সূরাতুল হাক্কায় প্রথম আয়াত ,একটি শব্দ "আল-হাক্কাহ"

 


আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা সূরাতুল হাক্কায়, সূরাটি শুরু করেন খুবই অদ্ভুত এক প্রশ্ন দিয়ে। বস্তুতঃ এটি একটি বিবৃতি। প্রথম আয়াত শুধু একটি শব্দ "আল-হাক্কাহ"। যার কয়েকটি অর্থ আছে। কিন্তু খুব সহজে অর্থটাকে এভাবে ভাবতে পারেন-- রিয়্যালিটি বা বাস্তবতা। আল্লাহ বলেছেন, বাস্তবতা। "মালহাক্কাহ।" বাস্তবতা কী? "ওয়া মা আদরা-কামাল হাক্কাহ।" আর কীসে তোমাকে জানাবে যে বাস্তবতা কী জিনিস।

সেই প্রশ্নটি করার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ এই সূরাতে দাবী করছেন যে, অধিকাংশ মানুষ বাস্তবতায় বাস করে না। অধিকাংশ মানুষ তাদের নিজস্ব ভার্সন নিয়ে উপস্থিত হয়-- কোনটা বাস্তব এবং কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটাই ঠিক করে দেয় তাদের যাপিত জীবনটি কেমন হবে। তাই, আল্লাহ এই সূরায় প্রত্যেকটি মানুষকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, তারা যেন একটু পেছনে সরে গিয়ে আবারো "বাস্তবতা" নিয়ে একটু চিন্তা করে। আমরা সকালে জেগে উঠি। নিজেদের চেতনা পুনরায় ফিরে পাই। তৎক্ষণাৎ খুবই বাস্তব কিছু কাজ আমাদের সামনে পড়ে থাকে। আছে চাকরি, আছে পরিবার, আছে দায়-দায়িত্ব। এখন আরও আছে সেহরি। এভাবে বিভিন্ন কাজ-কর্মে আমরা প্রত্যহ জড়িয়ে পড়ি। দৈনন্দিন কাজকর্ম। এক কাজ শেষ হলে আরেকটা এরপর আরেকটা। বার বার ঘড়ির দিকে তাকান যেন সময়ের হিসেবটা রাখতে পারেন। যেন দিনের বেলা আপনার যে বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আছে তা শেষ করতে পারেন। আমরা এসব খুঁটিনাটি দৈনন্দিন কাজে এতো বেশি জড়িয়ে পড়ি যে, একটু থেমে বড় চিত্রটার দিকে আর দৃষ্টি প্রদান করি না। এটি খুবই কমন একটি প্রবণতা যা সকল মানুষের মাঝে দেখা যায়। আমরা দৈনিক কাজগুলোতে এতো বেশি আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারি যে, পেছনে সরে বড় চিত্রটার দিকে আর ভ্রুক্ষেপ করি না। নিজেদের বড় কোনো প্রশ্ন করি না। আমার জীবনটা কোন দিকে এগুচ্ছে। কারণ, আপনি দৈনন্দিন জিনিসগুলোতে এতো বেশি ব্যস্ত! এ ব্যাপারটা এমনকি ব্যবসার দুনিয়াতেও ঘটে। যেমন--একটি কোম্পানিতে থাকে একাউন্টেন, ইঞ্জিনিয়ার... আরও অনেকে। তারা সকালে উঠে অফিসে যায়, নিজের করণীয় কাজটা করে। কিন্তু সবাই যদি শুধু দৈনন্দিন কাজগুলো করতে থাকে তাহলে একটি কোম্পানি বাঁচতে পারবে না। কাউকে না কেউকে ম্যানেজমেন্টে থাকতে হবে যিনি বলবেন-- না, আমাদের ছয় মাসের টার্গেট আছে। আমাদের এক বছরের টার্গেট আছে। কারো মাথায় বড় চিত্রটা থাকতে হবে। এর উপরে আছে এক্সিকিউটিভ। এর উপরে আছে স্ট্রাটেজিস্ট, এনালিস্ট এবং অন্যরা। যাদের কাছে থাকে আগামী পাঁচ বছর, দশ বছরের প্ল্যান। কারণ শুধু ছোট ছোট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজগুলো করার মাধ্যমে ভিশন ঠিক রাখতে পারবেন না। সামনে কী আসছে। সবার শেষে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। তো, আমাদের ছোট ছোট কাজগুলো আরও বিশাল বিশাল ব্যাপারের সাথে জড়িয়ে থাকে। তাই না? আল্লাহ প্রকৃতির মাঝে এ ব্যবস্থাপনাই সৃষ্টি করেছেন। উদাহরণস্বরূপ মৌমাছি, পিঁপড়া এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের মাঝেও দেখা যায় তারা ছোট ছোট কাজ করে। প্রত্যেকটি পিঁপড়া জানে তাকে কী করতে হবে বাসা তৈরির জন্য। প্রতিটি মৌমাছি জানে তাকে মৌচাকের কোন অংশে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকেই নিজের ছোট কাজটার কথা জানে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ডিজাইন করেছেন আরও বড় কিছু নির্মাণের জন্য, তাদের প্রত্যেকের করণীয় ছোট ছোট কাজগুলোর চেয়েও। তারা আরও বৃহৎ কিছুর অংশ। এটা এক ধরণের উপায় যেভাবে আমরা চিন্তা করতে পারি "বাস্তবতা" আসলে কী জিনিস। এই ছোট ছোট কাজগুলো যে আমরা করি, এগুলো যদি আরও বৃহৎ কিছুর সাথে সংযুক্ত না থাকে, তাহলে আমাদের কাছে "বাস্তবতার" প্রকৃত উপলব্ধি নেই। তবে আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো সংযোগহীন। তাই, আল্লাহ এই সূরাতে কী করলেন? তিনি বিভিন্ন উপায়ে "বাস্তবতার" প্রশ্নটাকে বিশ্লেষণ করলেন। আমি এখন যা করবো--এই বিশ মিনিটের কম সময়ে-- ঐ চিত্রগুলোর একটি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। যখন আমাদের জীবনের এই সমস্ত ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর সমাপ্তি আসবে, অতি সত্বর অথবা পরে একসময়, আমরা মাটির নিচে চলে যাবো। এরপর চরম সত্য ঘটনা, চূড়ান্ত বাস্তবতা আরম্ভ হবে। সেই বাস্তবতায় সবকিছু উল্টে যাবে। এখানে, এই দুনিয়াতে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজগুলো বড় কিছুর দিকে নিয়ে যায়। এভাবেই এ দুনিয়া কাজ করে। আপনি ছোট ছোট কাজ করেন। এমনকি যদি বিশাল কোনো দালান নির্মাণ করতে চান, আপনাকে ফাউন্ডেশন দিয়ে শুরু করতে হবে। একটি একটি করে ইট গাঁথতে হবে। একটি করে কাঠের টুকরা, একটি করে পেরেক...অবশেষে তা বড় কিছুতে পরিণত হবে। কিন্তু শেষ বিচারের দিন সবকিছু উল্টে যাবে। প্রথমে বড় কিছু ঘটবে, যা ছোট কিছুর দিকে নিয়ে যাবে। এ চিত্রটাই আল্লাহ তুলে ধরেছেন এবং কীভাবে সেদিন ট্রু রিয়্যালিটির অভ্যুদয় হবে। তো, আজকের খুৎবায় আমি আপনাদের জন্য সংক্ষেপে সেই চিত্রটি আঁকার চেষ্টা করব। সাধারণত খুৎবায় আমি একটি বা দুইটি আয়াতের উপর ফোকাস করি। কিন্তু ইনশাআল্লাহ, আজ আমি এক গুচ্ছ আয়াত, কতগুলো আয়াতের সমষ্টির দিকে একত্রে দৃষ্টি দিবো। আমরা আল্লাহর অঙ্কিত চিত্রটি বুঝার চেষ্টা করবো, ঐ চূড়ান্ত বাস্তবতার চিত্রটি। দোয়া করছি, আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সেদিন সফলতা দান করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-- فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ نَفۡخَۃٌ وَّاحِدَۃٌ- "অতঃপর যখন শিংগায় ফুঁৎকার দেয়া হবে- মাত্র একটি ফুঁৎকার।" (৬৯:১৩) শিংগায় ফুঁৎকার দেওয়ার ধারণাটা...আমরা জানি কিয়ামতের দিন দুইবার ফুঁৎকার দেওয়া হবে। আল্লাহ দুইটি হর্নের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এখন, আল্লাহ উভয় চিত্রকে এই সূরায় একত্রিত করে দিলেন। তিনি এখানে যা করছেন, এমনকি 'শিঙ্গা' শব্দটি উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে... এটা কিছু কনসেপ্ট মাথায় নিয়ে আসে। মানুষের স্মৃতিতে, যদি প্রাচীন আরবের অমুসলিম কারো সাথে কথা বলতেন...কুরআন নাজিলের সময়কালে কুরআনের শ্রোতাদের অধিকাংশই মুসলিম ছিল না। সেসময়ের মক্কায়। বেশিরভাগই মুসলিম ছিল না। আর তারা এ কথাগুলো শুনছিল। তারা যখন 'শিঙ্গা' শব্দটি শুনত তারা কী ভাবত তখন? তারা আখিরাত নিয়ে চিন্তা করতো না, তারা গায়েব নিয়ে আমাদের মুসলিমদের মত ভাবত না। তাদের ভাবনাটা ছিল তারা যখন যুদ্ধ করতে যেতো, একজন বিউগল বা শিঙ্গা মুখে তুলে ফুঁৎকার দিতো, সাথে সাথে ঘুমন্ত সৈন্যরা সবাই জেগে উঠত আর যুদ্ধের জন্য লাইন ধরে প্রস্তুত হয়ে যেতো। কারণ যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। সতর্ক সংকেত প্রদানের সময় এটা। বর্তমানেও মিলিটারি ব্যারাক মিলিটারি ক্যাম্প ইত্যাদিতে অ্যালার্ম সিস্টেম, সাইরেন বা হর্ন বেজে উঠলে প্রতিটি সৈন্য জানে তাকে এক্ষুনি প্রস্তুত হতে হবে, ইউনিফর্ম পরতে হবে এবং রেজিমেন্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এমনকি যদি দশ হাজার সৈন্যও হয়, বিশ হাজার সৈন্যও হয়, প্রত্যেকে তার করণীয় সম্পর্কে জানে। তারা এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে থাকে না। সবাই নিজ নিজ রেজিমেন্টে সুশৃঙ্খলভাবে দণ্ডায়মান। হর্নের আওয়াজ প্রসঙ্গে বলতে গেলে, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কুরআনের অন্যত্র বলেন-- وَ مَا یَعۡلَمُ جُنُوۡدَ رَبِّکَ اِلَّا هُوَ - তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। (৭৪:৩১) এই হর্ন বেজে উঠলে আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি এমনভাবে আচরণ করবে যেন তারা রিজার্ভ সৈন্য, এই সিগনালের অপেক্ষায় ছিল, নিজ নিজ পজিশনে প্রস্তুত হতে। সকল সৃষ্টি প্রস্তুত, আল্লাহর সকল ফেরেশতারা, আকাশমণ্ডলী, মেঘমালা, পৃথিবী সবাই একই পজিশনে মুভ করবে, এই মহাঘটনা সঙ্ঘটনের জন্য। এই উপস্থাপনার জন্য। তো, ঠিক এরপরেই আল্লাহ বর্ণনা করেন-- فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ نَفۡخَۃٌ وَّاحِدَۃٌ - وَّ حُمِلَتِ الۡاَرۡضُ وَ الۡجِبَالُ - ..."জমিন এবং পর্বতমালাকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে, বহন করা হচ্ছে।" জমিন এবং পর্বতমালাকে বহন করার ধারণাটা অদ্ভুত। কারণ, এখন তারা সবকিছু বহন করে। জমিন আমাকে আপনাকে বহন করে। জমিন আমাদের বাড়ি বহন করে। জমিন সবকিছু বহন করে। আর পাহাড়-পর্বত বহন করে বিভিন্ন গাছপালা, পাথর এবং এর উপর স্থাপিত অন্যসবকিছু। তাদেরকে কেউ বহন করে না। তারা সবাইকে বহন করে। আল্লাহ ইতোমধ্যেই এমন একটি দৃশ্য বর্ণনা করছেন যেখানে আমরা যা কিছুকে বাস্তব ভাবতাম, তাকে উল্টে ফেলা হচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে উল্টো করে ফেলা হচ্ছে। তো, জমিনকে উত্তোলন করা হবে, বহন করা হবে। এর সাথে পর্বতগুলোকেও বহন করা হবে। এটা আরও ইঙ্গিত করে যে, আমরা যাকে মনে করতাম এটা সবসময় নিজ স্থানে বর্তমান থাকবে, আমরা যাকে ভাবতাম এর ওজন আছে, দেখা যাচ্ছে এরাই ওজন হারিয়ে ফেলছে। এদেরকেই তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। فَدُکَّتَا دَکَّۃً وَّاحِدَۃً - আর একই আঘাতে তাদেরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হবে। ফলে এরা সমান হয়ে যাবে। ধরুন, হাতের মধ্যে ভেজা নরম ডো নিলেন এরপরে সজোরে নিক্ষেপ করলেন, তখন এটা সমান হয়ে যায়। এ ধারণাটাই আল্লাহ বর্ণনা করছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা এরকম হবে। তো, পৃথিবীর উঁচু নিচু সব হারিয়ে যাবে। কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন– وَ اِذَا الۡاَرۡضُ مُدَّتۡ - যখন পৃথিবীকে টেনে সমান করে ফেলা হবে। (৮৪:৩) অন্য সূরাতে এসেছে-- যখন সমুদ্রগুলো ফুটতে থাকবে। সুরাতুল কাহাফে তিনি একে বর্ণনা করেছেন- صَعِیۡدًا جُرُزًا -হিসেবে। সমতল ভূমি। পিচ্ছিল ভূমি। আর এখানে তিনি বলছেন, এটাকে সজোরে নিক্ষেপ করে সমান করে ফেলা হবে। এখন, কোনো কিছুকে সমান করে ফেলার অর্থ হলো, একটি মাঠ তৈরি করা হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীকে কেন সমতল ভূমিতে পরিণত করে ফেলা হচ্ছে? আয়াতগুলো অগ্রসর হতে থাকলে আমরা দেখবো যে, একটি দৃশ্য উন্মোচিত হচ্ছে। তিনি বলেন-- فَیَوۡمَئِذٍ وَّقَعَتِ الۡوَاقِعَۃُ -- ঐদিন আসল ঘটনা সংঘটিত হবে। তিনি ইতোমধ্যেই বলেছেন আল-হাক্কাহ। আর এখন বলছেন আল-ওয়াকিয়াহ। আল-ওয়াকিয়াহ দারুণ আকর্ষণীয় একটি শব্দ। কারণ এটি এসেছে 'ওয়াকি (وقع)' থেকে। ‘ওয়াকি’ অর্থ ভারী ওজন। এর অর্থ বিশাল ওজন। তো আল্লাহ বলেছেন সেদিন ভারী ওজনের পতন ঘটানো হবে। এটি অদৃশ্য জগত থেকে চূড়ান্ত বাস্তবতা পতিত হওয়ার বা ঘটার এক অভিব্যক্তি। কারণ, সত্য সবসময় ওজনদার হয়। সত্য গুরুতর। সত্যের সারবত্তা আছে। আর মিথ্যা হয় ওজনহীন, ফাঁকা। তো আল্লাহ বলছেন তখন ওজনদার সত্য ড্রপ করা হবে। অর্থাৎ, তখন চূড়ান্ত বাস্তবতার অভ্যুদয় হবে। অতঃপর وَ انۡشَقَّتِ السَّمَآءُ - এতক্ষণ যা বলেছি তা পৃথিবীতে ঘটতে থাকবে। সমগ্র পৃথিবীকে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হবে। এরপর আল্লাহ বলেন, وَ انۡشَقَّتِ السَّمَآءُ - "আকাশকে ছিঁড়ে খুলে ফেলা হবে।" ইনশিকাক শব্দটি ব্যবহার করা হয় যখন একটি কাপড় নিয়ে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেলেন। মাঝখানটা এখন ছিঁড়া। একে বলা হয় ইনশিকাক। আল্লাহ এই শব্দটি ব্যবহার করছেন আকাশের অবস্থা বর্ণনা করতে। وَ انۡشَقَّتِ السَّمَآءُ - এরপর এসেছে-- فَهِیَ یَوۡمَئِذٍ وَّاهِیَۃٌ - এরপর সেদিন এটা খুলে যেতে শুরু করবে। وَّ الۡمَلَکُ عَلٰۤی اَرۡجَآئِهَا - আকাশ যখন খুলে যেতে শুরু করবে, এই ফাটলটা যখন আবির্ভূত হবে, আল্লাহ বলছেন তখন ফেরেশতারা... সম্ভবত জিব্রিল (আ) দিয়ে শুরু হবে। কারণ একবচন ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এটা 'ইসমু জিন্স' যা সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে। যাইহোক ফেরেশতারা আকাশের ঐ উন্মুক্ত অংশে লাইন ধরে থাকবেন। আমি চাই আপনারা গুরুত্ব দিয়ে বুঝুন এখানে কী ঘটছে।

প্রাচীন যুগে যখন সেনাবাহিনী কোনো শহর জয় করতে যেতো...দেখা যেতো প্রাচীন শহরগুলোর চারপাশে বিশালাকারের দেওয়াল তুলে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। তাদের থাকতো প্রকাণ্ড গেইট। তারা গেইটগুলো অত্যন্ত মজবুতভাবে নির্মাণ করতো। কারণ, শত্রুরা তো আর দেওয়াল ভেদ করে আসতে পারবে না, তাদেরকে আসতে হবে গেইট ভেঙ্গে। যদি গেইট ভেঙ্গে ফেলা হয়, গেইট যদি খুলে ফেলা হয়, তার মানে শত্রুপক্ষ শহর জয় করে ফেলেছে। শহরের পতন হয়ে গেলে আগত বাহিনী তথা আক্রমণকারী বাহিনী গেইটের পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায়। সেনাপতিকে স্বাগত জানানোর জন্য বা বিজয়ী রাজাকে স্বাগত জানানোর জন্য। বিজয় উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তাই না? আয়াতগুলোর ভাষাতে ঠিক এরকম একটি চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। শুরুতে জমিনকে সমতল করা হচ্ছে, এরপর আকাশকে ছিঁড়ে খুলে ফেলা হচ্ছে। আচ্ছা, আকাশ ছিঁড়ে খুলে ফেলা বলতে কী বুঝানো হচ্ছে? আপনাদের কেউ কেউ সাইন্সের ছাত্র, বা বাচ্চারা যারা সাইন্সে পড়ে জানে যে, আকাশ তো খালি জায়গা। এটা তো ফাঁকা। ছিঁড়ে খুলে ফেলা বলতে কী বুঝাচ্ছেন? আল্লাহ এখানে যা বর্ণনা করছেন তা খুব সহজে ডাইমেনশন দিয়ে বুঝতে পারবেন। আমরা আছি দৃশ্যমান ডাইমেনশনে, যেখানে আমরা একে অপরকে দেখতে পারছি। আমরা ভাবছি এটাই বাস্তব। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের সাথে ফেরেশতারা আছেন। ঠিক এই মুহূর্তে কিরামান কাতেবিন মর্যাদাবান ফেরেশতারা আমাদের সবকিছু লিখে রাখছেন। একটি খাতায়। এটি এমনকি কালি দিয়ে লেখা হচ্ছে না। এটি কিতাবুম মারকুম, পেইজগুলোতে সেলাই করা হচ্ছে। কারণ, কালির ক্ষেত্রে যদি পানি পড়ে লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে বা আঙুল দিয়ে ঘষা দিলেও দাগ পড়ে যেতে পারে। কিন্তু লেখা যদি সেলাই করা হয়, আমরা যাকে বলি এমব্রয়ডারি, আমাদের কাজগুলোকে পাতাগুলোতে এমব্রয়ডারি করে নথিভুক্ত করা হচ্ছে। "কিতাবুম মারকুম।" আরবিতে এর নাম 'রকম।' এভাবেই রেকর্ড রাখা হচ্ছে। এটা ঠিক এখনি ঘটছে কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। কারণ এটা ঘটছে একটি পর্দার ওপারে। এই পর্দার নাম হলো গাইব। গাইবের পর্দা। এ জন্য গাইবের ধারণাটা...কী ঘটবে বিচার দিবসে? فَكَشَفۡنَا عَنۡكَ غِطَآءَكَ ফাকাশাফ-না আনকা গিতাআক।(৫০:২২) সূরা কাফে যেমন এসেছে। তিনি বলেছেন, আমি পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। তোমার সামনে যে পর্দা ছিল তা আমি সরিয়ে দিয়েছি। অতএব, এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে একটি পর্দা আছে। যা আমাকে অদৃশ্য জগত দেখতে বাধা দিচ্ছে। ঠিক একইভাবে, যখন কোনো ডাক্তারের কাছে যান, উনারা যখন এক্সরে করেন, তারা এক্সরে মেশিনের ভেতর দিয়ে এমন কিছু দেখেন যা আমি আপনি এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না। একটি লেন্স থাকে, একটি ডিভাইস থাকে যা অদৃশ্যের পর্দা দূর করে দেয়। ফলে আপনি শরীরের ভেতরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছেন যা অন্যথায় দেখা সম্ভব ছিল না। একই ব্যাপার মিলিটারি প্রযুক্তিতেও দেখা যায়। তারা থার্মাল গগলস পরিধান করে। যেটা দিয়ে আপনি দেয়াল ভেদ করে দেখতে পাবেন যে, অন্যপাশে কতজন লোক আছে বা এরকম কিছু। তো, ধারণাটা অনেকটা এরকম।

আল্লাহ বলছেন অদৃশ্যের পর্দা ছিঁড়ে খুলে ফেলা হচ্ছে। অদৃশ্যের ওপারে কী আছে? ফেরেশতারা। অদৃশ্য জগত। তারা তখন দৃশ্যমান জগতে প্রবেশ করতে থাকবেন। তখন প্রথমবারের মত মানব জাতি ফেরেশতাদের দেখতে পাবে। শেষ বিচারের দিন। আকাশ ছিঁড়ে যে গেইটটি খুলে ফেলা হয়েছে, আল্লাহ বলছেন ফেরেশতারা ঐ গেইটের সকল পাশে লাইন ধরে উপস্থিত হবেন। "وَّ الۡمَلَكُ عَلٰۤی اَرۡجَآئِهَا" ওয়াল মালাকু আরজা-ইহা। وَ یَحۡمِلُ عَرۡشَ رَبِّكَ فَوۡقَهُمۡ یَوۡمَئِذٍ ثَمٰنِیَۃٌ - "এবং আরশ, আল্লাহর রাজসিংহাসন সেদিন বহন করা হবে আটজন দিয়ে।" এই আটজন কারা সে বিষয়টা আল্লাহ বর্ণনা করেননি। কিন্তু মুফাসসিরগণ বলেন উনারা আটজন বিশেষ ফেরেশতা। যারা আল্লাহর আরশ বহন করার দায়িত্বে নিয়োজিত। আল্লাহর আরশের একটি ভার্সন সেদিন বহন করে আনা হবে শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য যে রাজাধিরাজ আল্লাহ মানুষের বিচার শুরু করতে যাচ্ছেন। কারণ, আগের যুগে...এখানে প্রতীকের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ-- আগের যুগে গার্ডরা রাজাদের বহন করতো একধরণের ছদ্ম সিংহাসনে। কারণ, আসল সিংহাসনটা অন্য কোথাও আছে। এই বহনযোগ্য সিংহাসনটা আনা হয়েছে শুধু বিচারকার্য পরিচালনার জন্য। যদিও রাজার এখনো আগমন ঘটেনি। কিন্তু সিংহাসন আনা হয়েছে। তো وَ یَحۡمِلُ عَرۡشَ رَبِّكَ فَوۡقَهُمۡ یَوۡمَئِذٍ ثَمٰنِیَۃٌ - আর্মিরা গেইট খুলে ফেলেছে, সিংহাসন আনা হয়েছে আটজন দিয়ে। এই আটজন কি ফেরেশতা? নাকি আল্লাহর অন্য কোনো সৃষ্টি? আলী (রা) সহ অন্যরা বলতেন, আট বলতে কি আটজন? নাকি আট হাজার? নাকি আট লিজন বুঝানো হয়েছে? মা হিয়া হা-জিহিস সামা-ন। আমরা জানি না এই আট কারা। এটা আল্লাহ আমাদের জানান নাই। তো তিনি বলেন- یَوۡمَئِذٍ تُعۡرَضُوۡنَ - এতোসব কিছু কেন ঘটছে? কেন সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে সজোরে সমান করে ফেলা হচ্ছে? কেন আকাশ ছিঁড়ে খুলে ফেলা হচ্ছে? হঠাৎ করে কেন ফেরেশতারা সব উপস্থিত হচ্ছেন? কেন সিংহাসন আনা হচ্ছে? এই সমস্ত কিছু কেন ঘটছে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, یَوۡمَئِذٍ تُعۡرَضُوۡنَ - সেদিন তোমাদের সকলকে, তিনি আমাকে বলছেন, আপনাকে বলছেন, সেদিন তোমাদের সকলকে হাজির করা হবে। তু'রাদুন। لَا تَخۡفٰی مِنۡكُمۡ خَافِیَۃٌ -- " তোমাদের কোন গোপনীয়তাই আজ আর গোপন থাকবে না।" তো, আপনারা লক্ষ্য করেছেন, বিশাল বিশাল ব্যাপার ঘটছে। এরপর হঠাৎ করে একেবারে ক্ষুদ্র বিষয়গুলো যা সমগ্র দুনিয়ার কাছ থেকে গোপন ছিল, যা আমি আপনি ছাড়া কেউ জানতো না, যা আমি বলেছি, যা আমি করেছি, যে নিয়ত আমার ছিল...যদিও মানুষ আমার কাজ দেখেছে কিন্তু আমার নিয়ত দেখেনি। ঐটা গুপ্ত ছিল। এমনকি সবাই এখানে নামাজ পড়ার আগে, সবাই সালাতুল জুমুয়ার জন্য বসে আছেন। কিন্তু আমাদের নিয়তগুলো হয়ত অভিন্ন নয়। কারো হয়তো ভিন্ন নিয়ত আছে। আপনি তা দেখতে পান না। আপনার পক্ষে তা দেখা সম্ভব নয়। এটা গোপন। কিন্তু সেদিন কোনো গোপন জিনিসই আর গোপন থাকবে না। কিছুই লুক্কায়িত থাকবে না। কিছু সাহাবা এই আয়াত সম্পর্কে বলেছেন, কারণ সেদিন মানুষের পরনে কোনো কাপড় থাকবে না। কেউ কোনো পরোয়া করবে না। আল্লাহ শুধু মানুষের আমলগুলো উন্মুক্ত করবেন না, আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেও উন্মুক্ত করে দিবেন। তো لَا تَخۡفٰی مِنۡكُمۡ خَافِیَۃٌ --- এখন, ব্যাপারটা যেন এমন, এই যে বিশাল ঘটনা! আকাশ এবং সমগ্র পৃথিবীকে নতুন করে সাজানো হয়েছে, নতুনভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে, এই সমস্ত কিছুর উদ্দেশ্য হলো আমি এবং আপনি। এই সমস্ত কিছুর উদ্দেশ্য হলো যেন আমি আপনি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হই এবং দুনিয়ার সকল কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের সম্মুখীন হই। -- নোমান আলী খান [ শরীরটা কি এখনো কাঁটা দিয়ে উঠেনি। ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! ইন্নাকা আফুউউন কারিম তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্না। ]

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে