জমিন এবং পর্বত

 


আমরা পৃথিবী দিয়ে শুরু করছি। সূরা নাবায় আল্লাহ তায়ালা বলেন- "اَلَمۡ نَجۡعَلِ الۡاَرۡضَ مِهٰدًا" - "আমি কি যমীনকে (তোমাদের জন্য) শয্যা বানাইনি?" وَّ الۡجِبَالَ اَوۡتَادًا - আর পর্বতসমূহকে পেরেক? জমিনের উপর। কুরআন বর্ণনা করেছে পৃথিবী নড়াচড়া করে, ঝাঁকুনি দেয়। আর পর্বতসমূহ একে আটকে রাখে। সামলে রাখে।

এখন, আরবিতে জমিনের জন্য যে শব্দ ব্যবহার করা হয় তা স্ত্রীবাচক। আর পর্বত পুরুষবাচক। জমিন আবার জন্ম দান করে। গাছ-গাছালি, লতা-পাতা জমিন থেকে বের হয়ে আসে। এ কারণে একে আবার মিহাদা বলা হয়। মিহাদ হলো মায়ের কোল। পুরুষকে বর্ণনা করা হয়েছে পরিবারের ভরণপোষণের যোগানদাতা হিসেবে। পরিবারে স্থিতিশীলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা ইত্যাদি ধরে রাখার দায়িত্ব তার। প্রথমে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন জমিন এবং পর্বত বিবাহিত। ঠিক এরপরেই তিনি বলেন পুরুষ আর মহিলা বিবাহিত। "ওয়া খালাকনাকুম আজওয়াজা।" ব্যাপারটা চমৎকার নয় কি? জমিন এবং পর্বত একে অপরের জোড়া। মনে মনে একটি চিত্র কল্পনা করুন। বিশাল আয়তনের জমিন। আর জমিনের উপর দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন বিশাল এক পর্বত। এই প্যাসেজের শেষে গেলে দেখবেন আল্লাহ বর্ণনা করেছেন বিশাল আকাশের কথা। আর সেই আকাশে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জিনিস হলো সূর্য। তো, তিনি শুরু করেছেন দিগন্ত বিস্তৃত জমিন দিয়ে এবং এর উপর দাঁড়িয়ে আছে পর্বত। আর শেষ করেছেন বিশাল আকাশ দিয়ে এবং তার মাঝে সবচেয়ে দৃষ্টি গোচর একটি জিনিস দিয়ে। এভাবেই প্যাসেজটির শুরু এবং শেষ। একটি জোড়ার বর্ণনা। এরপর আরেকটি জোড়া। দ্বিতীয় যে জিনিসটি তিনি বর্ণনা করেছেন- তিনি পুরুষ এবং নারীকে জোড়া হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এরপর বলেন- وَّ جَعَلۡنَا الَّیۡلَ لِبَاسًا - وَّ جَعَلۡنَا النَّهَارَ مَعَاشًا - তিনি রাতকে করেছেন আবরণ এবং দিনকে করেছেন জীবিকা উপার্জনের সময়। একদিকে তিনি বলেন পুরুষ এবং নারী। অন্যদিকে তিনি তাদের রাত এবং দিনের সাথে তুলনা করেন। ব্যাপারটা দারুণ বিস্ময়কর! সূরা আল-লাইলে আল্লাহ বলেন- وَ الَّیۡلِ اِذَا یَغۡشٰی - وَ النَّهَارِ اِذَا تَجَلّٰی- وَ مَا خَلَقَ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰۤی - "কসম রাতের, যখন তা ঢেকে দেয়। কসম দিনের, যখন তা আলোকিত হয়। কসম তাঁর, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন।" কুরআনে দিন এবং রাত্রির সম্পর্ক অধ্যনের মাধ্যমে আপনি নর-নারীর রিলেশনশিপ সবন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন। রাত্রিকে তিনি পোশাক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর বৈবাহিক সম্পর্কের অন্যতম কিছু দিক হলো— স্বামী স্ত্রী একে অন্যকে সমর্থন দিবেন, একে অন্যের পক্ষে কথা বলবেন, একে অন্যের সাথে অন্তরঙ্গ হবেন এবং রোমান্টিক হবেন। একে অন্যের গোপন বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করবেন না যেমনিভাবে পোশাক মানুষের শরীরকে প্রকাশ হতে দেয় না। স্বামী স্ত্রী একে অন্যের রক্ষক হিসেবে কাজ করবেন। যেমন— রান্না করার সময় কখনো কখনো গরম তেল ছিটকে আসে, কিন্তু আপনি পোশাক পরে থাকার দরুন তা আপনার পোশাকে এসে লাগে এবং আপনার শরীরকে পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি আপনার পার্টনারকে অপমান করে আপনি সেই অপমান সহ্য করেন কিন্তু আপনার জীবন সঙ্গীকে তা থেকে রক্ষা করেন। একে অন্যের পরিচ্ছদ হওয়ার এটা অন্যতম এক দাবি। শারীরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে, আবেগময় সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, একে অন্যের গোপন বিষয় অন্য কারো কাছে প্রকাশ না করা, একে অন্যকে নিয়মিত সঙ্গ দেয়া, অন্তরঙ্গ হওয়া, একে অন্যের সব বিষয় বুঝতে পারা ভালো বা খারাপ... পোশাক যেমন আপনার শরীরের সুন্দর অংশ ঢেকে রাখে আবার আপনার কুৎসিত অংশও ঢেকে রাখে। ঠিক তেমনি এক সঙ্গীর নির্দিষ্ট কিছু কৌতুক এবং সৌন্দর্য শুধুই অপর সঙ্গীর জন্য। নির্দিষ্ট কিছু কদর্যতা শুধু অন্য সঙ্গী জানবেন, অন্য কারো সেটা জানার দরকার নেই। রাত যেমন সব আচ্ছাদিত করে রাখে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই দিকগুলোও শুধুই স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যাপার। কিন্তু, দিন তো সবকিছু প্রকাশ করে দেয় তাই না? আর আল্লাহ বলেন- وَّ جَعَلۡنَا النَّهَارَ مَعَاشًا - দিন এমন একটা সময় যার মাধ্যমে তোমরা জীবিকা উপার্জন করো। পুরুষ চাকরিতে যেতে পারবে না যদি স্ত্রী ঘরের যত্ন না নেয়। স্ত্রী যদি সহযোগিতা না করে পুরুষ তার চাকরি করতে পারবে না। অথবা তাদের উভয়কেই হয়তো ব্যবসা চালাতে হয়। এমনটাও ঘটে। এমনকি সাহাবাদের সময় থেকেই। নর-নারী উভয় বাগানে কাজ করত। তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে— কে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসবে, কে বাড়ির কাজে সাহায্য করবে, কে আজ থালা বাসন পরিষ্কার করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সমস্ত কিছু উভয়ের মাঝে বন্দোবস্ত করতে হবে। আমি কী নিয়ে কথা বলছি? রেস্পন্সিবিলিটি। দায়-দায়িত্ব নিয়ে। তাহলে বিয়েতে যেমন ভালোবাসা আছে তেমনি আরো কী আছে? দায়-দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে মুসলিম বিয়েগুলোতে কী হয়? এটা শুধু দায়-দায়িত্বের মাঝে সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর ডেটিং কী নিয়ে? শুধু ভালোবাসা। কুরআন নর-নারীর একত্রিত হওয়ার চিত্রটি কিভাবে অঙ্কন করেছে? লাভ উইথ রিস্পন্সিবিলিটি। দায়িত্বসহ ভালোবাসা। আর আপনি আপনার দায়-দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। কারণ এগুলো বিরক্তিকর, অবসাদকারী এবং ক্লান্তিকর। যখন আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন রাত আসলে আপনার কী দরকার? আপনার রাত দরকার দিনের কাজ ঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য। রাতে যদি ঐ চার্জটি না পান দিনের কাজ সঠিকভাবে করতে পারবেন না। আর দিনে যদি জীবিকা উপার্জন না করেন তাহলে আরামদায়ক রাত কাটাতে পারবেন না। পরস্পরকে তাদের প্রয়োজন। তাহলে, প্রথমে জমিন এবং পর্বত। শেষে আকাশ এবং সূর্য। কিন্তু যে জিনিসটি আমাকে ব্যাপকভাবে চমৎকৃত করল তা হলো প্যাসেজের মাঝের অংশ। " وَّ جَعَلۡنَا نَوۡمَکُمۡ سُبَاتًا ۙ" - "আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি এমন কিছু যা তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।" ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। কারণ, এই প্যাসেজের সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায় বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবী এবং পর্বত। আকাশ এবং সূর্য। নর এবং নারী। দিন এবং রাত। তাহলে ঘুমাতে যাওয়া কিসের সাথে জোড়ার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা? জেগে থাকা। কিন্তু আল্লাহ এটা উল্লেখ করেননি। ঘুম যে জেগে থাকার জোড়া, এই উপসংহারে তো আপনি নিজেই আসতে পারেন তাই না? কুরআনে ঘুমকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। ঘুম থেকে যেমন আপনি জেগে উঠবেন ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরেও শেষ বিচারের দিন জেগে উঠবেন। (এ জেগে উঠাই শেষ জেগে উঠা এরপর আর ঘুম নেই, মৃত্যু নেই। জান্নাতে কেউ কোনোদিন ক্লান্ত হবে না। তাই, সেখানে ঘুম নেই। আর জাহান্নামে? لَا یَمُوۡتُ فِیۡهَا وَ لَا یَحۡیٰی - সে সেখানে মরবেও না এবং বাঁচবেও না।) নিজে নিজে চিন্তা করেই আপনার এই উপসংহারে আসার কথা। কুরআন কি চমৎকার ভাবেই না বিচার দিনের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে!! —নোমান আলী খানের আলোচনা থেকে

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে