সূরা আল-মু'মিনুনে বিশ্বাসীদের কিছু বৈশিষ্ট্য

 


সূরা আল-মু'মিনুনের শুরুতে বিশ্বাসীদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। সূরাটির শেষের দিকে গেলে আমরা দেখবো, শেষ দিকেও মু'মিনদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আমরা প্রথম প্যাসেজটি নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি। কিন্তু অধিকাংশ সময় শেষ দিকে উল্লেখিত যোগ্যতাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় না। যা আলোচনাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। সূরাটির শেষে গেলে আমরা সেগুলো নিয়েও আলোচন করবো।

এখন চলুন, প্রথম দিকে উল্লেখিত মুমিনদের কোয়ালিটিগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। আল্লাহ তায়ালা বলেন- قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ - মু’মিনরা সফল হয়ে গেছে। আয়াতের শুরুতে 'কাদ' শব্দটি খেয়াল করেছেন? কোনোকিছু ইতোমধ্যে ঘটে গেছে এমন বুঝাতে বা নিশ্চয়তা বুঝাতে 'কাদ' ব্যবহৃত হয়। আমরা ভাবি, সত্যিকারের বিশ্বাসীরা ভবিষ্যতে জান্নাত অর্জন করবে। কিন্তু, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই আয়াতে বলছেন, তোমাদের যদি সত্যিকারের বিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে তোমরা ইতোমধ্যেই সফলতা অর্জন করে ফেলেছ। সফলতা অর্থ বুঝাতে যে আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তার দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। ফাল্লাহ অর্থ কৃষক। কৃষক কোদাল দিয়ে বীজ বপনের জন্য যে মাটি খোঁড়ে, এই কাজটাকেও ফাল্লাহ বলা হয়। এই দৃশ্য থেকে কিভাবে শব্দটি সফলতার জন্যে ব্যবহার করা হয়? কারণ, প্রথমে যখন সে মাটি কেটে বীজ বুনার জন্য জমিন প্রস্তুত করে, এটা একটা সফলতা। এরপর তাকে সারা বছর জমিতে শ্রম দিতে হয়। অতঃপর, সবশেষে যদি সে আবার মাটি খুঁড়ে ফসল তুলে আনে, এর মানে, সবকিছু ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পোকামাকড়ে ফসল খেয়ে ফেলেনি, খরা হয়নি, গাছগুলো সঠিক পরিমাণে তাপমাত্রা পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকিছু ঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়াতে শেষ পর্যন্ত সে তার কষ্টের ফসল তুলতে পারলো। কৃষি খুবই কঠিন একটি পেশা। অন্য পেশায় মানুষ যেমন মাস শেষে বেতন পায়, কৃষক কিন্তু তা পায় না। তার সারা বছরের বেতন নির্ভর করে বছর শেষে সে কতটুকু ফসল উৎপাদন করতে পারলো তার উপর। এ কারণে সমগ্র দুনিয়াজুড়ে ফসল তোলার সময় কৃষি সমাজ বিভিন্ন ধরণের উৎসবের আয়োজন করে। এটা তাদের আনন্দের সময়। কারণ বড় অঙ্কের একটি চেক পাওয়ার সময় এটা। ঠিক এ ব্যপারটাকেই একজন ঈমানদারের জীবনের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা যেন এমন, আমরা কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি সমগ্র জীবন ধরে, আর জীবন শেষ হয়ে গেলে, আসল পুরস্কার পাওয়ার সময় আসবে। কিন্তু, আল্লাহ এখানে বলছেন, কাদ আফ্লাহা- তাদের ফসল তোলার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা কৃষকের মত অনিশ্চিত নয়। কৃষক নিশ্চিত থাকে না যে, বছর শেষে সে ফসল তুলতে পারবে কিনা। যদি সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে এর নাম ইফ্লাহ। কিন্তু, ঈমানদারদেরকে এ সফলতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। কাদ আফ্লাহা- মুমিনরা সফল হয়ে গেছে। চলুন, এখন 'আল-মু'নিনুন শব্দটির প্রতি মনোযোগ প্রদান করি। আমরা কুরআনে এ সম্পর্কিত আরেকটি পরিভাষাও পাই। "আল্লাজিনা আমানু"। আল্লাহ এখানে ''কাদ আফ্লাহাল্লাজিনা আমানু'' বলেননি। তিনি বলেছেন- কাদ আফ্লাহাল মু'মিনুন। উভয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। 'আমানু' একটি ক্রিয়াপদ। অতীতকালীন ক্রিয়াপদ। আর 'মু'মিনুন' হলো বিশেষ্য বা নাউন। আরবি ব্যাকরণে ইস্লমে ফায়েল। ইংরেজিতে একে active participle বলা হয়। (Doer Noun) ঈমানদারেরা। ভাষাতত্ত্বে verb বা ক্রিয়াপদকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হয়। আর noun বা বিশেষ্যকে স্থায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে যখন বলা হয়- আল্লাজিনা আমানু অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছিল। এর দ্বারা বর্তমানে তাদের ঈমান আছে এমন গ্যারান্টি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ভবিষ্যতে তাদের ঈমান থাকবে এরও গ্যারান্টি পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রিয়াপদ ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল। কিন্তু নাউনের তো কোনো past tense, present tense বা future tense নেই। যেমন, Apple একটি Noun. এর কোনো পাস্ট টেনস, প্রেসেন্ট টেনস বা ফিউচার টেনস নেই। তাই, বিশ্বাসীদের যখন 'মু'মিনুন' বলা হচ্ছে; তাদের জন্য যখন নাউন ব্যবহার করা হচ্ছে- ব্যাপারটা এমন যেন তাদের ঈমানকে এক ধরণের স্থিতিশীলতা প্রদান করা হচ্ছে। এটাকে নিরন্তর একটি জিনিস হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। চলুন, একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টাকে আরও ভালোভাবে বুঝি। "আল্লাজিনা আমানু"- আল্লাজিনা অর্থ যারা। আমানু অর্থ ঈমান এনেছিল। যারা ঈমান এনেছিল। যখন এভাবে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয় তখন ব্যাপারটা এমন যেন- কেউ নদীতে পড়ে গেছে। আর সে একবার ডুবছে একবার উঠছে। কখনো তার মাথা পানির উপরে উঠে আসছে আবার কখনো তা ডুবে যাচ্ছে। তাদের ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। আর মু'মিনুন অর্থাৎ যখন নাউন ব্যবহার করা হয়- তখন এমন ঈমানদারদের কথা বলা হচ্ছে যারা নৌকাতে আছে। হ্যাঁ নৌকা ঢেউয়ের তালে তালে ধুলতে থাকে কিন্তু নৌকাটা সর্বদা কোথায় আছে? পানির উপর। অর্থাৎ, এ ধরণের মানুষেরা সৎকর্মের ক্ষেত্রে, ইবাদাতের ক্ষেত্রে এক ধরণের উন্নত মান সবসময় বজায় রাখে। এরাই হলো আল-মু'মিনুন। হ্যাঁ, তাদেরও ভালো দিন খারাপ দিন আসে। কিন্তু, তারা নির্দিষ্ট একটি রেখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। ঐ রেখার ভেতরেই তারা থাকে। এজন্যই তারা এ অসাধারণ টাইটেল 'আল-মু'মিনুন' অর্জন করতে পেরেছে। সত্যিকারের বিশ্বাসীরা। তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী আয়াতগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে। নিজেকে এগুলোর আলোকে পরীক্ষা করে দেখুন। আমার অবস্থান কোথায়? নিম্নে বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো। ১। তারা নিজেদের নামাজে খুশু বজায় রাখে। ২। আর যারা অনর্থক কথাকর্ম থেকে বিমুখ। ৩। আর যারা যাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়। এর আরেকটি অর্থ হলো- যারা নিজেদের পরিশুদ্ধ করার কাজে সক্রিয়। অন্য কথায়, তারা বুঝতে পারে আমার ব্যক্তিত্ব অশুদ্ধ, এর নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা রয়েছে। হয়তো আমার রাগের সমস্যা আছে, আমি হয়তো মানুষকে মাফ করতে পারি না। কেউ কষ্ট দিলে তা হয়তো ভুলতে পারি না। আমি হয়তো বুঝতেও পারি না যে, কথা বলার সময় আমি মানুষকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। আমি হয়তো বিনোদনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে ফেলি। এই আয়াতটি কিভাবে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করবেন? নিজের ব্যাপারে যে বিষয়গুলো অপছন্দ করেন তার একটি লিস্ট তৈরি করুন। আর আপনি নিশ্চিত যে, এগুলো আল্লাহও পছন্দ করেন না। এরপর এগুলো দূর করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করুন। ৪। আর যারা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী। যারা অশ্লীলতা থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলে। ৫। আর যারা নিজেদের আমানাত ও ওয়াদা পূর্ণ করে। ৬। আর যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে যত্নবান। (দৈনিক নামাজগুলো ঠিকভাবে আদায় করে।) তারাই হল উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে, যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে। - নোমান আলী খানের আলোচনা অবলম্বনে

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট