কোরবানির শিক্ষা ত্যাগ ও ধৈর্যের দীক্ষা

 


কোরবানির অর্থ কাছে যাওয়া, নৈকট্য অর্জন করা ও উৎসর্গ করা। কোরবানির শিক্ষা হলো আত্মত্যাগের শিক্ষা। মহামহিম রাব্বুল আলামিনের সমীপে আত্মসমর্পণের শিক্ষা, তাকওয়া বা প্রভুপ্রেম এবং ইখলাস তথা একনিষ্ঠ আত্মনিবেদনের শিক্ষা।

পশু কোরবানি একটি প্রতীক মাত্র। কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য হলো মহান রবের জন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা।

মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এর মাধ্যমে মনের সব কালিমা ও চরিত্রের কুস্বভাবকে চিরতরে দূরীভূত করা এবং চিত্তের সব কুপ্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করাই মূল উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)

তাকওয়াবিহীন কোরবানি আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো, অন্যজনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানিই কবুল করেন।’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ২৭)

কোরবানি স্রষ্টার আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত প্রকাশ। জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান রাব্বুল আলামিনের সমীপে আত্মসমর্পণ এবং প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সুন্নতের অনুসরণ ও আদর্শিক আনুগত্য এবং মনোজগতে তাঁর মননের অনুকরণ কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা।

ধৈর্য-সহ্য ও সহিষ্ণুতা কোরবানির প্রধান প্রতিপাদ্য, যা শিশুনবী হজরত ইসমাইল (আ.)–এর জবানিতে কোরআনুল কারিমে উদ্ধৃত হয়েছে, ‘সে (ইসমাইল) বলল, “হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা–ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”’ (সুরা-৩৭ সফফাত, আয়াত: ১০২)

ত্যাগের মহিমা ও ধৈর্যের সুষমার সমন্বয়ই হলো কোরবানি। জীবনে ত্যাগের শিক্ষা ও ধৈর্যের দীক্ষা কোরবানির মূল শিক্ষা। সুমহান ত্যাগ ও চরম ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই জীবনের পরম সাফল্য ও মোক্ষ লাভ করা সম্ভব।

মানবিক উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন। ধৈর্যের আরবি হলো সবর। সহিষ্ণুতার আরবি হলো হিলম। হিলম তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল।’ (২২: ৫৯)

সবর অর্থাৎ ধৈর্য সম্পর্কে হজরত আইয়ুব (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। সে কত উত্তম বান্দা! সে ছিল আমার অভিমুখী।’ (৩৮: ৪৪)

‘নিশ্চয় এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক চরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।’ (১৪: ৫)

ধৈর্য সাফল্যের নিয়ামক। এ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে আছে; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (১০৩: ১-৩)

‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সুসম্পর্ক স্থাপনে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে অবিচল থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (৩: ২০০)

‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (২: ১৫৩)

‘মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত; তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (৬৭: ১-২) ‘অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচর (ইউনুছ আ.)–এর মতো অধৈর্য হোয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (৬৮: ৪৮)

ধৈর্য তিন প্রকার, যথা—‘সবর আনিল মাসিয়াত’ অর্থাৎ অন্যায়–অপরাধ থেকে বিরত থাকা; ‘সবর আলাত তআত’ অর্থাৎ ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা এবং ‘সবর আলাল মুসিবাত’ অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া। (তাফসিরে বায়জাবি)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট