আধুনিক দুনিয়ায় যেভাবে ক্ষমতা তৈরি করতে হবে

 


আধুনিক দুনিয়ায় যেভাবে ক্ষমতা তৈরি করতে হবে || নোমান আলী খান

----------------------------------------------------------- মুসলিমরা একটা সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই গত এক বছরে এটা বেশ স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, যদিও আমাদের সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংশেরও বেশি, গণহত্যা বন্ধের জন্য আমাদের সকলের সম্মিলিত কান্না এবং চিৎকার, বাস্তবিক অর্থে কিছুই করেনি। বাস্তবিক অর্থে এটা কিছুই করেনি। আর আমরা সকলেই জানি যে, যা ঘটছে তার জন্য অমুসলিমরা যখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে, তখনই এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পৃথিবী এটাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করেছে এজন্য না যে মুসলিমরা বলছে, “নিরপরাধ বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা অনুচিৎ, হাসপাতালগুলোতে বোমা নিক্ষেপ করা অনুচিৎ, স্কুলে বোমা নিক্ষেপ অনুচিৎ, শরণার্থিদের উপর বোমা নিক্ষেপ অনুচিৎ, নিরপরাধ মানুষকে কারাগারে রাখা অনুচিৎ”। এটা এজন্য গুরুত্ব পায় নি যে, মুসলিমরা এটা বলছে, কারণ মুসলিমরা এটা বলে আসছে গত ৭০ বছর ধরে। বরং এটা এজন্য ঘটেছে যে, কোনো এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী টিকটকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছে, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কি ঘটে যাচ্ছে।” কয়েক মিলিয়ন মানুষ এটা দেখলো, আর এখন এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়ে গেলো। এখন পৃথিবী বলছে যে, “হ্যাঁ, এটা আসলেই একটা সংকট।” জানেন এটা কী প্রমাণ করছে ? এটা প্রমাণ করছে যে, আমরা যতো উচ্চস্বরেই চিৎকার করি না কেন, কেউই তা শুনছে না। কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। জানেন কখন মানুষ গুরুত্ব দেয় না ? যখন আপনার কোনো ক্ষমতা না থাকে। তখনই মানুষ গুরুত্ব দেয় না। যখন ক্ষমতা আপনার কাছে থাকে, তখন আপনি একটি কথা বলেন, আর গোটা পৃথিবীতে কম্পন শুরু হয়ে যায়। যখন আপনার ক্ষমতা না থাকে, যত জোরে সম্ভব আপনি চিৎকার করতে পারেন, কিন্তু এতে কোনো পরিবর্তন আসে না। এতে শূন্য পরিবর্তন আসে। কখনো কখনো আপনার যখন ক্ষমতা থাকে, মুখ খোলারও প্রয়োজন হয় না। আপনা-আপনি কাজ হয়ে যায়। কোনো কোনো মানুষের ক্ষমতা রয়েছে তার পরিবারের মাঝে। আর জানেন সেটা কিভাবে বুঝা যায় ? যখন সে হেঁটে যায়, সকলের আচরণের ধরণ পাল্টে যায়। তাকে কণ্ঠস্বর উঁচু করতে হয় না, তাকে চিৎকার-চেচামেচি করতে হয় না, তাকে কাউকে আঘাত করতে হয় না, কারণ ইতিমধ্যেই তার ক্ষমতা রয়েছে। তো এটা আমাদেরকে উপলব্ধি করায়, আর এটা স্বাচ্ছন্দ দানকারী অনুভূতি না, মুসলিমরা ফিলিস্তিনের এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেদের সম্পর্কে একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, আমাদেরকে এটা স্বীকার করতে হবে, আমাদেরকে আয়নার দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা কতটা ক্ষমতাহীন হয়ে গিয়েছি। এটা কুৎসিত একটা বিষয়, ক্ষমতাহীন বোধ করাটা একটা কুৎসিত বিষয়। বিশেষত পুরুষ মানুষেরা বিষয়টা লক্ষ করুন, যখন আপনি চাকরি খুঁজে না পান, যখন আপনি কাজ পেতে সক্ষম না হন, যখন আপনি নিজ পরিবারের ব্যয় বহন করতে সক্ষম না হন, যখন আপনি এমনকি নিজের দায়িত্বও বহন করতে পারেন না, অন্য কাউকে আপনার দায়িত্ব বহন করতে হয়; আপনি কি বুঝতে পারছেন সেটা কতোটা লজ্জাজনক যখন আপনাকে কারো থেকে টাকা ধার করতে হয় ? যখন আপনি নিজে চাকুরী খুঁজে না পান, যখন আপনার বোন চাকুরী করেন আর তিনি আপনার খরচ প্রদান করেন, সেটা আপনার জন্য কতোটা লজ্জাজনক এবং অপুরুষোচিত ! কারণ عِزُّ الرَّجُلْ إِسْتِغْنَائُهُ عَنِ النَّاسْ - ‘ইয্যুর রজুল ইসতিগনাউহু ‘আনিন্নাস, অর্থাৎ একজন পুরুষের মর্যাদা হলো সে অন্য কারো মুখাপেক্ষি নয়। এটা পুরুষ মানুষের মর্যাদার অংশ। আমাদের যদি ইজ্জত থাকে, আমাদের যদি আত্ম-মর্যাদা থাকে যা আল্লাহ পুরুষ মানুষকে দান করেছেন, সেক্ষেত্রে এটা মৃত্যুর সমান মনে হয় যখন আপনি কারো সামনে হাত পাতেন এবং বলেন, “দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।” এটাকে মৃত্যুর মতো মনে হয়। এটা মৃত্যুর চেয়েও বেশী মনে হয় যে আমি দায়িত্ব নিতে অক্ষম, আমি কিছু করেতে অক্ষম। এখন উম্মাহ হিসেবে আমাদের অবস্থা চিন্তা করুন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহ আমাদেরকে হালাল জীবিকা প্রদান করুন, এবং সর্বদা আমাদের পরিবারের দায়িত্ব বহন করার এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করার সক্ষমতা প্রদান করুন এবং আমাদের সকলকে রক্ষা করুন এমন অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে যখন আমাদেরকে অন্য কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে। আমরা আল্লাহর কাছে তা থেকে সুরক্ষা প্রার্থনা করি। কিন্তু উম্মাহ হিসেবে আমাদের অবস্থা লক্ষ করুন। ব্যক্তিগতভাবে না, রাসূল (স) এই গোটা উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন; তাই না ? তিনি বলেছেন এটা এক-অভিন্ন দেহের মতো। আমরা যদি একটি দেহ হই, আমরা কি সর্বদা ভিক্ষা করছি না ? আমরা কি সর্বদা অন্য মানুষদের কাছে ভিক্ষা চাইছি না ? আমরা কি সর্বদা তাদের দূতাবাসগুলোর সামনে এবং তাদের সরকারী আমলাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি না যে, দয়া করে থামুন, আমরা আপনাদের কাছে সাহায্য চাই, আমরা আপনাদের কাছে সাহায্য চাই। দয়া করে আমাদের কথা শুনুন, দয়া করে আমাদের কথা শুনুন। এটাই কি আমাদের অবস্থা না ? আর এটা বিশেষভাবে তরুণদেরকে খুবই ক্ষুব্ধ করে তোলে। আল্লাহ আমাদেরকে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আয়াত দান করেছেন, وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَّا ٱسْتَطَعْتُمْ مِّن قُوَّةٍ "আর তাদের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হও। যে কোনো ধরণের শক্তিই সম্ভব, তা অর্জনের জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।" [ ৮:৬০ ] অর্থাৎ ক্ষমতা তৈরী করো। ক্ষমতা তৈরী করো। আরবি ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে, مِّن قُوَّةٍ - (মিন ক্বুওয়্যাতিন) হলো তানাওউ’ (تَنَوُّعْ ), যার অর্থ, আল্লাহ এখানে শক্তির সংজ্ঞাকে সীমাবদ্ধ করেননি। আল্লাহ এটাকে একটিমাত্র জিনিসে সীমাবদ্ধ করেননি। আল্লাহ বলতে পারতেন যে, আরো বেশী অস্ত্র সংগ্রহ করো, অথবা সেনাবাহিনীকে আরো বেশী প্রশিক্ষিত করো। তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি। তিনি বলেছেন, সম্ভাব্য সকল ধরণের শক্তি। এটা তোমাদের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তারপর আল্লাহ আরো যোগ করলেন, وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ - ওয়ামির রিবাতিল খইল; আর বিশেষভাবে অশ্বারোহী সেনাদল তৈরী করো। অশ্বারোহী মানে ঘোড়া, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ঘোড়া। এখন আসুন রাসূল (স)-এর জীবনী থেকে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করি। আপনারা জানেন রাসূল (স) মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেছিলেন। তখন মদিনার অবস্থা কি ছিলো ? মদিনাতে অর্থনৈতিক সংকট চলছিলো। আপনি যদি এটা না জেনে থাকেন, এখন জেনে নিন। মদিনাতে অর্থনৈতিক সংকট চলছিলো। মদিনাতে ধনী মুসলিম ছিলো না, সেখানকার মুসলিমরা ছিলো খুবই দরিদ্র। মুহাজিরগণ ইতিমধ্যেই তাঁদের সকল সম্পদ হারিয়েছেন যেহেতু তাঁরা ছিলেন শরণার্থী। তো তাঁরা ইতিমধ্যেই দেউলিয়া, তাঁদের কোনো অর্থ ছিলো না। আর আনসারগণ, যারা তাঁদেরকে সহায়তা করেছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন, আল্লাহ তাঁদের ব্যাপারে বলছেন, وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ - ওয়ালাও কানা বিহিম খসাসাহ, অর্থাৎ তারা নিজেরাও অনাহারে থাকে। তো এখানে শরণার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে দরিদ্র মানুষেরা। এটাই মদিনার পরিস্থিতি। তো সাধারণভাবে বলতে গেলে তাঁরা সম্পদশালী ছিলেন না। আল্লাহ তাঁদেরকে বলছেন, অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত করো। অশ্বারোহী বাহিনী কি ? ঘোড়া; তাই না ? এখন আরব উপদ্বীপে ঘোড়া কি সস্তা ছিলো, নাকি ব্যয়বহুল ? এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আর আল্লাহ কি একটি অথবা দুটি ঘোড়ার কথা বলছেন ? আপনি যদি অশ্বারোহী বাহিনী তৈরী করতে চান, সেক্ষেত্রে কয়েকশো ঘোড়া প্রয়োজন। আপনার কমপক্ষে একশো ঘোড়া প্রয়োজন। প্রথমে আসে ঘোড়া ক্রয়ের বিষয়টি। আপনি যদি এমন ঘোড়া চান যা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে আসবে, সেক্ষেত্রে আপনার ভালো জাতের ঘোড়া প্রয়োজন। আপনার এমন ঘোড়া প্রয়োজন নেই যা প্রায় গাধার মতো, বরং আপনার তরতাজা ঘোড়া প্রয়োজন, আপনার বি.এম.ডাব্লিউ ঘোড়া প্রয়োজন। আর ঘোড়াটি যতো শক্তিশালী, গতিময়, যতো উন্নত জাতের হবে, সেটা ততোটাই ব্যয়বহুল হবে। এর মানে আপনার অর্থ প্রয়োজন। এই ঘোড়াগুলো কোথা থেকে পাবেন ? আর শুধুমাত্র ঘোড়া থাকলেই তো হবে না, ঘোড়াগুলো থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে। তো আপনাকে আস্তাবল নির্মাণ করতে হবে। শুধু তাই না, ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর জন্য আপনাকে কৃষিকাজের মাধ্যমে খড় উৎপন্ন করতে হবে। আর ঘোড়াগুলোর বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য আপনাকে পরিপূর্ণ একটা ব্যবস্থা তৈরী করতে হবে। আর আপনাকে সম্পূর্ণ একটি মানব সম্পদ বিভাগ তৈরী করতে হবে, যাদের একমাত্র কাজ হবে ঘোড়াগুলোকে পরিষ্কার করা, প্রশিক্ষণ দান করা এবং তত্ত্বাবধান করা। এরপর ঘোড়ার পায়ে একধরণের জুতা পরাতে হয়। একাজে নিয়োজিত সম্পূর্ণ একটি শিল্প কারখানা নির্মাণ করতে হবে যেখানে এই জুতা নির্মাণের জন্য বিশেষজ্ঞ কারিগর প্রয়োজন হবে। এই জুতাগুলো নির্মাণের জন্য আপনার ধাতব পদার্থের প্রয়োজন হবে, এর জন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে। আপনাকে সম্পূর্ণ একটি শিল্প কারখানা সৃষ্টি করতে হবে যেখানে ঘোড়ার জুতা তৈরী হবে। আর এটা ছাড়াও ঘোড়ার উপরে বসার জন্য আপনার চামড়ার আসন প্রয়োজন। সেটা কে তৈরী করবে ? এর জন্য চামড়া কোথায় পাবেন ? কোথায় পাবেন গদি ? কোথায় পাবেন আকার নির্ধারনী ? আর এই সবকিছু করার পর, আপনার এমন মানুষের প্রয়োজন হবে যারা তরুণ যোদ্ধাদের ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তো আল্লাহ যখন বলেছেন, সকল ধরণের শক্তি সঞ্চয় করো, আর আমরা মনে করি, হ্যাঁ আমরা এটা করে ফেলবো, আমরা জিহাদ করবো; কিছুক্ষণের জন্য একটু থামুন, একটু থামুন। আল্লাহ বলেছেন, ঘোড়া প্রস্তুত করো, আর আমরা মনে করি, হ্যাঁ, সামান্য ঘোড়াই তো। কিন্তু আল্লাহ যখন ঘোড়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি মূলত গোটা একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরীর আহ্বান করেছেন। এটা নির্মাণ করতে হবে। আল্লাহ যে আহ্বান করছেন, তা আপনি করতে পারবেন না, যদি বিনিয়োগ সৃষ্টি না করেন। এছাড়া ঘোড়া ক্রয় করার অর্থ আপনি পাবেন না, আর এই কর্মসংস্থানগুলো তৈরীর জন্য আপনার কাছে অর্থ থাকবে না। বিনিয়োগ ছাড়া আপনি এটা পারবেন না। অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে তোমাদেরকে শিল্প-কারখানা তৈরী করতে হবে। সমস্যা হলো, বিশেষত তরুণরা যারা এখন শুনছেন, আধুনিক বিশ্বে বেশীরভাগ তরুণদের ক্ষেত্রে কী ঘটে ? আপনি যখন বেড়ে উঠতে থাকেন, আপনাকে বলা হয়, “তোমাকে স্কুলে যেতে হবে এবং স্কুলে ভালো ফলাফল করতে হবে। এরপর একটা চাকুরী পেতে হবে। আর যখনই তুমি চাকুরী পাবে, তখন তোমার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। আর যখন তুমি এই পরিমাণ টাকা উপার্জন করবে, তখন বিয়ে করতে পারবে। যখন তুমি বিয়ে করবে, এরপর একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করবে। একটা ফ্ল্যাট হওয়ার পর, এখন তোমাকে বাড়ির মালিক হতে হবে। এরপর একটা গাড়ি কিনতে হবে। এরপর সন্তান হবে, আর এর সাথে আসবে সন্তানের খরচ। তো আপনি জীবনের বেশিরভাগ অংশই এই চিন্তায় ব্যয় করছেন যে পরবর্তী চেকটি কোথা থেকে আসবে, অর্থ কোথা থেকে আসবে। এর মাঝখানে সুযোগ পেলে উম্মতের সমস্যাগুলো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্টও করতে হবে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে বলতে গেলে, যেহেতু আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতোটাই আচ্ছন্ন, তাই আপনি বড়ো কোনো চিন্তা করতে পারেননি। ফলে আপনার আসলে কোনো ক্ষমতাই অর্জিত হয়নি, অথবা আপনি ক্ষমতাহীন। এখন অন্য ক্ষেত্রগুলোতে কি ঘটে ? এটা এমন এক বাস্তবতা, আমি চাই আপনারা এটা উপলব্ধি করুন। আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার জন্য একটি নিয়ম তৈরী করে দিয়েছেন। আর সেই নিয়ম সর্বদাই বিদ্যমান থাকবে। এমনকি রাসূল (স)-এর সময়েও এই নিয়ম বর্তমান ছিলো। তো উদাহরণস্বরূপ, হিজরতের সময়ের কথা, যা কি-না রাসূল (স)-এর সীরাতের বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর একটি। হিজরতের সময় আল্লাহ আবু-বকর (রা)-র সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর আবু-বকর (রা) হিজরতকে সফল করতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ তিনি উট ক্রয়ের জন্য অর্থ ব্যয় করেছিলেন, তিনি পথপ্রদর্শকের ব্যয় বহন করেছিলেন, তিনি ভ্রমণের জন্য ব্যয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, আর হিযরতের সেই যাত্রাটিকে সহায়তা করার জন্য তিনি সেই সম্পদকে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার রাসূল (স) উপার্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি নিজে উপার্জন করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি দিনরাত রাসূল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাসূল হিসেবে আপনি কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন যখন আপনার কোনো উপার্জন নেই ? খাবার কোথা থেকে আসবে ? আপনি তো এখনো একজন মানুষ, আহারের জন্য আপনার তো এখনো একটি মুখ রয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছিলো কারণ খাদিজা (রা)-র গোটা একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো যা রাসূল (স)-এর কার্যক্রমের অর্থায়ন করে যাচ্ছিলো। এরপর তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ মিশনটি, অর্থাৎ রাসূল (স)-এর সীরাতের পেছনেও ব্যবসায়িক সহায়তা জড়িত ছিলো; তাই না ? তেমনটাই কি ঘটেনি ? আর এখন কি ঘটে ? জানেন এখন কি ঘটে ? যখন আমরা বলি যে, মুসলিমদেরকে শক্তিশালী ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরী করতে হবে, মুসলিমদেরকে শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, “আসতাগফিরুল্লাহ ভাই, অর্থনীতি তো দুনিয়া। আমাদের আখিরাত নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিৎ। আমাদের আখিরাত নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিৎ।” তো আল্লাহ যখন বলেছেন যে, অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত করো, আর এই কারণে কোনো ব্যক্তি কিছুটা অর্থ সংগ্রহ করছে ঘোড়া কেনার জন্য, তখন আমরা বলছি, “আসতাগফিরুল্লাহ ভাই, কেনো আপনি অর্থ সংগ্রহ করছেন ? দুনিয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না।” তখন তাঁর মুখে একটা চপেটাঘাত দিয়ে আপনার বলা উচিৎ যে, “যান, কুরআন পাঠ করুন।” আমি জানি না যে কোন ধর্মের অনুসরণ আপনি করছেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমতা সৃষ্টি করতে বলেছেন, আর আপনি ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারবেন না কি সৃষ্টি ছাড়া ? সম্পদ। আপনি সেটা সৃষ্টি করতে পারবেন না সম্পদ সৃষ্টি ছাড়া। আপনাকে সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। আজকের এই উপস্থিতির মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছেন ব্যবসায়ী। আর আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ তাঁদেরকে সফলতা দান করেছেন। হয়তো আপনি একটি রেস্তোরাঁর মালিক, হয়তো আপনি দুটি রেস্তোরাঁর মালিক। হয়তো আপনি মুদি দোকানের মালিক। হয়তো আপনি পেট্রল পাম্পের মালিক; আমি জানি না আপনারা কিসের মালিক। হয়তো আপনার হাউজিং ব্যবসা রয়েছে। আল্লাহ আপনার ব্যবসায়ে সফলতা প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ যদি ব্যবসায়ে আপনাদের সফলতা দিয়ে থাকেন, জানেন আপনার প্রতি আমার উপদেশ কি ? তা হলো আমাদেরকে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদেরকে ক্ষমতা তৈরী করতে হবে। মুসলিমদের মধ্যেই অর্থ আবর্তিত হতে হবে। যদি আপনার একটি ব্যবসা থাকে, আর আপনার গাড়ি মেরামত করার প্রয়োজন হয়, তাহলে গাড়িটি কাছের মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে মেরামত করুন। আবার যখন তিনি যন্ত্রাংশ ক্রয় করবেন, তাঁর সেটা মুসলিমদের কাছ থেকে ক্রয় করা উচিৎ। এভাবে একে অপরকে সহায়তা করতে হবে। আর যখন মুসলিম ব্যবসাগুলো সাফল্য লাভ করতে থাকবে, তখন তারা বেশী বেশী মুসলিমদের নিয়োগ দিতে শুরু করবে। আর ধীরে ধীরে তারা এই অর্থনীতি গড়ে তুলবে। এখন অধিক সংখ্যক মানুষ যখন অধিক পরিমাণে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করবে, তখন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও আরো শক্তিশালী হতে থাকবে। এটা সর্বশেষ ভাবনা যা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, যেহেতু হাতে খুব একটা সময় বাকী নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা অভিযোগ করি যে, ইসরাইলী লবি আমেরিকান রাজনীতিবিদদের পেছনে শত-শত মিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য, আমরা কখনো এই প্রশ্ন করি না যে, কোথা থেকে তারা এই শত-শত মিলিয়ন ডলার পেলো ? আমরা কখনো এই প্রশ্ন করি না যে, আমাদের কাছে যদি এই শত-শত মিলিয়ন ডলার থাকতো, আমরা কি তা এভাবে ব্যয় করতাম রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য ? নাকি তা প্রমোদ ভ্রমণের পেছনে ব্যয় করতাম ? আমাদের মানসিকতাটা কি ? আমরা ক্ষমতা সৃষ্টির প্রক্ষিতে চিন্তা করি না, আমরা ক্ষমতার জন্য বিনিয়োগ করি না। আমরা বিনিয়োগ করি, হয়তো আমাদের নিজেদের জন্য, অথবা যখন কোনো সংকটের কারণ অনুশোচনা বোধ করি, তখন সেই সংকটে সাহায্যের উদ্দেশ্যে ব্যয় করি। কিন্তু যেই সকল মানুষ ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝে, জানেন তারা কোথায় বিনিয়োগ করে ? তারা বিনিয়োগ করে গণমাধ্যমে, তারা বিনিয়োগ করে শিক্ষাখাতে, তারা বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ে। তারা এই ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করে। আর যখন তারা এই ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করে, তখন তারা এমনকি রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। গণমাধ্যমকে যে-ই নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজনীতিতে তার বড় একটা প্রভাব থাকবে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে যে নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজনীতিতে তার বড় একটা প্রভাব থাকবে। শিক্ষাখাতকে যে নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজনীতিতে তার বড় একটা প্রভাব থাকবে।
মুসলিমদের যদি ক্ষমতা তৈরী করতে হয়, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে যে, সেই ক্ষমতার পেছনে কি রয়েছে। আর এরপর আমাদের সেই ক্ষমতা তৈরী করা শুরু করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, أَعِدُّواْ لَهُمْ مَّا ٱسْتَطَعْتُمْ مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ - আ’ইদ্দু লাহুম মাসতাত’তুম মিস ক্বুওয়াতিন ওয়ামির রিবাতিল খইল। আর মুসলিমরা যখন এই ধরণের ক্ষমতা তৈরী শুরু করবে, আমরা জানি তখন কি ঘটবে। আল্লাহ বলেছেন, تُرْهِبُونَ بِهِ عَدْوَّ ٱللَّهِ - তুরহিবুনা বিহি ‘আদুআল্লাহ। এমনকি তোমাদের এই ক্ষমতা তৈরীকালিন সময়েও আল্লাহর শত্রুরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তিনি আমাদেরকে বলেছেন, একমাত্র এই উপায়েই শত্রুরা তোমাদের ভয় করবে। تُرْهِبُونَ بِهِ عَدْوَّ ٱللَّهِ - তুরহিবুনা বিহি ‘আদুআল্লাহ। আল্লাহর শত্রু। তিনি আরো বলেছেন, عَدْوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ - ‘আদুআল্লাহি ওয়া ‘আদুআকুম। এটাই সর্বশেষ বিষয় যা আপনাদের সাথে আজকে শেয়ার করবো। আল্লাহ বলছেন, যাদেরকে তোমরা ভীতি প্রদর্শন করছো, তারা আল্লাহর শত্রু এবং তোমাদের শত্রু। কার কথা আল্লাহ প্রথমে উল্লেখ করেছেন ? তাঁর কথা, নাকি আমাদের ? তিনি নিজের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছেন - عَدْوَّ ٱللَّهِ - ‘আদুআল্লাহ' (আল্লাহর শত্রু) প্রথমে এসেছে। আর তারপর عَدُوَّكُمْ - ‌’আদুআকুম' (তোমাদের শত্রু) কেনো ? আপনাকে বুঝতে হবে যে, আল্লাহ আমাদেরকে এই ক্ষমতা তৈরী করতে বলছেন আমাদের জন্য না। আমাদের শত্রুদের বিরোধীতার জন্য না। عَدْوَّ ٱللَّهِ - ‘আদুআল্লাহ - কথাটি প্রথমে উল্লেখ করার কারণে, আমি এই কাজটি করছি এজন্য যে, আমি প্রথমত আল্লাহ প্রদত্ত মিশন বাস্তবায়নের কাজ করছি। আমার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এজন্যই আমি ক্ষমতা তৈরী করছি। এজন্যই আমি তরুণদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এজন্যই আমি তাদের মাঝে বিনিয়োগ করছি। এজন্যই আমি চাই যে তারা বেড়ে উঠুক।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে