এক কাঠমিস্ত্রির ঘটনা

 


এই ঘটনা বিশ্বে হজরত ঈসা (আ.)-এর আগমনেরও আগের। সিরিয়ার আন্তাকিয়ার শহরতলিতে বাস করতেন একজন কাঠমিস্ত্রি। তার নাম হাবিব ইবনে ইসমাইল। ইসলামের ইতিহাসে তিনি হাবিব নাজ্জার, অর্থাৎ কাঠমিস্ত্রি হাবিব নামে পরিচিত। আন্তাকিয়া ছিল ওই সময়ের এক জনপদ। আন্তাকিয়ার লোকজন ছিল পৌত্তলিক। হাবিবও ছিলেন কুষ্ঠরোগী। রোগমুক্তির আশায় তিনি নানা প্রতিমার উপাসনা করতেন।

আল্লাহ ওই সম্প্রদায়কে সতর্ক করার বাসনা করলেন। প্রথমে তিনি তাদের কাছে দুজন আল্লাহ্‌ প্রেরিত বার্তাবাহী ব্যক্তিত্ব (রাসুল) পাঠালেন। দ্বীনের দাওয়াত দিতে তাঁরা আন্তাকিয়া শহরে গেলেন। সেখানে তাঁদের দেখা হলো হাবিবের সঙ্গে। তাঁরা তাকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দাওয়াত দিলেন।

হাবিব বললেন, আপনাদের দাবি যে সত্য, তার কি কোনো প্রমাণ আছে?

তাঁরা বললেন, আছে।

হাবিব তাঁর কুষ্ঠরোগের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আপনারা কি আমার এ ব্যাধি দূর করে দিতে পারবেন?’তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ! আমরা আমাদের রবের কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে রোগমুক্ত করবেন।’

হাবিব এ কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি সারা জীবন দেব-দেবীর প্রার্থনা করলাম। কিন্তু কোনো উপকার পেলাম না। অথচ আপনাদের রব কীভাবে আমার কঠিন অবস্থা পাল্টে দেবেন?’

রাসুলদের দোয়ায় আল্লাহ হাবিবকে সুস্থ করলেন। তাঁর ঈমান দৃঢ় হলো।

আল্লাহর এই দুই প্রতিনিধি আন্তাকিয়াবাসীদের সঠিক পথের দাওয়াত দিতে থাকলেন। কিন্তু তারা তাঁদের দুজনকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যা দিল। তাঁদের শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ আরেকজন রাসুল পাঠালেন। কিন্তু তাঁদের উপদেশের জবাবে জনপদবাসীরা তাঁদের মিথ্যুক বলেই অপবাদ দিতে থাকল।

কোরআনে আছে, ‘ওরা বলল, তোমরা তো আমাদেরই মতো মানুষ। করুণাময় আসলে কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবলই মিথ্যা বলছ।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ১৫)

তাদের রূঢ় কথাবার্তা শুনে কষ্ট পেলেও প্রতিনিধিরা দ্বীনের দাওয়াত চালিয়েই গেলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমাদের প্রতিপালকের শপথ, আমরা অবশ্যই তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি, স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ১৬-১৭)তবু আন্তাকিয়াবাসীরা তাঁদের কথা অমান্য করে চলল। তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ আন্তাকিয়া শহরে দুর্ভিক্ষ দিলেন। আল্লাহর সতর্কতা সঙ্কেত তারা মোটেই বুঝতে পারল না, বরং রাসুলদের তারা বলল, ‘আমরা তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও, তোমাদেরকে অবশ্যই আমরা পাথর মেরে হত্যা করব ও নিদারুণ শাস্তি দেব।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ১৮)

এক সময় তারা রাসুলদের হত্যা করার কথা ভাবল। এই চক্রান্তের খবর শুনতেই হাবিব নাজ্জার তাদের কাছে ছুটে এলেন। তার সম্প্রদায়ের লোকদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। অথচ তারা তাঁর কথায় মোটেই কান দিল না। কোরআনে আছে, ‘তারা বলল, এ কি এজন্য যে, আমরা তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি? তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই, আসলে তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ১৯)

কোরআনে আরও আছে ‘শহরের এক প্রান্ত থেকে একজন ছুটে এসে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! রাসুলের অনুসরণ করো, অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চায় না, আর যারা সৎপথ পেয়েছে।যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন ও যার কাছে তোমরা ফিরে যাবে, আমি তাঁর উপাসনা করব না কেন? আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য উপাস্য গ্রহণ করব? করুণাময় আল্লাহ্ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে, ওদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না; আর ওরা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এমন করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ব। আমি তোমাদের প্রতিপালকের ওপর বিশ্বাস রাখি, তাই তোমরা আমার কথা শোনো।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ২০–২৫)

এলাকাবাসী হাবিবের কথা তো শুনলই না। উল্টো তাঁর ওপর চড়াও হয়ে পাথর ছুড়তে ছুড়তে তাঁকে হত্যা করে ফেলল।আল কোরআনে আছে, ‘শহীদ হওয়ার পরে তাঁকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলে উঠল, হায়, আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারত, কী কারণে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন ও সম্মানিত করেছেন!’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ২৬–২৭)

কোরআনে আরও আছে, ‘আমি তাঁর (মৃত্যুর) পর তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আকাশ থেকে কোনো বাহিনী প্রেরণ করিনি, আর তার প্রয়োজনও ছিল না। কেবল এক মহাগর্জন হলো। ফলে ওরা নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার দাসদের জন্য দুঃখ হয়, ওদের কাছে যখনই কোনো রসূল এসেছে তখনই ওরা তাকে ঠাট্টাবিদ্রূপ করেছে। ওরা কি লক্ষ করে না, ওদের আগে কত মানবগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি যারা আর ওদের মধ্যে ফিরে আসবে না? আর ওদের সকলকে তো আমার কাছে একত্র করা হবে।

‘ওদের জন্য একটা নিদর্শন মৃত ধরিত্রী, যা আমি পুনর্জীবিত করি ও যার থেকে আমি শস্য উৎপন্ন করি—যা ওরা খায়। তার মধ্যে আমি সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙুরের বাগান এবং বইয়ে দিই ঝরনা, যাতে ওরা এর ফলমূল খেতে পারে—যা ওদের হাতের সৃষ্টি নয় । তবু ওরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না? পবিত্র-মহান তিনি যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং ওরা যাদের জানে না তাদের প্রত্যেককে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ২৮–৩৬)


ফেরাউন স্ত্রীর জান্নাত লাভ

সুরা তাহরিম পবিত্র কোরআনের ৬৬ তম সুরা। এর ২ রুকু, ১২ আয়াত। তাহরিম মানে হারাম মনে করা। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা তুমি কেন হারাম মনে করো।’

আসরের নামাজের পর রাসুল (সা.) তাঁর পত্নীদের সঙ্গে অল্পক্ষণের জন্য হলেও দোয়া করতেন। মধু পান করার জন্য জয়নাবের (রা.) গৃহে তিনি একাধারে অবস্থান করায় বিলম্ব হলে তাঁর অপর দুই স্ত্রী আয়েশা (রা.) ও হাফসা (রা.) অনুযোগ করেন। এতে রাসুল (সা.) আর মধু খাবেন না বলে শপথ করেন। এই প্রেক্ষাপটে সুরাটির অবতারণা।

আয়েশা ও হাফসাকে (রা.) এ সুরায় তওবা করে পারিবারিক জীবনে শান্তি আনার উপদেশ দেওয়া হয়। নুহ (আ.) ও লুত (আ.)-এর স্ত্রীদের উল্লেখ করে এতে বলা হয় যে তাঁরা নবী (সা.)–এর পত্নী হওয়া সত্ত্বেও নিজের কর্মের জন্য নরক ভোগ করেছিল। অন্যদিকে ফেরাউনের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সৎ কর্মের জন্য তার স্ত্রী জান্নাত লাভ করেন।

এ সুরায় আল্লাহর দেওয়া হালালকে হারাম করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, কেন তুমি তা নিষিদ্ধ করছ তোমাদের স্ত্রীদের খুশি করার জন্য? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (আয়াত: ১)এর পরের আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে কেউ কোনো হালালকে নিজের ওপর হারাম করার শপথ করলে অবশ্যই তাকে সে শপথ ভাঙতে হবে। সে শপথ ভাঙার কাফফারা আদায় করে আল্লাহর আরোপ করা হালালকে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের শপথ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আল্লাহ তোমাদের সহায়। আর তিনি সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী। (আয়াত: ২)

জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করা ইমানদার পুরুষের দায়িত্ব। এই সুরায় আছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যার নিয়ন্ত্রণভার অর্পিত আছে নির্মম হৃদয় কঠোর স্বভাব ফেরেশতাদের ওপর, যারা আল্লাহ তাদেরকে যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না ও যা আদেশ করা হয়। তা-ই করে।’ (আয়াত: ৬)আসিয়া বিনতে মুজাহিম ছিলেন প্রাচীন মিসরে ফেরাউনের স্ত্রী ছিলেন। এক আল্লাহ্‌র ওপর ছিল তাঁর বিশ্বাস। মানুষের প্রতি ছিলেন দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তাঁর স্বামী ফেরাউন নিজেকে খোদা বলে দাবি করত। নিজের স্ত্রী অন্যের উপাসনা করে, এ তথ্য জানতে পেরে ফেরাউন স্ত্রীকে চাপ দেন। আসিয়া অটল। ফেরাউন তখন আসিয়াকে হত্যার আদেশ দেয়। ফেরাউনের সৈন্য-সামন্তরা তাঁর হাত-পা বেঁধে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে ফেলে রাখে। ক্ষতবিক্ষত করা হয় তাঁকে। তবু তিনি ইমান ছাড়েননি। জীবনের বিনিময়ে তিনি ইমান রক্ষা করেন। তিনি আল্লাহর প্রতিবেশী হওয়ার আকুলতা ব্যক্ত করেন।

তাঁর প্রার্থনার কথা সুরায় আছে এভাবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার কাছে জান্নাতে আমার জন্য একটা ঘর তৈরি করো, আমাকে উদ্ধার করো ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে, আর উদ্ধার করো সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায় থেকে।’ (আয়াত: ১১)

সুরার শেষে ফেরাউনের স্ত্রী ছাড়াও আরেকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি হজরত নুহ (আ.)–এর অবিশ্বাসী স্ত্রী। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ অবিশ্বাসীদের জন্য নুহের ও লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন। ওরা ছিল আমার দুই সৎ কর্মপরায়ণ দাসের অধীন। কিন্তু ওরা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাই নুহ ও লুত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না। আর ওদেরকে বলা হলো, যারা জাহান্নানে ঢুকবে, তাদের সঙ্গে তোমরাও সেখানে ঢোকো।’ (আয়াত: ১০, সুরা তাহরিম, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)


Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট