ঐক্য বলতে আসলে কী বুঝায়?

 


ঐক্য বলতে আসলে কী বুঝায়?

কুরআনে বর্ণিত ঐক্য হলো নিজের ভিতরে অনুভূত ঐক্য। এটা সেরকম ঐক্য না যা শুধু বাহ্যিকভাবে দেখতে ঐক্যের মতো লাগে। এটা ঐক্য না যে, আমরা একইরকম কথা বলি অথবা আমরা একই রকম পোষাক পরি, অথবা আমরা একই মাযহাব অনুসরণ করি তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমাদের দাড়ির দৈর্ঘ সমান তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। অথবা আমাদের কাপড় সমান মাপে টাখনুর উপরে থাকে তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা একই বক্তার আলোচনা শুনি তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। এগুলো সবই অযৌক্তিক, এগুলো সবই অর্থহীন। প্রকৃত ঐক্য হলো, যখনই আপনি কোনো মুসলিম ভাইকে দেখেন, যেই মুহূর্তে তিনি আপনাকে সালাম দেন, অন্য সকল প্রতিবন্ধকতা অদৃশ্য হয়ে যায়। وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا - ওয়ালা তাক্বুলু লিমান আলক্বা ইলাইকুমুস সালামা লাসতা মুমিনা। -- "কেউ যদি তোমাদের প্রতি সালাম ছুঁড়ে দেয় তাহলে তাকে বল না, তুমি মুমিন নও।" এটুকুই। তার সালামই যথেষ্ট। তারা আপনার ভাই, আপনি তাদের জন্য সদা-প্রস্তুত, তারা আপনার জন্য সদা-প্রস্তুত। প্রকৃত ঐক্য হলো, অপর মুসলিমকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসা। মুসলিম ভাইয়ের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত করা, তার সকল প্রয়োজন পূরণ করা, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রয়োজনই না। আল্লাহ তায়ালা যেমন মদিনার আনসারদের প্রশংসা করে বলেছেন, "তারা মুহাজিরদেরকে ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করেনা, আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও; যারা কার্পণ্য হতে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম।" (৫৯:৯) ব্যর্থতা জীবনেরই অংশ। আপনি কোনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন। এটা ঘটতেই পারে। চাকুরীর পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেন। এটা ঘটতেই পারে। ধর্ম পালনেও ব্যর্থ হতে পারেন। কোনো তরুণ হতাশার শিকার হয়ে মদ্যপান শুরু করে দিতে পারে। এটা ঘটতে পারে। এটা ঘটে থাকে। কেউ হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে, এরপর ড্রাগ, মদ্যপান এবং এজাতীয় আরো অন্ধকার পথ বেছে নিতে পরে। আরো খারাপ পথেও যেতে পারে। সে আরো নিচে চলে যেতে পারে, আরো নিচে চলে যেতে পারে। ধরুন, আপনার শিশু সন্তানকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন আর শিশুটি পড়ে গেল, তখন কী করবেন? আপনি তাকে তুলে নিবেন, তাকে মুছে দিবেন। যদি সে আঘাত পায়, সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিবেন, এ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিবেন। তাকে সেরে উঠার সুযোগ দিবেন, যাতে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজে কী ঘটে ? কি হয় যখন আমাদের আশে পাশের কেউ নিচে পড়ে যায়? “ও মাই গড ! আসতাগফিরুল্লাহ, এই যুগের তরুণদের দেখো! জানো কি দেখলাম ? আব্দুল করিম কি করেছে জানো ? লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ। আমি তাকে অমুক জায়গা থেকে বের হতে দেখলাম। আমি তাকে এই কাজ করতে দেখেছি। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রজিউন। ভাই, কেউ একজনের তার সাথে কথা বলা উচিৎ।” প্রকৃত ঐক্য হতো, যদি আপনার মুখ বন্ধ রাখতেন। সবার কাছে তাঁর মান-মর্যাদা নষ্ট না করতেন। এরপর তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন- "ভাই, যদি কখনো প্রয়োজন হয়, আপনার কথা শুনার জন্য আমি সদা প্রস্তুত। আর আমি মারা গেলেও আপনার গোপনীয়তা প্রকাশ করবো না।” এরপর তার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। আমরা অভিযোগ করি, উম্মাহ আজ কেনো ঐক্যবদ্ধ নয়। কোটি কোটি মানুষ রয়েছে। আরে ভাই, আপনি কি আমাদের এক ডজন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ দেখাতে পারবেন ? দুই ডজন দেখাতে পারবেন ? কোটি কোটি মানুষের একতা নিয়ে কথা বলার আগে কয়েকশো ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দেখাতে পারবেন ? আমরা ঐক্যের প্রকৃত অর্থ জানবো না যদি আমরা গোড়া থেকে এটাকে নির্মাণ না করি, যদি আমরা এটাকে লালন না করি। আপনি এবং আমি এটাকে লালন করতে পারবো যদি আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসর থেকে ঐক্যের চর্চা সৃষ্টি শুরু করি এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী শুরু করি। আমি আঠারো-উনিশ বছর বয়স থেকেই মুসলিমদের মাঝে কাজ করেছি, খুতবা, দারস এবং সক্রিয় কার্যক্রমগুলোতে যুক্ত ছিলাম। আমি অনেক হালাকায় যোগ দিয়েছি, অনেক ইমামের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং যারা ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করে এই মানুষদের পরিসরে যুক্ত ছিলাম। আর এই পরিসরে আপনি বন্ধুত্ব তৈরী করেন, তাদের সাথে আপনি কথা বলেন ইসলাম নিয়ে, কথা বলেন উম্মাহর সমস্যা নিয়ে, অমুক আয়াত নিয়ে কথা বলেন, অমুক হাদিস নিয়ে কথা বলেন, ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন, সকল ধরণের জিনিস নিয়ে কথা বলেন। জানেন এই পচিশ বছর যাবত আমার পরিসরের মধ্যে একটি জিনিস রয়েছে যা নিয়ে কেউ কথা বলেনি, আর আমিও এটা নিয়ে কারো সাথে কথা বলিনি ? আর তা হলো, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা কি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আমার পরিসরের মধ্যে এমন মানুষ ছিলেন, যারা সকল ধরণের সমস্যার সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলেন- বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, এমনকি কখনো কখনো আত্মহত্যার চিন্তা, বিবাহ-বিচ্ছেদের কষ্ট, সন্তান লালন-পালন, ভিসা বাতিল হওয়া; সব ধরণের সমস্যা ঘটে যাচ্ছে। আপনার জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কারণ তারা এটা জানে যে, এসব বিষয়ে কথা বলার জায়গা এটা না। এই লোকগুলো এতে মনোযোগী না। তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো শুধু প্রোগ্রাম। তাদের মনোযোগ হলো - “তুমি কি এই প্রোগ্রামটা করতে পারবে ? তুমি কি কাজটা করতে পারবে ?” এটাই তাদের মনোযোগের বিষয়। এটুকুই। ব্যাপারটা তুলণা করার জন্য আমি একবার খ্রিস্টানদের একটি গীর্জায় গিয়েছিলাম। শুধু দেখার জন্য যে তারা কি করে। এক বুধবার রাতে গিয়েছিলাম। এখানকার স্থানীয় একটি গীর্জা। তারা গোল হয়ে বসে। প্রথম পাঁচ-সাত মিনিট তারা গান গায় এবং এই জাতীয় কিছু কাজ করে। এরপর এক ঘন্টা অতিবাহিত করে। জানেন সেই এক ঘন্টায় তারা কি করে ? সেখানকার পাদ্রী একজনকে বললেন, - “এই, তোমার নাম কি ? এর আগে তো তোমাকে দিখিনি।” - “আমার নাম ফ্রাঙ্ক।” - “তোমার নিজের সম্পর্কে কিছুটা বলো ফ্রাঙ্ক।” - সে নিজের পরিচয় দিলো। - আচ্ছা ফ্রাঙ্ক বলো তো, তোমার কি এমন কোনো বিষয় আছে যার জন্য আমরা সবাই প্রার্থনা করতে পারি ?” - “হ্যাঁ, আমার মেয়ে আমার সাথে কথা বলে না। সেজন্য প্রার্থনা করুন।” - “সকলে আসুন ফ্রাঙ্কের জন্য প্রার্থনা করি।” এরপর পরবর্তী ব্যক্তি, পরবর্তী ব্যক্তি, পরবর্তী মহিলা, পরবর্তী মহিলা। “তুমি কি সমস্যায় রয়েছো, আসো তোমার জন্য প্রার্থনা করি। তুমি কি সমস্যায় রয়েছো, আসো তোমার জন্য প্রার্থনা করি।” কল্পনা করতে পারেন, তারা এভাবে কথা বলছে, আর এই মানুষগুলো একে অপরকে চিনেও না ! সবশেষে তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করলো। এরপর এক ব্যক্তি এসে বললো, “হেই, আমার মেয়ের সাথেও আমার একই রকম অবস্থা হয়েছিলো। আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি, মাঝে মাঝে এ বিষয়ে কথা বলতে পারি।” এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি বিস্মিত হয়ে এটা দেখছিলাম। আমাদের সত্য ধর্মের অনুসারী হওয়ার কথা ছিলো; তাই না ? আমাদের হওয়ার কথা ছিলো যারা, أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ - আযিল্লাতিন ‘আলাল মু’মিনিন, (মুমিনদের প্রতি কোমল) আমাদের হওয়ার কথা ছিলো, يُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ - ইউসিরুনা ‘আলা আনফুসিহিম (নিজেদের উপর তাদেরকে প্রাধান্য দেয়।) আমি দেখলাম যে, এই সবগুলো আয়াতই এমন মানুষেরা চর্চা করছে যারা আমাদের ধর্মের ভিতরের কেউ না। আর এতো বছর ধরে আল্লাহর ঘর মাসজিদে এবং মুসলিম পরিবেশে থেকেও আমি এটা দেখিনি। যা আছে, তা খুবই সামান্য। আমাদেরকে যত্নশীলতার লালন করতে হবে, আমাদেরকে ভ্রাতৃত্বের লালন করতে হবে। এখান থেকেই ঐক্য আসবে। এটা বক্তব্য, আলোচনা এবং ভিডিও থেকে আসবে না। এটা আসবে যখন আপনি এবং আমি আসলেই সম্পর্ক তৈরী করবো, গভীর সম্পর্ক। আল্লাহ আমাদেরকে খাঁটি ঐক্যের অধিকারী মানুষে পরিণত করুন, আর আমাদেরকে একে অপরের প্রতি আন্তরিক করে দিন। তিনি আমাদের সম্পর্কের কৃত্রিমতা ও কপটতা দূর করে দিন এবং সবচেয়ে শক্তিশালী, গভীর এবং অকৃত্রিম সম্পর্ক দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করে দিন। -- নোমান আলী খানের আলোচনা অবলম্বনে

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে