সবর আসলে কি ?

 


আমরা সংক্ষেপে সবর সম্পর্কে জানবো। এ বিষয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। বহু সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিতে সবর হলো—কান্না না করা। কিন্তু সীরাত থেকে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূল (স)-ও কেঁদেছিলেন। তাই কান্না না করাটা সবর হতে পারে না। সবরের সাথে যন্ত্রণা অনুভবের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ভুল ধারণা। অনেকের কাছে সবর অর্থ আপনি কাঁদবেন না। এটা কোথা থেকে পেলেন ? কে আপনাকে বলেছে যে, সবর অর্থ যন্ত্রণাহীনতা, সবর অর্থ দুশ্চিন্তাহীনতা, সবর অর্থ কান্না না করা ? এটা একটা ভুল ধারণা।

তাহলে সবর আসলে কি ? সবর হলো একটি অভ্যন্তরীন, মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। কিভাবে ? আপনি আপনার মনঃকষ্টকে যুক্ত করবেন সেই পুরষ্কারের সাথে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেন। এটাই হলো সবর। সবরের অবস্থান আপনার মনে। এটা বড় একটা সংগ্রাম। কারণ আপনার হৃদয় শূন্যতায় ছেয়ে আছে। আপনার অস্তিত্ত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম— “এর পরে আমি কিভাবে বাঁচবো !” সবর অর্থ—সেই দুর্দশা, সেই যন্ত্রণা, সেই কষ্টকে আপনি যুক্ত করবেন কিসের সাথে ? আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত পুরষ্কারের সাথে। আর যখন আপনি এটাকে আল্লাহর পুরষ্কারের সাথে যুক্ত করবেন, যখন আপনি আল্লাহর পুরষ্কারের প্রত্যাশা করবেন, তখন সহসাই কোমল এক প্রশান্তি অনুভব করবেন। আপনি স্বস্তি অনুভব করবেন। আল্লাহ আমাকে যা প্রদান করবেন, তা আমি যা হারিয়েছি তা থেকে উত্তম। যখন আমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবো, আল্লাহ আমাকে আমার এই যন্ত্রণার তুলনায় অনেক বেশী দান করবেন—এই চিন্তাই যন্ত্রণাটিকে সহনযোগ্য করে দিবে। এটাই হলো সবর। তো আপনি যখন এভাবে চিন্তা করবেন—যন্ত্রণাটি কিন্তু এখনো বিদ্যমান, হৃদয়ের শূন্যতা এখনো বর্তমান—তখন সহসাই আপনি নিজেকে আল্লাহর মহাপরিকল্পনার কাছে সমর্পণ করে দিবেন। আর আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো কথা বা কাজ করবেন না। এটাই হলো সবর। সবর হলো আপনার অন্তর্গত যন্ত্রণাকে আপনার প্রত্যাশিত পুরষ্কারের সাথে যুক্ত করা। আপনি যদি এই যোগসূত্র তৈরী করতে পারেন, আপনি সবর অর্জন করেছেন। কারণ, যখন এই যোগসূত্র তৈরী করবেন, হয়তো খুশী হতে পারবেন না, দুঃখ-দুর্দশার সময় কেউ তো খুশী হতে পারে না, কিন্তু আপনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন, “সামনে আমার জন্য উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে”। আর এই সান্ত্বনাটিই আপনাকে প্রকৃতিস্থ রাখবে। এই সান্ত্বনাটিই আপনাকে সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি যোগাবে। এই সান্ত্বনাটিই আল্লাহর প্রতি ইমানকে প্রদর্শন করে, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব না। আর সেজন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ - ইন্নামা ইউওয়াফ্ফাস সবিরুনা আজরাহুম বিগইরি হিসাব। সবরের প্রতিদান আল্লাহ হিসাব ছাড়া প্রদান করবেন। আর জান্নাতের সর্বোত্তম স্তর অর্থাৎ জান্নাতুল ফেরদাউসের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ফেরেশতাগণ জান্নাতিদেরকে অভিবাদন জানাবেন, وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ - ওয়াল মালাইকাতু ইয়াদখুলুনা ‘আলাইহিম মিন কুল্লি বাব, সালামুন ‘আলাইকুম বিমা ছবারতুম, ফানি’মা উক্ববাদদার। আপনি যদি সবর অবলম্বন করেন, আপনি সর্বোত্তম জান্নাত লাভ করবেন। লক্ষ্য করুন প্রিয় ভাইয়েরা, আমি আপনাদের এমন একটা কথা বলবো সম্ভবত আপনি কথাটা এভাবে কখনো শুনেননি, কিন্তু আল্লাহর শপথ, এটা সত্য। জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ। এটা সহজ। وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ - ওয়ামা জা’আলা ‘আলাইকুম ফিদ দীনি মিন হারাজ। يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ - ইউরিদুল্লাহু বিকুমুল ইউসর। আল্লাহ এই ধর্মকে কঠিন করেননি। আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন, রমযানে রোযা রাখুন, যাকাত প্রদান করুন, বড় গুনাহগুলোকে পরিহার করুন, আর এমনকি আপনি যদি বড় গুনাহ করেও ফেলেন, আল্লাহর কাছে সত্যিকার অর্থে অনুতপ্ত হোন এবং নতুন অধ্যায়ের সূচনা করুন। আপনি যদি বড় গুনাহগুলো পরিহার করতে পারেন, অথবা বড় গুনাহগুলোর জন্য তওবা করেন, এবং ইসলামের পাঁচটি আরকান মেনে চলেন, মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনি জান্নাত লাভ করবেন। একথা আমি বানিয়ে বলছি না। এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসগুলো পাঠ করুন—বেদুইনের সেই হাদিস, ইসলামের আরকান সংক্রান্ত হাদিসগুলো। জান্নাতে প্রবেশ করা তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু ফেরদৌসে প্রবেশ করা—সেটা কঠিন ব্যাপার। সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়া—সেটা ভিন্ন জিনিস। আল্লাহ সর্বোত্তম ছাত্রদেরকে পৃথক করেছেন। A+ হলো সর্বোত্তম গ্রেড; আর সর্বনিম্ন গ্রেড কি ? D ? আল্লাহ A+ কে D গ্রেড থেকে পৃথক করেছেন। আল্লাহ A+ কে D থেকে পৃথক করেছেন। D গ্রেড পাওয়া, শুধু পাশ করা— এটা তেমন কঠিন না। আমি নিজে থেকে এটা বলছি না, কুরআন এবং সুন্নাতেই একথা রয়েছে। উম্মার বেশীরভাগ সদস্য, যারা সৎকাজ করার চেষ্টা করে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, তারা নামাজ আদায় করার চেষ্টা করে, তারা রমযানে রোযা রাখে, তারা বড় গুনাহগুলো থেকে দূরে থাকে, তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস করে, উম্মার বেশীরভাগ সদস্যই ইনশা আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা রাসূল (স)-এর কথা। কিন্তু আপনি যদি সর্বোত্তম স্থানের আশা করেন, আপনি যদি ফেরদাউসের আশা করেন, সেটা সহজ না। সেটার জন্য আপনাকে নূন্যতম দায়িত্বগুলোর চেয়ে বেশী কাজ করতে হবে; বুঝতে পারছেন ? কিভাবে আপনি সেই সর্বোচ্চ জান্নাতে পৌছুবেন ? তার জন্য অনেকগুলো উপায় রয়েছে। কিন্তু একটি উপায়, একটি উপায় হলো, আল্লাহ দুঃখ-দুর্দশা প্রেরণ করেন। কারণ তিনি চান আপনি সর্বোত্তম জান্নাত লাভ করেন। আর এই দুঃখ-দুর্দশার উদ্দেশ্য হলো আপনাকে পদোন্নতি প্রদান করা—এই দুঃখ-দুর্দশা মোকাবেলা করার ফলে। আমি একটি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরছি। গাযার অধিবাসীগণ—মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সবর প্রদান করুন, তাঁদের শহীদদের উপর রহম করুন এবং তাঁদেরকে এই অন্যায়-অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় বের করে দিন। আপনি কি মনে করেন যে আমরা যারা বিলাসিতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করছি, আমরা আর গাযার অধিবাসীগণ একই জান্নাত লাভ করবো ? আল্লাহ তাঁদেরকে পরীক্ষা করছেন ! তাঁদের মধ্যে যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন, আর তাঁদের অধিকাংশই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন, তাঁদের ইমান পৃথিবীর মাঝে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। আপনি কি মনে করেন তাঁরা আমাদের মতো ? তাঁরা বাবা, মা, সন্তান হারাচ্ছেন. তাঁরা সবকিছু হারাচ্ছেন, বোমা পতিত হচ্ছে, কোনো খাবার নেই; কিন্তু তবুও আল্লাহর প্রতি তাঁদের ইমান এতো মজবুত। আপনি কি মনে করেন তাঁরা এবং আমরা বাকী সবাই সমান ? কখনোই না। এভাবেই আপনি জান্নাতুল ফেরদৌস অর্জন করবেন। এভাবেই আপনি সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করবেন। আমরা তাঁদের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে চাই না। কিন্তু যাদেরকে আল্লাহ পরীক্ষার জন্য বাছাই করেন, আর তাঁরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তাঁরা D গ্রেড পাবেন না। তাঁরা পাবেন A+ । তো সবর অর্থ, আপনি আপনার দুঃখ-দুর্দশাকে আল্লাহর পুরষ্কারের সাথে যুক্ত করবেন। —ডক্টর ইয়াসির কাদি

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে