, এই লোকটা দুনিয়া পেল। আর আমরা দুনিয়ার আনন্দ বুঝি। কিন্তু, উঁচু ধাপের জান্নাতে যারা যাবে তারা এমনসব জিনিস পাবে যা কোনো চক্ষু কোনোদিন দেখেনি, কোনো কান কোনোদিন শুনেনি এবং কোনো অন্তঃকরণ কখনো কল্পনাও করেনি।” আমাদের কেউ কেউ এই হাদিস শোনার পর বলবে— আমি যদি এই সর্বশেষ ব্যক্তিটিও হতে পারি তবু আমি খুশি। আমি তখন বলি— কেন? কেন? এটা কেন আপনার লক্ষ্য হবে? সর্বোচ্চ ধাপের জান্নাত পাওয়ার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস হওয়া উচিত আপনার অভীষ্ট লক্ষ্য। এরপর ইনশাআল্লাহু তায়ালা এর জন্য কাজ করে যান। তখন হতে পারে, জাস্ট হতে পারে আপনি সর্বোচ্চটা হয়তো পেলেন না কিন্তু অনেক অনেক উঁচু লেভেলের একটা তো পাবেন। নিচু লক্ষ্য রাখবেন না। লক্ষ্য উঁচু করুন। এবং আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদের ফিরদাউসুল আ'লার অধিবাসী করে নেন। ইনশাআল্লাহু তায়ালা, আবার দেখা হবার প্রত্যাশায় বিদায় নিলাম। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। —শায়েখ ইয়াসির কাদি।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট