আরবদেশে মূর্তিপূজার শুরু কিভাবে হয়েছিল?

 


আমাদের আশে-পাশে আমরা অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন দেখতে পাই যারা মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে, একসময় হয়ত ইসলাম পালনও করত, কিন্তু সময় যেতে যেতে একসময় সে তার ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, এমন কি অনেক ক্ষেত্রে এখন তারা ইসলাম বিরোধী পর্যন্ত হয়ে গেছে। ধর্ম থেকে এহেন বিচ্যুতি শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যেই দেখা যায় না, অনেক সময় এমনকি পুরো জাতির মধ্যে দেখা যায়।

মানুষের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণ আমরা সিরাতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে জানতে পারি। আর সেটা হলো – কুরাইশরা যেভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে মূর্তিপূজা শুরু করেছিল।

যেই মক্কায় ইব্রাহিম(আ) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল(আ) ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল, যেখানে পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্র ঘর কা’বা নির্মান করা হয়েছে, যে কা’বাকে ঘিরে দীর্ঘকাল ধরে হজ্ব পালন হয়ে আসছে, সেই পবিত্র শহর মক্কার মানুষেরা এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিপূজার শুরু করেছিল কিভাবে? আমরা যখন এই ইতিহাসটা জানব, তখন আমাদের জন্য বুঝা সহজ হয়ে যাবে যে মানুষ কিভাবে সঠিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়।

আরবজাতির মূর্তিপূজা ও কুসংস্কারমূলক প্রথাগুলির শুরু হয়েছিল রাসূলুল্লাহ(সা) এর আগমনের প্রায় ৫০০ বছর আগে (আনুমানিক খ্রিষ্টাব্দের ১ম শতকে)। আর যার হাত ধরে এর সূত্রপাত, তার নাম আমর ইবনে লুহাই আল খুজা’ঈ (মুসলিমে বর্ণিত হাদিস)।

আমর ইবনে লুহাই একবার সিরিয়া ভ্রমণে গিয়েছিল। সেখানে তখন আমালিক (amalekites) নামে এক জাতি থাকত। এই আমালিকরা গঠনে-গড়নে খুব লম্বা-চওড়া ছিল আর তারা সভ্যতার মানদন্ডেও  আরবদের থেকে উন্নত জাতি ছিল। আমর ইবনে লুহাই দেখল যে আমালিকরা মূর্তির পূজা করছে।

আমর ইবনে লুহাই আমালিকদের জিজ্ঞেস করল – “এই মূর্তিগুলো কি?”

তারা জবাব দিল – “এই মূর্তিগুলো আমাদের শক্তির উৎস। যখন আমাদের খরা হয়, দুর্ভিক্ষ হয়, আমাদের শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করে – আমরা এই মূর্তির পূজা করি আর অলৌকিকভাবে আমাদের বিপদ কেটে যায়।“  

আমর ইবনে লুহাই বলল,”আমাকে এরকম একটি মূর্তি দিতে পার? আমি মক্কায় নিয়ে যেতে চাই।“

তখন তারা আমর ইবনে লুহাইকে একটা মূর্তি দিল, যার নাম – হুবাল। আমর ইবনে লুহাই এই হুবালকে মক্কায় নিয়ে এসে কা’বার ঠিক সামনে স্থাপন করে। সূদুর সিরিয়া থেকে আগত মূর্তির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ল মক্কাবাসী। আর এভাবেই আরবদেশে মূর্তির পূজা শুরু হয়।

মূর্তিপূজাকে বৈধতা দিতে, আরবরা হজ্বের তালবিয়াকে পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে! সাহিহ মুসলিমে এই পরিবর্তিত তালবিয়া সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।

অরিজিনাল তালবিয়া: লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক (অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির! আমি হাজির, তোমার কোন শরিক নাই।

পরিবর্তিত তালবিয়া: লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাক ইল্লা শারিকান হুয়া লাক, তামলিকুহু ওয়ামা মালাক

(অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির! আমি হাজির, তোমার কোন শরিক নাই, কিন্তু সেই শরিক ছাড়া যার তুমি মালিক এবং সেই শরীকের যা কিছু আছে তারও তুমি মালিক।)

দেখুন, এই পরিবর্তিত তালবিয়াতে কত সূক্ষ্মভাবে শিরক ঢুকানো হয়েছে! মক্কাবাসীরা আল্লাহকে এক আল্লাহ হিসেবেই মানছিল, কিন্তু একটা “কিন্তু” ঢুকিয়ে কিছু অন্য দেবতাদের পূজা করার সুযোগ বের করে ফেলেছিল! বর্তমান যুগে আমরা মুসলিমরা তো আর অন্য দেবতার পূজা করি না, কিন্তু মনে মনে কেউ হয়ত মাজারকে, কেউ হয়ত টাকা-পয়সাকে, কেউ ক্ষমতাকে আর কেউবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে “ছোট দেবতার” আসনে বসিয়ে দিয়েছি!    

আমর ইবনে লুহাই দ্বারা কা’বা ঘরের সামনে হুবাল-মূর্তি স্থাপন করা ছিল আরবজাতির জন্য একটা বিশাল বিষয় – কারণ পুরো হিজায অঞ্চল (মক্কা, মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) মক্কার ধর্মীয় প্রথাকে অনুসরণ করত। কাজেই, মক্কায় মূর্তি স্থাপনের প্রথা ধীরে ধীরে সমস্ত হিজাযে ছড়িয়ে পড়ে এবং ৫০০ বছর পরে যখন মুহাম্মাদ(সা) এর জন্ম হয়, ততদিনে পুরো আরবদেশ মূর্তিপূজায় গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।

প্রশ্ন দাঁড়ায় – কিভাবে আমর ইবনে লুহাই এর মত একজন মাত্র লোক, পুরো আরবজাতির ধর্মীয় প্রথায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে? কে ছিল এই আমর ইবনে লুহাই, কেনই বা আরবরা সবাই তার কথা শুনেছিল? এ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা তিনটি মূল কারণ পাই। সেই তিন কারণ নিয়ে ইনশা আল্লাহ পরের পর্বে আলোচনা করব।

[শেইখ ইয়াসির কাযির সীরাহ লেকচার পর্ব-৪ অনুসারে-ড. আদনান ফায়সাল

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট