কেন আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে?

 কেন আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে?


—শায়েখ ইয়াসির কাদি বর্তমানে আমরা মানসিক অশান্তি এবং ডিপ্রেশনের এমন এক প্রবল জোয়ার প্রত্যক্ষ করছি, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যার আর কোন নজির পাওয়া যায় না। এমনকি আমার বেড়ে উঠার কালেও কিশোর কিশোরীদের এভাবে ডিপ্রেশনে ভুগতে দেখা যায়নি। তরুণ ছেলে মেয়েরা যাদের সামনে সমস্ত জীবন পড়ে আছে তারাই ডিপ্রেশনে ভুগছে! একটু খোঁজ নিলে জানবেন সাইক্রিয়াটিস্ট এবং সাংবাদিকরা 'জীবনে অর্থহীনতার উত্থান' নিয়ে কথা বলছেন। তরুণ তরুণীদের মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হচ্ছে, ঔষধ খেতে হচ্ছে। আমি বলছি না যে, ডাক্তারের কাছে যাওয়া খারাপ। কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত— কেন? কেন আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে? খুবই স্পর্শকাতর একটি সাবজেক্ট। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। এই প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা যে হারে আত্মহত্যা করছে মানব ইতিহাসের কোনো কালে এমনটি দেখা যায়নি। আর সবকিছু যেভাবে এগোচ্ছে এর মাত্রা আরো খারাপ হবে। আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এখন প্রশ্ন হলো কেন? কেন এই হারে মানুষের মাঝে হতাশা দেখা যাচ্ছে? আমাদের কাছে ব্যাপারটা সুস্পষ্ট। যখন আপনি জীবন থেকে সৃষ্টিকর্তাকে দূর করে দেন, ধর্মকে দূর করে দেন, আখিরাতকে দূর করে দেন— তখন জীবন হয়ে পড়ে অর্থহীন। জীবনে এভাবে বেঁচে থাকার অর্থ কী? যখন আপনাকে শুধু একটার পর একটা লড়াই অতিক্রম করতে হয়, কষ্ট পেতে হয়, প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হতে হয়— এইসব কিছুর মানে কী? সবশেষে তো আপনি এমনিতেই চিরতরে হারিয়ে যাবেন। তাই জীবনের সকল ধকল ভোগ করার চাইতে তারা এখনই নিজেকে শেষ করে দেয়। কিন্তু, আপনি যদি কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করেন এটা আপনার ভেতরটা আবার জীবিত করে তোলে। আপনার জীবনকে বাঁচার যোগ্য এবং অর্থপূর্ণ করে তোলে। এটা ছিল দ্বিতীয় পয়েন্ট। তৃতীয় পয়েন্ট হল—এই পয়েন্টটি দ্বিতীয় পয়েন্টের সাথে সম্বন্ধযুক্ত—এটা যে শুধু আপনার জীবনকে বাঁচার যোগ্য করে তোলে তাই নয়, এটা আপনাকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রবলভাবে আশান্বিত করে তোলে এই অর্থে যে, ভবিষ্যৎ অতীতের চেয়ে উত্তম হবে। আর এই কথাটি একেবারে পরিষ্কারকরে দ্বিতীয় মতান্তরে তৃতীয় ওহীতে বলা হয়েছে— "ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুল লাকা মিনাল উলা।" এটা একেবারে স্পষ্ট ভাষায় কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুনিয়াতে যাই ঘটুক না কেন, পরকালে আপনার জন্য উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে। এটা আমাদের প্রকৃতিতেই আছে, আমরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে চাই। কর্পোরেট সেন্সে বলতে গেলে— চাকরিতে যদি কঠিন কোন সময় পার করতে হয়, মাস শেষে মোটা অঙ্কের চেকের কথা ভেবে আপনি আশাবাদী হয়ে উঠেন। যত কষ্টই হউক না কেন আমি চাকরি করে যাবো। কারণ, মাস শেষে আমি বোনাস পাবো। এটা আপনার মাঝে আশা জাগিয়ে তোলে, উৎসাহ জাগিয়ে তোলে। আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন এই দুনিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হইও না, "ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুল লাকা মিনাল উলা"- “আপনার জন্যে পরকাল ইহকাল অপেক্ষা শ্রেয়।” সত্যি বলতে, জীবন আসলেই কঠিন। কখনো কখনো খুবই হতাশাজনক হতে পারে। জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু একজন বিশ্বাসীর জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একজন বিশ্বাসী যখন কিয়ামতে বিশ্বাস করে তখন তা এক ধরণের প্রশান্তি নিয়ে আসে, এখন যাই হউক না কেন, আখিরাত আমার জন্য উত্তম হবে। এটা একজন মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। আর তাইতো আমাদের রাসূল (স) বলেছেন— "আজাবাল লি আম্রিল মুমিন ফা ইন্না আম্রাহু কুল্লাহু খাইর।" "মুমিনের বিষয়টি কতইনা আশ্চর্য জনক! তার প্রত্যেকটি বিষয় কল্যাণকর।" তার কোন পরাজয় নেই। কীভাবে একজন মু'মিনের কোন পরাজয় নেই? কারণ, সে আখিরাতে বিশ্বাস করে। যদি কোন আখিরাত না থাকত তাহলে সত্যি সত্যিই পার্থিব এই জীবন যুদ্ধকে সবসময়ের পরাজিত যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেত। জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস আমাদেরকে জীবনের কঠিন সময়গুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এ বিশ্বাসের ফলে আমরা জীবনের চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির মাঝেও আশার আলো খুঁজে পাই। আমরা পরজীবনে ভালো কিছুর প্রত্যাশায় থাকি। দুনিয়ার এ জীবন এমনিতেই কঠিন। কারো কারো জন্য অন্য অনেকের চেয়ে আরো বেশি কঠিন। এ জন্যে অবিশ্বাসীরা জীবনের কঠিন সময়গুলোতে একেবারে ভেঙে পড়ে। জীবনের বিপদ আপদগুলোর কোনো ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পায় না। জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস ছাড়া এর কোনো উত্তরও নেই। একবার যদি বেহেশত দোজখের বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে আসেন, তখন সবকিছু অতি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। পাঁচ মিনিটের কষ্ট কিংবা কয়েক মাস বা কয়েক বছরের কষ্ট পরকালের অনন্ত জীবনের সুখের কাছে আসলে কিছুই না। দুনিয়ার এ জীবনে কিছুকাল কষ্ট ভোগ করা সত্ত্বেও আমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী, সৎ এবং ধার্মিক জীবন যাপন করি। তো, যার বাচ্চাটা মারা গেলো সে জানে বাচ্চাটা জান্নাতে যাবে। আর পিতা বা মাতা হিসেবে সে যদি ধৈর্য ধারণ করে অর্থাৎ আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয় তবে ইনশাআল্লাহ সেও একদিন এ বাচ্চার সাথে পুনরায় জান্নাতে একত্রিত হবে। এখন, আপনি যদি জান্নাত জাহান্নামের ধারণাকে দূর করে দেন, তখন এ দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট ভোগকে ব্যাখ্যা করার কোনো উপায়ই আপনার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। কারণ, আপনি সত্যকে অস্বীকার করছেন। আর এ অবিশ্বাস আপনার অবস্থাকে দিন দিন শুধু আরো খারাপই করতে থাকবে। পরকালের এ বিশ্বাস নিষ্ক্রিয় কোনো বিশ্বাস নয়। এ বিশ্বাস আমাদের দৈনিক রুটিনে প্রতিফলিত হয়। কিভাবে আমরা সমস্যা, সফলতা, ব্যর্থতা, সুবিচার এবং অবিচারের সাথে ডিল করবো। কিভাবে পৃথিবীর সকল নেতিবাচকতার মোকাবেলা করবো। এক কথায়, জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস আমাদেরকে এই দুনিয়াতে একটি সুস্থ জীবন যাপন করতে শেখায়। আমি এমনকি বুঝতেও পারি না— যে ব্যক্তি কোনো উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস করে না, আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, বেহেশত দোজখে বিশ্বাস করে না, আমি বুঝি না কোন ব্যাপারটা তাকে এমনকি বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়ে যায়। এটা একটা অন্ধকারময় নিরস এক দুনিয়া। কত শত সমস্যা এবং ইস্যু আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। আপনি যদি মনে করেন মৃত্যুর সাথে সাথে আপনার সমাপ্তি হয়ে যাবে, কোনোদিন আর চেতনা ফিরে পাবেন না, তাহলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ কি। তাই, আপনি যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে বিশ্বাস করবেন, আপনার হৃদয়টা ব্যাপক প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠবে। অন্তরটা একেবারে শান্ত হয়ে যায়। সবকিছু মেক সেন্স করে। আর ঠিক এ কথাটাই কুরআনে এসেছে— اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। (১৩:২৮) -------------------------------------- [সবকিছুর উত্তর—আল্লাহর ইবাদাত। আল্লাহর ইবাদাত। আল্লাহর ইবাদাত। আপনাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এ উদ্দেশ্যে। সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ না করলে আপনি ব্যর্থ হবেন। আল্লাহ নিজেই বলেছেন— وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَعۡمٰی- "আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়।" (২০:১২৪) এখানে সঙ্কুচিত জীবন বলতে বুঝানো হয়েছে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ও ব্যাকুলতাময় জীবন। যা আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন ব্যক্তিরা প্রাপ্ত হয়ে থাকে।]

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট