মিষ্টভাষী হজরত দাউদ (আ.)

 


হজরত দাউদ (আ.) নবী ও বাদশাহ ছিলেন। কোরআনের অনেকগুলো সুরায় দাউদ (আ.)–এর কথা উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দাউদ (আ.) ছিলেন আল্লাহভক্ত সাধক এবং লৌহবর্ম নির্মাণের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকারী স্বনির্ভর নবী। লোহা তাঁর হাতে নমনীয় হয়ে যেত। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অসম্ভব মিষ্টি। তাঁর পাঠ শুনে সবাই মুগ্ধ হতো। পাহাড়, তরুলতা, পশুপাখি এরাও তাঁর সঙ্গে উপাসনায় যোগ দিত। আল্লাহ পাহাড়-পর্বত ও পক্ষীকুলকে তাঁর প্রভাবাধীন করে দিয়েছিলেন।

সুরা বাকারায় আছে, দাউদ (আ.) জালুতকে হত্যা করেন। এ সুরায় আল্লাহ্‌র তাঁকে কর্তৃত্ব ও হিকমত দানের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ দাউদ (আ.)–কে বিপুল শক্তি ও ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যুবক বয়স থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও বীর। খুব অল্প বয়সেই তিনি তালুতের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে কুখ্যাত যুদ্ধবাজ জালুতকে হত্যা করেছিলেন। কোরআনে মহান আল্লাহ সে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।কোরআনে আছে, ‘সুতরাং তখন তারা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের পরাজিত করল। দাউদ জালুতকে বধ করল ও আল্লাহ তাকে কর্তৃত্ব ও হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন, তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দিয়ে দমন না করতেন, তবে নিশ্চয় পৃথিবী ফ্যাসাদে পূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতি মঙ্গলময়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫১)

সুরা আম্বিয়ার ৭৮ আয়াতে দাউদ (আ.)-কে সোলায়মান (আ.)-এর মতো বিজ্ঞ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কতগুলো ভেড়া একদিন কোনো খেতের ফসল নষ্ট করলে তাঁরা দুজন সেই ঘটনার যে বিচার করেছিলেন, এই আয়াতে তা স্মরণ করতে বলা হয়েছে। সোলায়মান (আ.)-এর বয়স তখন ছিল ১১ বছর মাত্র। তবু সেই বয়সেই তিনি পিতার রায় সংশোধন করে বিশেষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।সুরা সাদে একটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে, যেখানে দুজন অভিযোগকারী দাউদ (আ.)-এর কাছে বিচার প্রার্থনার ছলে এসে রাতের অন্ধকারে দেয়াল ডিঙিয়ে তাঁর খাস কামরায় ঢুকে পড়েছিল। হজরত দাউদ (আ.) মনে করেন যে তাঁর কোনো ত্রুটির জন্যই আল্লাহ তাঁকে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন। আর এ জন্য তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

হজরত দাউদ (আ.)–কে আল্লাহ দিয়েছিলেন বীরত্ব, সাহসিকতা, খেলাফত, বিচারিক দক্ষতা ও পশুপাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতা। হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো সুমধুর সুর আর কাউকে দেওয়া হয়নি। হজরত দাউদ (আ.) যখন তাঁর মোহনীয় সুরে জাবুর পাঠ করতেন, তখন আকাশে উড়ন্ত পাখিও নীরবে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত শুনত। নদীর প্রবাহ থেমে যেত। বাতাসে সৃষ্টি হতো ভ্রমরের মতো গুনগুন গুঞ্জন।

যুদ্ধে বীরত্বের প্রমাণ দেওয়ার পর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। সেখানেও তিনি দক্ষতা ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর প্রজ্ঞার সুনাম করে কোরআনে আছে, ‘আমরা তার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা।’ (সোয়াদ, আয়াত: ২০)

হজরত দাউদ (আ.)-এর রাজত্ব ছিল বর্তমান ফিলিস্তিনসহ সমগ্র ইরাক ও সিরিয়া এলাকায়। ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রতি অনুগত ও কৃতজ্ঞ। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর কৃতজ্ঞতার সুনামও করেছেন। তাঁর মুজিজাগুলো ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পর্বতমালা ও পাখিদের তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। কঠিন লোহা তাঁর হাতে মোমের মতো গলে যেত। তিনি লোহাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করে নকশা গড়তে পারতেন। তৎকালীন যুগের অত্যাধুনিক বর্ম ইত্যাদি তিনিই বানাতে পারতেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর সেই শৈল্পিক দক্ষতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কোরআনে আছে, ‘আর অবশ্যই আমি আমার পক্ষ থেকে দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম। (আমি আদেশ করলাম,) হে পর্বতমালা, তোমরা তার সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো, এবং পাখিদেরও (এ আদেশ দিয়েছিলাম)। আর আমি তার জন্য লোহাকেও নরম করে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে পারো, কড়াগুলো সঠিকভাবে সংযুক্ত করো আর তোমরা সৎকর্ম করো। তোমরা যা করো আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১০-১১)হজরত দাউদ (আ.) তাঁর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই উপার্জন করতেন। নিজের উপার্জনের টাকায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের ভরণপোষণের জন্য কিছুই নিতেন না। যদিও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের বিনিময় নেওয়া অবৈধ নয়। নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামের কাছে তাঁর এই গুণের সুনাম করেছেন।

মিকদাম (রা.) সূত্রে পাওয়া একটি হাদিসে আছে, নবী (সা.) বলেন, নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (বুখারি, হাদিস: ২০৭২)

আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে কোরআনে আছে, ‘আমরা দাউদের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ প্রদান করেছিলাম এই মর্মে যে হে পর্বতমালা, তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং (একই নির্দেশ দিয়েছিলাম) পাখিদেরও।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১০)কোরআনে হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি পাহাড়-পর্বত ও পশুপাখির আনুগত্য ও আল্লাহর তাসবিহ পাঠের কথা বলা হয়েছে।

কোরআনে আছে, ‘আর আমি সোলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা জানিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি হিকমত ও জ্ঞান দিয়েছিলাম। আমি পাহাড় ও পাখিদের জন্য নিয়ম করে দিয়েছিলাম যেন ওরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্র মহাকীর্তন করে। আমি ছিলাম এসবের কর্তা। আমি তাকে তোমাদের জন্য বর্ম তৈরি করতে শিখিয়েছিলাম, যা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। সুতরাং তোমরা কি হবে না? কৃতজ্ঞ হবে না। (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত: ৭৯-৮০)ferdous faisal

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট