রাসুলের (সা.) প্রতি তাঁর আপন মানুষের আচরণ

 


কোরাইশ গোত্র আর রাসুলে করিমের (সা.) নবদীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ কোরাইশদের পক্ষে একপর্যায়ে গভীর মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তখন তারা কতিপয় নির্বোধ লোককে রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। রাসুলকে (সা.) তারা মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করতে লাগল। তাঁকে অপমান করতে শুরু করল। রটনা করতে লাগল, তিনি কবি, জাদুকর, জ্যোতিষী, ভূতে-ধরা মানুষ। রাসুল (সা.) কিন্তু এসব সত্ত্বেও আল্লাহ্‌র আদেশ অনুসারে তাঁর ধর্ম প্রচার করে যেতে লাগলেন। কিছুই তিনি গোপন করলেন না। কোরাইশদের ধর্মকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করলেন, তাদের দেবদেবীকে ত্যাগ করলেন। এতে করে তাদের বৈরী ভাবকে তিনি উত্তেজিত করলেন। নিজেদের অবিশ্বাসে উপরন্তু তারা অটলই থেকে গেল।’

আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আমর ইবনে আল-সাদের সূত্রে ইয়াহিয়া ইবনে উরওয়া ইবনে আল-জুবায়েরের বাবা এবং তার বাবার সূত্রে ইয়াহিয়া আমাকে বলেছেন, রাসুলে করিমের (সা.) প্রতি কোরাইশদের শত্রুতা প্রদর্শন করার নিকৃষ্টতম পথ কোনটি ছিল, তা আবদুল্লাহ্‌কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। আবদুল্লাহ্‌ জবাব দিয়েছিলেন, ‘একদিন কাবা প্রাঙ্গণে হাতিমের কাছে কোরাইশদের সমস্ত মান্যগণ্য লোক বসে গল্প করছিল। ওখানে আমিও ছিলাম। কথায় কথায় রাসুলে করিমের (সা.) কথা উঠল। তারা একবাক্যে বলল, এই বেটা তাদের যে রকম কষ্ট দিচ্ছে এ রকম কষ্ট তাদের জীবনে কেউ আর দেয়নি। ও তাদের জীবনধারাকে বলছে অর্থহীন, তাদের পিতৃপুরুষকে অপমান করেছে, তাদের ধর্মকে হেনস্তা করেছে, তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদের দেবদেবীকে অভিসম্পাত দিয়েছে। তাদের সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে অথবা এমনি কিছু ধরনের কথা।‘ওরা কথা বলছিল তাঁকে নিয়েই। এমন সময় তিনি এলেন ওখানে। এলেন তাদের কাছাকাছি। হাজরে আসওয়াদে চুমু খেলেন। তারপর তাদের পাশ কাটিয়ে কাবা শরিফ তওয়াফ করতে লাগলেন। ওদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় ওরা তাঁকে উদ্দেশ করে কিছু খারাপ গালি বর্ষণ করল। আমি তাঁর চেহারা দেখে সেটা বুঝলাম। উনি তওয়াফ করে চললেন। দ্বিতীয়বারের মতো তিনি যখন তাদের পাশ কেটে যাচ্ছিলেন, তখনো ওরা ঠিক একইভাবে তাঁকে আঘাত করে অপমানজনক উক্তি করল। এটাও আমি তাঁর চেহারা দেখেই বুঝলাম। তিনি তৃতীয়বারের মতো তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, তখনো ওরা একই রকম আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করল। রাসুলে করিম (সা.) তখন থামলেন, বললেন, আপনারা কি আমার কথা শুনবেন, হে কোরাইশবৃন্দ? যাঁর হাতে আমার জান তাঁর কসম, আমি আপনাদের জন্য খুন এনেছি।শুনে ওরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল বজ্রাহতের মতো। সবচেয়ে বেশি লাফালাফি করছিল এতক্ষণ যেজন, সে তাঁকে অত্যন্ত নরম গলায় বলল, চলে যান আবুল কাসিম, আপনি চলে যান। কারণ, খুনোখুনির কাজ আপনার নয়।’

রাসুলে করিম (সা.) চলে গেলেন।

পরদিনও তারা একই স্থানে এসে জমায়েত হলো। আমিও ছিলাম সেখানে। গতকাল রাসুল (সা.) ও তাদের মধ্যে কী হয়েছিল, প্রকাশ্যে সে লোক তাদের গরম গরম কী যেন কথা শোনাল এবং তারপর ওকে কিছু না করে যেতে দেওয়া হলো, কেন কী বৃত্তান্ত একে অন্যকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। ঠিক তখনই রাসুলে করিম (সা.) এলেন। ওরা সবাই একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে তাঁকে ঘিরে ধরল। বলল, ‘তুমি আমাদের দেবদেবী, আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে আকথা-কুকথা বলেছ? তুমিই সেই লোক?’

রাসুলে করিম (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সে লোক।’

দেখলাম ওদের একজন তাঁর জামা চেপে ধরল।

চিৎকার করে তখন আবু বকর কেঁদে উঠলেন, ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আল্লাহ্‌ আমার প্রভু, শুধু এই কথা বলার অপরাধে একটা মানুষকে আপনারা হত্যা করবেন?’

তারপর ওরা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

রাসুলের (সা.) প্রতি কোরাইশদের এর চেয়ে খারাপ ব্যবহার করতে আমি দেখিনি।

আবু বকরের মেয়ে উম্মে কুলসুমের পরিবারের একজন আমাকে বলেছেন, উম্মে কুলসুম বলেছেন, ‘সেদিন আবু বকর ঘরে ফিরলেন চুলছেঁড়া মাথা নিয়ে, সুন্দর দাড়িওয়ালা মানুষ ছিলেন তিনি। ওরা তাঁকে দাড়ি ধরে টানাহেঁচড়া করেছিল।’

অনুবাদ: শহীদ আখন্দ

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট