রুপান্তরের একটি উদাহরণ

 


আমি আপনাদের রুপান্তরের একটি উদাহরণ দিতে চাই। রুপান্তরের দৃশ্যমান উদাহরণ।

এটার ক্ষেত্রে কল্পনা করুন যে আয়াতটির সাথে একটি ক্যামেরা আছে।هُوَ الَّذِى يُسَيِّرُكُمْ فِى الْبَرِّ وَالْبَحْرِ - তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য স্থলে সফর করা সহজ করে দেন, আর সমুদ্রেও। (10:22) তো যখন পড়লেন “স্থলে ও সমুদ্রে” তখন কী কল্পনা করলেন? মূলত কল্পনা করলেন কোনো তীর কিংবা বন্দর বা সমুদ্রসৈকত। কেন? কারণ আপনি স্থল দেখতে চান আবার সমুদ্রও দেখতে চান একইসাথে। حَتّٰىٓ إِذَا كُنتُمْ فِى الْفُلْكِ - যতক্ষণ না আপনি জাহাজে উঠে চড়েন। আর যখন জাহাজে ওঠেন তখন আপনি জাহাজ-ঘাট থেকে বন্দরে যান, এরপর জাহাজে উঠে যান। তো জাহাজটি মোটামুটি এখনো স্থলের সাথে সংযুক্ত। وَجَرَيْنَ بِهِم - এরপর জাহাজটি, তাদের নিয়ে পাল তুলে ভেসে চলে যায় بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ - অনুকূল হাওয়াতে। তো কী কল্পনা করছেন? একটি বন্দর, আলোকিত দিন! মানুষজন জাহাজে চড়ছে। জাহাজ ভেসে যাচ্ছে। বাতাসও অনুকূল। সেই বাতাস পালে আটকে জাহাজগুলো দ্রুত গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। খুব সুন্দর দৃশ্য। আর তাদের গতিও ভালো, সুন্দর বাতাসের কারণে। بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ আচ্ছা। وَفَرِحُوا بِهَا - আর তারা বাতাসের প্রতিও সন্তুষ্ট। কি অসাধারণ দৃশ্য! সূর্যস্নাত আকাশ। পানিতে আলোর ঝটা। খুব সুন্দর বাতাস। সবাই হাসিখুশি। এটা সবচাইতে অসাধারণ সমুদ্রভ্রমন হবে। আমার জীবনের স্মরণীয় ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। জাহাজ এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন আর উপকূল দেখা যাচ্ছে না। এরপর جَآءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ - হঠাৎ করেই, কোথা থেকে ঘূর্ণিঝড় বা হারিকেনের মতো বাতাস এসে তাদের আক্রমণ করলো। তাদের দিকে আসছে তা। আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। বাতাস ঝড়ো হচ্ছে। জাহাজগুলো এদিক সেদিক চলে যাচ্ছে। وَجَآءَهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ - বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ চারদিক থেকে তাদের উপর আছড়ে পড়ছে। তারা কি তীরের কাছেই এখন নাকি গভীর সমুদ্রে? গভীর সমুদ্রে। আচ্ছা। এখন শুনুন। حَتّٰىٓ إِذَا كُنتُمْ فِى الْفُلْكِ পেছনে ফিরে যাই। আল্লাহ তা’আলাই স্থলে আর সমুদ্রে সফর করা সহজ করেছেন, তোমাদের জন্য! يُسَيِّرُكُمْ তোমাদের জন্য! “তোমাদের” হলো কাছে। “তোমাদের” শব্দটি নিকটবর্তী। “তারা” শব্দটি দূরবর্তী। “যতক্ষণ না তোমরা জাহাজে উঠছ।” “তোমাদের” শব্দটি মানে কি? “তোমাদের” মানে নিকটে। وَجَرَيْنَ بِهِم এরপর বাতাস বা জাহাজগুলো ভেসে চললো তোমাদের সাথে না, “তাদের” সাথে। কী হলো মাত্র? আপনারা স্থল থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। جَآءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَآءَهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ - এরপর বাতাস এলো। জাহাজের দিকে এলো। আর ঢেউ তাদের আঘাত করলো। ঢেউ জাহাজে আঘাতের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। ঢেউ মানুষদের উপর আঘাত করলো। جَآءَهُمُ কিন্তু 'জাআহুন্না' বা 'জাআহা' না। (আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী 'জাআহুন্না বা 'জাআহা' হলে জাহাজ বুঝাতো)। কিন্তু বলা হয়েছে 'জাআহুম'। বরং جَآءَهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ - এর মানে ঢেউ আসছে, আর জাহাজে অবস্থানরত যাত্রীদের উপর সেটা আঘাত করেছে। আর তারা এদিকে একবার যাচ্ছে আর ওদিকে আরেকবার যাচ্ছে। جَآءَهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ কিন্তু তারা কি কাছে নাকি তারা দূরে? তারা অনেক দূরে, সমুদ্রের মাঝখানে। আর দূরত্বটি “তাদের” শব্দের মাধ্যমে চলে এসেছে। দেখুন আয়াতটি শুরু হচ্ছে নিকটবর্তী “তোমরা” থেকে, আর বদলে গেলো “তারা”য়। এখন তারা সমুদ্রের মাঝখানে। وَظَنُّوٓا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ তারা বুঝতে পারলো তাদের ধ্বংস অনিবার্য। এই ঢেউগুলো তাদের ঢেকে ফেলবে। আর একটি সুনামি, আর একটি বিশাল ঢেউ, তারা শেষ! সব শেষ। কারণ এর আগের ঢেউটি এতোকিছু ধ্বংস করেছে যে পরেরটি সব নিঃশেষ করে দেবে। এরপর… دَعَوُا اللّٰهَ এখন ক্যামেরা জাহাজের উপর। এই লোকগুলো বুঝতে পারছে তারা মারা যাবে। তারা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরলো। مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ "তাঁর প্রতি তাদের দ্বীনকে আন্তরিক করে।" প্রথমবারের মতো তাদের আর তাদের দোয়ার মধ্যে কোনই বাধা নেই। দোয়ার সময় তারা কোন মুভির কথা ভাবছে না। তারা ভাবছে না কোন গানের লিরিক। তারা দুপুর বা রাতের খাবারের কথা ভাবছে না দুয়ার সময়। তারা পাশেরজনের তাশাহুদে আঙ্গুল নাড়ানো দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তারা সে লোকের দিকে তাকাচ্ছে না যে নিজের দাঁড়ি চুলকাচ্ছে। এসব কিছুই না। এইবার তাদের দোয়াটি শুধুমাত্রই আল্লাহ্‌র জন্য। আর কোনই বাধা নেই। আপনি ভাবতে পারেন, এমন এক সময়ে যখন ঢেউ, সমুদ্র আর মানুষের চিৎকার… মনোযোগ ব্যহত হবার কতো কিছুই আছে। কিন্তু এই প্রথমবার যখন মৃত্যু এতো কাছে চলে এলো, এসব কিছুই মনোযোগ সরানোর জন্য যথেষ্ট হলো না। مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ আন্তরিক, খাঁটি। শুধুই তাঁর জন্য! এই সময়ে তারা কী বলছে? এখন আল্লাহ ক্যামেরা সে লোকের দিকে নিলেন যে জাহাজের মধ্যে দোয়া করছে, যে এখনই ডুবে যাবে। পানি তার গলা পর্যন্ত চলে এসেছে। সে এভাবে দোয়া করছে। সে বলছেঃ لَئِنْ أَنجَيْتَنَا “যদি আপনি আমাদের রক্ষা করেন, مِنْ هٰذِهِ এই বিপদ থেকে; لَنَكُونَنَّ مِنَ الشّٰكِرِينَ আমরা অবশ্যই, আমরা কসম করছি, কসম করছি! একেবারেই ইয়া আল্লাহ! আমি কথা দিচ্ছি! কথা দিচ্ছি! কথা দিচ্ছি! আমি অনেক কৃতজ্ঞ হবো! আমি কৃতজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।” খেয়াল করুন, তারা বলেনি لَنَكُونَنَّشّٰكِرِينَ তারা বলেছিল لَنَكُونَنَّ مِنَ الشّٰكِرِينَ তারা বলেনি, “আমরা কৃতজ্ঞ হবো”। তারা বলেছে, “আমি কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো।” দুটো ভিন্ন জিনিস। ঠিক কি না? যখন বলেন, “আমরা কৃতজ্ঞ” তখন শুধু নিজের কথা হলো। কিন্তু যখন “কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত” বলেন এর মানে, তারা যখন স্থলে ছিল তখন কৃতজ্ঞ লোকদের চিনতো। কিন্তু তাদের মতো কখনো হতে চাইতো না। “ইয়া আল্লাহ, আমি আমার ভাইয়ের মতো হব এখন থেকে।” “ইয়া আল্লাহ, আমি আমার মায়ের মতো হব এখন থেকে।” তাদের সামনে নমুনা ছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি। যখন ঢেউ এলো তখন বললো, “ইশ যদি আমার ভাইয়ের মতো হতাম!” দেখলেন? لَنَكُونَنَّ مِنَ الشّٰكِرِينَ কিন্তু জানেন কি, ক্যামেরাটি ভালো করে লক্ষ্য করুন, ক্যামেরা আপনাকে স্থল দেখালো, এরপর দেখালো সমুদ্র। এরপর দেখালো জাহাজ, এরপর দেখালো আপনাকে, যখন জাহাজে উঠছিলেন। ক্যামেরা তখন আপনার কাছেই। এরপর ক্যামেরা স্থলেই বসে থাকলো কিন্তু জাহাজটি চলে গেলো। তখন দূর থেকে দেখতে পেলেন ঢেউ উঠে আসছে সবদিক থেকে। এরপর ক্যামেরা জাহাজের উপর zoom-in করলো আর আপনি দেখতে পেলেন কিছু মানুষ দোয়া করছে। এরপর আরও zoom-in করলো যে আপনি তাদের দোয়াটি সমুদ্রের এতো শব্দের মাঝেও শুনতে পাচ্ছেন। তারা আল্লাহ্‌কে বলছে, যে তারা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কুরআনের এই ক্যামেরা transitions গুলো! … … … আসলে আমি শুধু ক্যামেরা বলতে পারছি কারণ যখন আপনি কোন মুভিতে ক্যামেরার ভালো কারসাজি দেখতে পান, অবাক হয়ে যান। কারণ এসবে আপনাকে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে এরপর আরেক দৃশ্যে নিয়ে যায়। আর আপনি অবাক হয়ে দেখতে থাকেন। তাই না? আর এখানের transition টা, এটা এসেছে চৌদ্দশ বছর আগে! এই ক্যামেরার কাজ! একটি আয়াতের ভেতর! সুবহানাল্লাহ!! - নোমান আলী খান - ডিভাইন স্পীচ ৬ এর অংশবিশেষ নিজেকে এমন একটি পরিস্থিতিতে কল্পনা করুন। মনে করুন আপনি এরকম ডুবে যাচ্ছিলেন, এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, ওয়াদা করেছেন যে— আল্লাহ যদি আপনাকে রক্ষা করেন তাহলে আপনি কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন। এখন সে ওয়াদা রক্ষা করুন। আপনার পরিচিতদের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ, ভালো ঈমানদার তাদের মত হয়ে যান। নিজের মাঝে কাঙ্খিত পরিবর্তন নিয়ে আসুন। কারণ, বিশ্বাস করুন এর চেয়েও ভয়াবহ এক বিপদের মধ্যে আমরা সবাই পড়তে যাচ্ছি। সেদিন হল শেষ বিচারের দিন। সেদিনও আমরা মরিয়া হয়ে আবার পৃথিবীতে আসতে চাইবো। সেদিনও আমরা বলব, ইয়া আল্লাহ! যদি আমাকে আরেকবার সুযোগ দেন, আমি একেবারে সবচেয়ে সেরা বিশ্বাসিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। মুহসিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। যারা এমন ভাবে আল্লাহর ইবাদত করত যেন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেদিন এ দোয়া কবুল করা হবে না। তাই পরিবর্তনের সময় এখনই। ডক্টর আকরাম নদভী এক আলোচনায় বলেছেন, "কোরআনের কাছে আমরা শুধু সমাধান খোঁজার জন্য যাব না বরং কোরআন থেকে আমরা আমাদের সমস্যাটাও খুঁজে বের করব। আর কোরআন মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করেছে জাহান্নামকে।" শুধু চিন্তা করে দেখুন মিলিয়ন মিলিয়ন বছর জাহান্নামের আগুনে পোড়ার চাইতে বড় কি বিপদ একজনের উপর আসতে পারে? এর চেয়ে ভয়াবহ বিপদ কি আর কিছু হতে পারে? তাই এটাকে আপনার সমস্যা হিসেবে আইডেন্টিফাই করুন। আর জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য এখনই তাওবা করুন আল্লাহর পথে ফিরে আসুন।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট